সেন্ট্রাল হাসপাতাল: শিখর থেকে পতন
মাতৃ ও শিশু সেবার জন্য ১৯৯৯ সাল থেকেই জনপ্রিয় ছিল রাজধানীর গ্রিনরোডে অবস্থিত প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এম আর খানের গড়ে তোলা সেন্ট্রাল হাসপাতাল। ২০১৬ সালে তার মৃত্যুর পর থেকে হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।
২০১৭ সাল থেকে একাধিকবার ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার অভিযোগ উঠে এক সময়ের জনপ্রিয় হাসপাতালটির বিরুদ্ধে; মামলা-হামলাও হয়েছে কয়েকবার।
সম্প্রতি প্রসূতি মা মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় আবারও আলোচনার কেন্দ্রে হাসপাতালটি। সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসা ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
হাসপাতালটি সেবার মানসিকতা থেকে সরে গিয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর আগের মান ফিরিয়ে আনতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালটির পরিচালনা পর্ষদ এখন দুই ভাগে বিভক্ত। পরিচালনা পর্সদের দ্বন্দ্ব ও অতি মুনাফার লোভে হাসপাতালটির সেবার মান নিচে নেমেছে।
এর আগে ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি ডা. এম আর খানের মেয়ে ডা. ম্যান্ডি করিম একটি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছিলেন, একটি ভেস্টেড কোয়ার্টার সেন্ট্রাল হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
তাকে হাসপাতালে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, এমনকি ভয়ও দেখানো হয়। যদিও তার বাবা এবং তার এই হাসপাতালে যথাক্রমে ৫৩,০০০ এবং ৯,০০০ শেয়ার আছে।
বর্তমানে হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদে ২২ জন সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে চারজন চিকিৎসক এবং ১৮ জনই ব্যবসায়ী ও অন্যান্য পেশাজীবী।
সেন্ট্রাল হাসপাতালে দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসকেরা রোগী দেখেন। চিকিৎসকদের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ব্যবসা করেছে হাসপাতালটি। রোগী টানতে চিকিৎসকেরা ফেসবুক লাইভ করতেন। এমনকি গোপনীয়তা রক্ষা না করেই একসঙ্গে অনেক রোগী দেখেন চিকিৎসকেরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সেন্ট্রাল হাসপাতালে আমার সন্তান জন্ম নিয়েছে। তাদের সেবার মান নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট ছিলাম না। প্রাইভেট হাসপাতালে আমরা যে ধরনের সার্ভিস চাই তারা সেভাবে দেয়না।"
বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) গভর্নিং বডির সদস্য ডা. নিরুপম দাস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সেবার তুলনায় প্রাইভেট হাসপাতালের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য সব সময় বেশি থাকে। যখন ডা. এম আর খান স্যার বেঁচে ছিলেন তখন সেন্ট্রাল হাসপাতালের সুনাম ছিল। এখন হাসপাতালটি অতি মুনাফার দিকে ঝুঁকছে। হাসপাতালটির নিজস্ব দালাল আছে। অনিয়ম মানতে না পেরে হাসপাতালটির পরিচালনা পর্ষদে এখন প্রতিষ্ঠাকালীন অনেক চিকিৎসক বের হয়ে গেছেন।"
বিগত কয়েক বছর ধরে সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার কয়েক দফা অভিযোগ উঠেছে।
২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগে সেন্ট্রাল হাসপাতালের পরিচালক গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। হাসপাতাল ভাংচুর করেছিলেন রোগীর স্বজনেরা।
২০১৮ সালে আবারও ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় ১৯ মাসের এক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় হাসপাতালে কর্মকর্তাদের উপর চড়াও হয় ও ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধ স্বজনরা।
দীর্ঘদিন ধরে সেন্ট্রাল হাসপাতালে রোগী দেখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ। তিনি টিবিএসকে বলেন, "ডাক্তার সংযুক্তা সাহা ও সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোন কমিউনিকেশন গ্যাপের কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এটির দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। সেন্ট্রাল হাসপাতালের এ ঘটনায় সাধারণ রোগীরা সেবাবঞ্চিত হচ্ছে।"
"দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালকে দায়ী করা যাবেনা। সেখানে অনেক ভালো ভালো চিকিৎসক সেবা দেন, সেবা নিয়ে সন্তুষ্টও রোগীরা," বলেন তিনি।
"মাঝে মাঝে হাসপাতালের সার্ভিস মনিটর করতে হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। কোন ঘটনা ঘটার পর সবকিছু খারাপ বললে তো হবেনা। পাশাপাশি ডাক্তারদেরও সচেতন হতে হবে," বলেন তিনি।
গত ৯ জুন রাত ১২টার দিকে প্রসব বেদনা উঠলে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে মাহবুবা রহমান আঁখিকে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সে সময় ডা. সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন না। তবুও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি আছেন এবং অপারেশন থিয়েটারে কাজ করছেন।
কয়েকবার চেষ্টার পর নরমাল ডেলিভারি না করানো গেলে হঠাৎ রাত সাড়ে তিনটার দিকে আঁখির সিজারিয়ান ডেলিভারি করা হয়। ডেলিভারির পর আইসিউতেই মারা যায় নবজাতক।
এ ঘটনার পর ১০ জুন আঁখিকে সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সেখানেই ১৮ জুন মারা যান তিনি।
এ ঘটনার পর গত ১৬ জুন সেন্ট্রাল হাসপাতালে অভিযান চালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে সময় হাসপাতালের আইসিইউ ও জরুরি সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় হাসপাতালটির অপারেশন থিয়েটার পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সেন্ট্রাল হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে এত প্রশ্ন উঠছে কেনো জানতে চাইলে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এম এ কাসেম দাবি করেন, হাসপাতাল সবসময় মানসম্মত সেবা দিয়ে থাকে।
তিনি টিবিএসকে আরো বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন হাতে না আসা পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে কথা না বলার পরামর্শ দিয়েছেন তাদের আইনজীবী।