ফি’র বিনিময়ে রাজধানীর আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগ, উদ্বেগে সংশ্লিষ্টরা
নির্দিষ্ট ফি'র বিনিময়ে রাজধানীর কয়েকটি অভিজাত এলাকার আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগ দিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এজন্য একটি নীতিমালাও করেছে মন্ত্রণালয়।
গুলশান আবাসিক এলাকার গুলশান এভিনিউ, বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, বারিধারা আবাসিক এলাকার প্রগতি সরণি, উত্তরা (প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব) আবাসিক এলাকার জসিম উদ্দিন এভিনিউ, রবীন্দ্র সরণি, সোনারগাঁ জনপথ, গাওসুল আজম এভিনিউ, গরীবে নেওয়াজ এভিনিউ, শাহ মখদুম এভিনিউ, শাহজালাল এভিনিউ, ঈশা খাঁ এভিনিউ ও আলাওল এভিনিউ এলাকার আবাসিক প্লটগুলো বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তর করা যাবে। তবে আবাসিক প্লটগুলোর দুই পাশের রাস্তার প্রশস্ততা কমপক্ষে ১০০ ফুট হতে হবে।
এসব এলাকার বাইরে রাজউকের আওতাধীন অন্যান্য এলাকার ১০০ ফুট চওড়া সড়কের পাশের আবাসিক প্লটও এই নীতিমালার আওতায় বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগ নিতে পারবে।
এর আগে ২০২০ সালের মার্চে তেজগাঁও শিল্প এলাকাকে শিল্প কাম বাণিজ্যিক ও আবাসিক হিসেবে রূপান্তরের সুযোগ দেয় সরকার। গত তিন বছরে তেজগাঁও এলাকার প্রায় ১০০ শিল্প প্লট বাণিজ্যিক কাম আবাসিক প্লটে রূপান্তর হয়েছে। এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খিলগাঁও, রাজারবাগ ও বাসাবো ওহাব কলোনী পুনর্বাসন এলাকাকে আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে রূপান্তরের সুযোগ দেয়। তবে এসব এলাকায় অল্প কিছু প্লট রূপান্তর হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক আদিল মোহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, "বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে শহরের উন্নতি হয়নি। বরং বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। হঠাৎ করে আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগ দিলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় নতুন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। কিছু ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের চাপে সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে আবাসিক এলাকার বৈশিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া রাজধানীর বিকেন্দ্রীকরণের যে সিদ্ধান্ত রয়েছে এ উদ্যোগে তা কার্যকর করা কঠিন হবে।"
নীতিমালায় বলা হয়েছে, গুলশান, বনানী ও বারিধারা (জে ব্লক বাদে) আবাসিক এলাকার আবাসিক প্লট বাণিজ্যিক প্লটে পরিবর্তনের জন্য কাঠা প্রতি ১ কোটি টাকা ফি দিতে হবে। আর বারিধারী জে ব্লক ও উত্তরা (প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব) আবাসিক এলাকার প্লট বাণিজ্যিক প্লটে পরিবর্তনের জন্য কাঠা প্রতি ৫০ লাখ টাকা ফি দিতে হবে।
ওই নীতিমালায় বলা হয়েছে, যেসব এলাকায় আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেখানে ইতিমধ্যে যেসব প্লট অবৈধভাবে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে তাদেরকে আগামী ৬ মাসের মধ্যে অবশ্যই আনুষ্ঠানিকভাবে প্লটের শ্রেণি পরিবর্তন করে নিতে হবে। নতুবা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরা (প্রথম ও দ্বিতীয়) আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্লটে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এসব এলাকার মাস্টার প্ল্যান, ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ), ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ভূমি ব্যবহার সম্পর্কিত প্রচলিত আইনের সাংঘর্ষিক কিছু করা যাবে না। ইমারতের নকশা বা লে-আউট অনুমোদনের ক্ষেত্রে ড্যাপ, ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০২০ সহ সংশ্লিষ্ট সকল আইন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
এই নীতিমালায় বলা হয়েছে, গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরা (প্রথম ও দ্বিতীয়) আবাসিক এলাকার ভেতরে অবস্থিত পরিত্যক্ত সম্পতির প্লটের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে আবাসিক বা বহুতল ভবন নির্মাণ, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সুবিধা যেমন স্কুল, কলেজ, পার্ক, গাড়ি পার্কিং, দুর্যোগকালীন সমাবেশ, সিনিয়র সিটিজেন কেয়ার সেন্টার, মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে।
তবে উত্তরা প্রথম ও দ্বিতীয় আবাসিক এলাকার বেশ কিছু এলাকা বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের সুবিধার্থে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ উচ্চতা নিয়ন্ত্রিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ওইসব প্লটে বাণিজ্যিক ভবন স্থাপন করা যাবে না। চাইলে পার্ক, খেলার মাঠ, কবরস্থান, জলাধার, সোলার পার্ক স্থাপন করা যাবে।
এছাড়া বারিধারা কে ব্লক ও নর্থ গুলশান এভিনিউর কয়েকটি ব্লকে ডিপ্লোম্যাটিক জোন থাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে কোনো আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে পরিবর্তন করতে নিরাপত্তা সংস্থার অনাপত্তি নিতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতিমধ্যে এসব এলাকার অনেক আবাসিক প্লটই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এতে ওইসব এলাকার আবাসিক বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল। যানজটসহ আরও নানান ধরনের সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে এ ধরনের প্লটমালিকরা বেশ আগে থেকেই সরকারের কাছে আবাসিক থেকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করে আসছিলো।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই নীতিমালা করার আগে সংশ্লিষ্ট এলাকার রাস্তার প্রশস্ততা, আশেপাশের বাণিজ্যিক ভবনের অবস্থান, ভবিষ্যত বাণিজ্যিক চাহিদা, অধিবাসীর সংখ্যা পর্যালোচনা করা হয়েছে। নগরের বৈশিষ্ট্য যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে।
২০০৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেখানে রাজউকের গুলশান, বনানী আবাসিক এলাকার গুলশান শ্যুটিং ক্লাব থেকে গুলশান ২ নম্বর চত্বর, বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, গুলশান-বনানী সংযোগ ব্রিজ থেকে গুলশান-বারিধারা ব্রিজ এবং গুলশান-মহাখালী ব্রিজ থেকে বাড্ডা লিংক রোড (গুলশান দক্ষিণ এভিনিউ) পর্যন্ত উভয় পাশের প্লটগুলো বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহারের এবং বনানী ১১ নম্বর রোডের উভয় পাশের প্লটগুলোর অনাবাসিক ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়। তবে এসব রোডের বাইরেও গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকায় বিভিন্ন আবাসিক প্লটে নির্ধারিত ফি দিয়ে রাজউকের অনুমোদন নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যবহার করা হচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, যথেষ্ট যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনেক সময় বিভিন্ন চাপে নত হয়ে অনৈতিকভাবে অর্থের বিনিময়ে এ ধরনের রূপান্তরের সুযোগ দেয়া হয়। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় যথেচ্ছভাবে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের সুযোগ দেয়ার ফলে একটি এলাকার অধিবাসীদের বসবাসের জন্য যে ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন তা নষ্ট হচ্ছে।