আগ্রহ নেই বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের, চালু হয়নি মিল্ক ভিটার বন্ধ পড়ে থাকা কারখানাগুলো
বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ মিল্ক প্রডিউসারস কোঅপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেডের মালিকানাধীন দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের কোম্পানি মিল্ক ভিটা তাদের বন্ধ পড়ে থাকা ফ্যাক্টরিগুলো পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নিলেও, এতে সফলতার মুখ দেখেনি তারা।
দীর্ঘ ৮-১০ বছর ধরে পরিত্যাক্ত পড়ে থাকা মিল্ক ভিটার ইউএইচটি মিল্ক, কনডেন্সড মিল্ক ও পানি বোতলজাতকরণের কয়েকটি প্ল্যান্ট লাভজনক করতে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেও, দেড় বছরের বেশি সময়ে কোন বিনিয়োগ পায়নি কোম্পানিটি।
মিল্ক ভিটার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুরনো এই কারখানাগুলোকে পুনরায় সচল করতে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মিল্ক ভিটা। ২০২১ সালের শেষদিকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়।
এ বিজ্ঞাপন দেখে, আকিজ, বেঙ্গল, পারটেক্স, প্রাণ, একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান সহ বেশ আরও কিছু স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ও কয়েকজন উদ্যোক্তা প্রথমদিকেই বেশ আগ্রহ প্রকাশ করে। একেক প্রতিষ্ঠান আগ্রহ নিয়ে কারখানাগুলো পরিদর্শন করে তা নিয়ে স্টাডিও চালায়। কিন্তু বিনিয়োগ ও রিটার্নের পরিমাণ হিসেবে করে শেষ পর্যন্ত কেউই আর চূড়ান্ত বিনিয়োগে আগ্রহ দেখায়নি।
মিল্ক ভিটার ক্যান তৈরির প্লান্ট, কনডেন্সড মিল্ক প্ল্যান্ট এবং একটি ইউএইচটি মিল্ক প্ল্যান্টের অবস্থান সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি ঘাটে এবং দ্বিতীয় ইউএইচটি দুধ ও বোতলজাত পানির প্ল্যান্টের অবস্থান নরসিংদীর শিবপুরে।
মিল্ক ভিটার ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) ডা. মো. মাহফুজুল হক বলেন, "পুরাতন ও বন্ধ এই কারখানাগুলো চালু করে লোকসান কমিয়ে আয়ের জন্যই বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করেছিলাম। কয়েকটি বড় কোম্পানি কারখানা পরিদর্শনও করেছে, বিনিয়োগ করবে বলেও জানিয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত চুক্তিতে আসার মতো যেসব ডকুমেন্ট ও প্রপোজাল আমরা চেয়েছি তা নিয়ে এখনো কেউ আসেনি।"
মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (যুগ্ম সচিব) দীপঙ্কর মণ্ডল বলেন, "এখনো কোন প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তা এখানে চূড়ান্তভাবে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়নি। আমরা এখনো চাই বিনিয়োগ আসুক। কারণ বন্ধ কারখানাগুলোতেও আমাদের ব্যয় করতে হয়।"
মিল্ক ভিটার কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফ্যাক্টরি পরিদর্শনের পর একাধিক কোম্পানির সঙ্গে মিল্ক ভিটা বৈঠক করে। সেখানে আলোচনায় প্রফিট শেয়ারিং এর বিষয়ে প্রস্তাব করে মিল্ক ভিটা।
এছাড়া, পুরনো কোম্পানির মেশিনারিজের প্রয়োজনীয় মেরামত, প্রয়োজনে নতুন মেশিন স্থাপন করা, উৎপাদিত পণ্য 'মিল্ক ভিটা'র ব্র্যান্ড নামে বাজারজাত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে এই কারখানাগুলো থেকে খুব বেশি লাভ পাওয়া যাবে না বলেই কোম্পানিগুলো শেষ মুহুর্তে বিনিয়োগে আর আগ্রহ পায়নি।
দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপননকারী প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "জরাজীর্ণ মেশিনারিজ সমৃদ্ধ কারখানাগুলোতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও নিয়মিত খরচ করতে হবে সে তুলনায় রিটার্ন আসবে খুবই সামান্য। এ কারণে শেষ মুহূর্তে আর চূড়ান্ত বিনিয়োগের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়নি।"
বন্ধ পড়ে আছে যে কারখানাগুলো
দৈনিক এক লাখ লিটার দুধ প্রক্রিয়াজাত করার কর্মক্ষমতা রয়েছে মিল্ক ভিটার কনডেন্সড মিল্ক প্ল্যান্টের। এছাড়া তাদের তিনটি ইউএইচটি দুধ প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং ইউনিটের দৈনিক ক্ষমতা দুই লাখ লিটার।
চারটি কারখানাই প্রায় ৮-১০ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।
কোম্পানিটি বোতলজাত পানির ব্যবসায়ও আসার চেষ্টা করেছিল। সেই লক্ষ্যে চার বছর আগে নরসিংদীর শিবপুরে একটি কারখানা স্থাপন করা হয়। উৎপাদনে যাওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনলেও প্রশিক্ষিত শ্রমিক না থাকায় প্ল্যান্ট চালু করতে পারেনি তারা।
এক্ষেত্রে মিল্ক ভিটার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে আছে কোকা-কোলা, ইফাদ, পারটেক্স গ্রুপ, ট্রান্সকম, মেঘনা, একমি এবং প্রাণের মতো বড় প্রতিষ্ঠান। বোতলজাত পানির ব্যবসায় এসব কোম্পানি ভালোই করছে।
মিল্ক ভিটার ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মাহফুজুল হক বলেন, "উৎপাদন ক্ষমতার অভাবে আমরা কারখানা চালাতে পারিনি। ইউনিট স্থাপনে বিনিয়োগ করেও আমরা উৎপাদনে যেতে পারিনি।"
মিল্ক ভিটার বর্তমান ব্যবসা পরিস্থিতি
১৯৭৩ সালে কো-অপারেটিভ ম্যানেজমেন্টের অধীনে কার্যক্রম শুরু করে মিল্ক ভিটা। সারাদেশে তাদের ১১টি কারখানা রয়েছে এবং এগুলোর প্রতিটিতে একাধিক পণ্য তৈরির পৃথক প্ল্যান্ট রয়েছে।
কোম্পানিটি সারাদেশে কৃষক সমিতি দ্বারা পরিচালিত হয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকে।
মিল্ক ভিটা বর্তমানে ২২টি দুগ্ধজাত পণ্য যেমন দুধ, দই, রসগোল্লা, লাবাং, মাঠা, ফ্লেভারড মিল্ক, মাখন এবং ঘি তৈরি করে এবং বাজারজাত করে।
কোম্পানিটি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেড় কোটি টাকা মুনাফার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এর আগের দুই বছরে কোম্পানিটি দেড় কোটি টাকা করে মুনাফা অর্জন করে।
মিল্ক ভিটা বছরে প্রায় চার কোটি লিটার দুধ সংগ্রহ করে এবং দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করে। গত দুই বছরে কোম্পানিটি ৯৫ কোটি টাকার দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রি করেছে।
কোম্পানিটি প্রতিবছর বিনামূল্যে কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল ঘাসের বীজ, উন্নত জাতের গবাদি পশুর বীর্য এবং চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকে।
পাস্তুরিত দুধ সাব-সেক্টরের অন্যতম কোম্পানি মিল্ক ভিটা। আড়ং, প্রাণ, আকিজ, আফতাব এবং রংপুর ডেইরির মতো কোম্পানিগুলো এই বাজারে মিল্ক ভিটার প্রতিযোগী।
কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, মিল্ক ভিটা পণ্যের বিশাল বাজার রয়েছে। কিন্তু সরকার-চালিত কোম্পানি হওয়ায়, কোম্পানিটি তার প্রতিযোগীদের মতো সহজেই বিপণন কৌশল পরিবর্তন করতে পারেনা।