বিআরটি অন্যান্য যানবাহনের জন্য সড়কের জায়গা সংকীর্ণ করে ফেলায় যানজটের আশঙ্কা
আগামী বছরে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে দেশের প্রথম বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প। ডেডিকেটেড বাসওয়েটির কাজ শেষ হলে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত দ্রুত ও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারবেন এর যাত্রীরা। কিন্তু, একই রুটের সাধারণ লেনে চলাচলকারী যাত্রী ও যানবাহনকে আরও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
২০.৫ কিলোমিটার সড়কে দ্রুতগামী বাসের পৃথক বিশেষায়িত লেনের কোথাও কোথাও উড়াল অংশ রয়েছে। প্রস্থে যা বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কের প্রায় অর্ধেক দখল করেছে এই করিডর দিয়ে চলাচলকারী মোট যাত্রীদের এক-পঞ্চমাংশের কম যাত্রীর সুবিধা নিশ্চিতে। এতে অন্যান্য পরিবহনের জন্য মূল সড়কটি একেবারেই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। এমনটাই জানিয়েছে এক দশকের বেশি সময় ধরে চলমান এই প্রকল্পের মূল অর্থায়নকারী এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
চার লেনের সড়কটির দুই লেনে নির্মাণ করা হচ্ছে বিআরটি, যা চালু হলে প্রতিদিন ১.৮৮ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ যাত্রী বহন করা যাবে। কিন্তু বিআরটি ব্যবস্থা মূল রাস্তা সংকুচিত করায় সড়কটির সাধারণ লেনে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যানবাহনে চলাচল করা প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে দীর্ঘ যানজটের কবলে পড়তে হতে পারে।
এছাড়া রাস্তাজুড়ে রয়েছে প্রায় ১৯টি বিআরটি স্টেশন, এতে অন্যান্য সব ধরনের পরিবহনের জন্য জায়গা রাখা হচ্ছে মাত্র চার মিটার।
সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিআরটি স্টেশনের পাশে কোন বাস বা ট্রাক দাঁড়িয়ে গেলে, একটি সিএনজি অটোরিক্সাও পাশ কেটে যেতে পারে না। এর ফলে অন্যান্য গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত গাড়ির চাপে কিছুক্ষণের মধ্যেই লম্বা যানজট শুরু হয়ে যাচ্ছে।
নির্দিষ্ট বাস লেনে চলাচলের উচ্চ-মানের সেবা দিতে ২০১২ সালে প্রকল্পটি শুরু করে সরকার। প্রাথমিকভাবে ২০১৬ সালে এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও, সে মেয়াদ বেড়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে ২,০৪০ কোটি টাকা থেকে সংশোধিত ব্যয় উঠেছে ৪,২৬৮ কোটি টাকায়।
এডিবির ২০২২ সালের জুলাইয়ের সমীক্ষা বলছে, গাজীপুর-বিমানবন্দর করিডরে দুই দিকে প্রতিদিন ১.১১ লাখ গাড়ি যাতায়াত করে। এর মধ্যে অন্তত ২৩,০০০ গাড়ি গাজীপুর চৌরাস্তা অতিক্রম করে ময়মনসিংহের দিকে চলে যায়। এছাড়া, সাভার এবং আশুলিয়া থেকে যাত্রী ও পণ্যবাহী অনেক পরিবহন করিডরের আব্দুল্লাপুর হয়ে বিআরটি করিডরে আসে।
এরই মধ্যে জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা সড়ক চার লেনে উন্নীত হওয়ার পর রাজশাহী ও রংপুর এলাকার যাত্রীরা ভোগরা চৌরাস্তা হয়ে রাজধানী ছাড়ছেন। ঢাকা বাইপাস পিপিপি প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সিলেট ও চট্টগ্রামের যাত্রীদের বড় একটা অংশও ভোগড়া বাইপাস হয়ে ঢাকায় বা গাজীপুরে আসবেন।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, সরকারি অর্থ ব্যয় করে এই করিডরের উপযোগিতাকে আরও দুর্বল করা হয়েছে। প্রকল্পের নকশা প্রণয়নের সময় বিআরটির গাড়ি ও এর যাত্রীদের বাইরে অন্য কোনো পরিবহনের কথা একবোরেই বিবেচনা করা হয়নি।
এদিকে সাধারণ পরিবহনের জন্য চার মিটার জায়গা একেবারেই কম নয় বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেড- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম। অনেক হিসাবনিকাশ করেই প্রস্থ নির্ধারণ করা হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, "আশেপাশের তুলনায় স্টেশনে জায়গা কিছুটা কম। তবে স্টেশন এলাকায় রাস্তাটার প্রস্থ একটু মোটা, কিছুটা বাঁকা রাখা হয়েছে।"
আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই বিআরটি সেবা চালুর প্রস্তুতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে এসেছে। বাস কেনাকাটার কাজও অনেকটা এগিয়ে গেছে। অনুমোদন পাওয়া গেলে আগস্টের মধ্যে বাস এসে যাবে।
#খণ্ডিত ব্যবস্থা, অসম্পূর্ণ সেবা
ঢাকা বিআরটি কোম্পানির সূত্র জানায়, অবকাঠামো নির্মাণের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষে চলতি বছরের শুরুতে ডিজেলচালিত ১৩৭টি স্ট্যান্ডার্ড এসি বাস কেনার দরপত্র প্রকাশ করে কোম্পানিটি। তবে বিশ্বব্যাপী বাড়তি যাত্রী পরিবহনের সুবিধার্থে আর্টিকুলেটেড এমনকি ডাবল আর্টিকুলেটেড বাসে বিআরটি ব্যবস্থা পরিচালিত হলেও ঢাকা বিআরটির স্ট্যান্ডার্ড বাস কেনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন বিশেষজ্ঞরা।
আর্টিকুলেটেড বাসে ১৪০ জন যাত্রী ধারণ সক্ষমতা হিসাব করে প্রতি ঘণ্টায় ২০ হাজার যাত্রী পরিবহনের জন্য বিআরটি ব্যবস্থার নকশা করা হয়েছিল। এখন স্ট্যান্ডার্ড বাস কেনায় যাত্রী ধারণ ক্ষমতা অর্ধেকে নামবে।
বিআরটি সেবা চালু পরিচালনা করতে ইতোমধ্যেই ১০টি বেসরকারি কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি। যদিও প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত বিআরটিসির মাধ্যমেই এই সেবা চালুর কথা ভাবছে কর্তৃপক্ষ।
তবে নতুন এই সেবা যাত্রীদের কতটা আকৃষ্ট করতে পারবে, যাত্রী পরিবহন করে কোম্পানি বা বেসরকারি অংশীদার কতটা লাভ করতে পারবে, সেবাটি কতটা টেকসই হবে, আর যানজট কমাতে এই বিআরটি ব্যবস্থা কতটা ভূমিকা রাখবে এসব বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, বিমানবন্দর থেকে মহাখালী ও মতিঝিল হয়ে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটি ব্যবস্থা চালু হবে ধরে নিয়েই গাজীপুর থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু, বিমানবন্দরের দক্ষিণ পাশে বিআরটি সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় সম্ভাব্য যাত্রীর সংখ্যা কমে আসবে।
বিমানবন্দর থেকে বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই খণ্ডিত বিআরটি করিডর অনেকেই ব্যবহার করতে চাইবেন না।
সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন করা হলে বিমানবন্দর-গাজীপুর করিডরে বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমোদন পেত না বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান।
"একটা ক্যাপটিভ করিডোরে বিআরটি নির্মাণ কখনই আর্থিক বা অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিসঙ্গত না। বিআরটি নির্মাণ করতে হয় এমন করিডোরে, যেখানে সারা দিন প্রায় একই হারে যাত্রী চলাচল করে। নির্মাণাধীন বিআরটি ব্যবস্থায় শুধু সকালে আর বিকালের রাশ আওয়ারে যাত্রী পাওয়া যাবে।"
তিনি বলেন, গাজীপুর থেকে গণপরিবহনে ওঠা যাত্রীদের একটা অংশ উত্তরা এলাকায় নেমে যান। তারা বিআরটি ব্যবহার করলেও বাড্ডা, নতুনবাজার, বনানী, বিজয়সরণি ও ফার্মগেইট-গামী এলাকার যাত্রীদের জন্য এটা কোন কাজেই লাগবে না।
বিদ্যমান বিআরটি যাত্রীদের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে না বলে বিআরটি কোম্পানির পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
কোম্পানির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যাত্রীর চূড়ান্ত গন্তব্য বিমানবন্দর ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণ দিকে। যাত্রীদের চূড়ান্ত গন্তব্য পর্যন্ত সেবা না দিতে পারলে কোম্পানির ব্যবসা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এ অবস্থায় এমআরটি লাইন-৬ ও নগরীর অন্যান্য রুটের বাসগুলোর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে কোম্পানি সূত্র জানিয়েছে।