সরকারি ত্রাণ পৌঁছেনি, খাদ্য ও তীব্র পানীয় সংকটে বন্যাদুর্গতরা
ছয়দিনের টানা ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়াসহ তিন উপজেলায় খাদ্য ও পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পুরো এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্গত এলাকায় পৌঁছানো যায়নি সরকারি ত্রাণ ও খাদ্যসামগ্রী।
এমন দুর্যোগের সময়েও পাশে নেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। বন্যাকবলিত এলাকায় উদ্ধার অভিযান, ত্রাণ বিতরণ সহ দুর্যোগ মোকাবেলায় জনপ্রতিনিধিদের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ বন্যাদুর্গতরা।
স্থানীয়দের উদ্যোগে কয়েকটি এলাকায় নৌকায় করে রান্না করা খাবার পৌঁছে দিতে দেখা গেছে। তবে তীব্র স্রোতের কারণে ত্রাণ তৎপরতাও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ত্রাণ বিতরণ করতে আসা স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ত্রাণ ভাগ করে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
চন্দনাইশের দক্ষিণ হাশিমপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় ৫০টি পরিবার বিদ্যালয়টিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সাংবাদিক বা উৎসুক জনতাদের কেউ স্কুলটির কাছ দিয়ে গেলেই লোহার ফটকের ভেতর দিয়ে হাত পেতে দিচ্ছেন। ত্রাণ পেতে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হাশিমপুর এলাকায় ত্রাণের জন্য অপেক্ষায় থাকা সত্তরোর্ধ্ব জরিফা খাতুন বলেন, 'পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে গত সোমবার রাত থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। প্রথম দিন সঙ্গে করে নিয়ে আসা চাল, ডাল ও আলু দিয়ে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত খেয়েছি। রাত থেকে আজ (বুধবার) বিকাল পর্যন্ত চিড়া খেয়ে আছি, কোন ত্রাণ পাইনি। এমনকি কোন জনপ্রতিনিধি একবারের জন্য দেখতেও আসেনি।'
এখনো ত্রাণ পৌঁছায়নি এমন আরেকটি এলাকা সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের দুই নাম্বার ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ নাসির বলেন, 'চারদিন ধরে বাড়িঘর ডুবে রয়েছে। আশপাশের উঁচু ভবনগুলোতে কয়েকশ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় দেশ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছি।'
তিনি বলেন, 'যার ঘরে যা ছিলো তা দিয়ে দুইদিন খাওয়াদাওয়া করা গেছে। এখন সেই খাবারও প্রায় শেষ দিকে। অনেক কষ্টে পাড়ার দুইজনকে কেরানিহাটে পাঠিয়েও চাল-ডালের মত নিত্যপণ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে পানীয় জলের অভাব।নলকূপগুলো ডুবে গিয়েছে। বৃষ্টির পানি ছাড়া খাবার পানির আর কোনো উৎস নেই।'
এই বিষয়ে সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ মোতালেব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'জেলা প্রশাসন থেকে ১০ টন চাল বরাদ্দের খবর পেয়েছি, কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা সেই ত্রাণ এখনো হাতে পায়নি। আমার নিজের পক্ষ থেকে এক হাজার মানুষের জন্য দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করেছি।'
তবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও লোহাগাড়া উপজেলাসহ চট্টগ্রামে এখন প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী। এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের তিন উপজেলায় ১৯ লাখ ২৫ হাজার নগদ টাকা ৩৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরী সহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের জন্য ৫০০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
তবে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাকিব হাসান জানিয়েছেন, 'অতিরিক্ত পানির কারণে সাতকানিয়া এবং সীতাকুণ্ডে এখনো ত্রাণ পৌঁছানো যায়নি।'
সাতকানিয়া মহাসড়কের পাশে থাকা কয়েকটি এলাকার লোকজন কেরানিহাটের বিভিন্ন শপিং সেন্টার ও কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছেন। বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, কেরানির হাটের হক টাওয়ার, সিটি সেন্টার, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন শপিং সেন্টারে বন্যাদুর্গতরা আশ্রয় নিয়েছেন।
সিটি সেন্টারের ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বন্যাকবলিত বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন এবং মার্কেটটির গ্রাউন্ড ফ্লোরে অন্তত দুই শতাধিক গবাদিপশুর ঠাঁই হয়েছে।
কেরানিহাট এলাকার ন্যাশনাল টাওয়ারের একটি বেকারি শপ জেসি ফুড। দোকান মালিক জাহিদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, দু'দিন মার্কেটের নিচতলাটি পানিতে তলিয়ে ছিল। বুধবার পানি কমায় তিনি বিক্রি শুরু করেন। সকাল থেকে মাত্র তিন ঘণ্টায় বেকারির অধিকাংশ মালামাল বিক্রি হয়ে যায়।
কেরানিহাট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি জয়নাল মাস্টার বলেন, 'অন্তত দশটি মার্কেটের ৪০০টি দোকান এই মুহূর্তে পানিতে তলিয়ে আছে। বিশেষ করে যেসব দোকানগুলো মার্কেটের নিচতলায় অবস্থিত তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফলে ব্যাপক চাহিদা থাকার পরেও আমরা পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না। ইতোমধ্যেই ঔষধ খাবারের দোকান এবং নিত্যপণ্যের দোকানগুলোতে সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বোতলজাত পানির সংকট সময়ের সাথে সাথে তীব্র হচ্ছে।'
স্থানীয়দের উদ্যোগে কয়েকটি এলাকায় নৌকায় করে রান্না করা খাবার পৌঁছে দিতে দেখা গেছে। কিছু কিছু আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ পৌঁছালেও খুবই নগণ্য। বিশেষ করে উপজেলার চরতি, আমিলাইশ, নলুয়া ও কাঞ্চনা ইউনিয়নের বানভাসি মানুষগুলো খুব কষ্টে রয়েছেন। কারণ এসব এলাকার সড়কগুলোতে অতিরিক্ত পানি স্রোতের কারণে সেখানে পৌঁছাতে পারছে না কেউ।
এদিকে বন্যাকবলিত এলাকায় উদ্ধার অভিযান, ত্রাণ বিতরণসহ দুর্যোগ মোকাবেলায় জনপ্রতিনিধিদের অবহেলা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বন্যা দুর্গতরা। ত্রাণ বিতরণ করতে আসা স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ত্রাণ ভাগ করে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
পশ্চিম আমিলাইশ গ্রামের বাসিন্দা আহমদ হোসেন বলেন, "মঙ্গলবার দুপুর থেকে কোনোভাবে শুকনা খাবার খেয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে বেঁচে আছি। স্থানীয় একটি ফাউন্ডেশন থেকে দুপুরে খিচুড়ি দিয়েছে। কিন্তু সরকারি কিংবা জনপ্রতিনিধিদের এখনো দেখা মিলেনি।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) এর সংসদ সদস্য মোঃ নজরুল ইসলাম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "মূলত আমরা কখনো এমন বন্যা দেখিনি। পুরো এলাকাই বন্যার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে ত্রাণ তৎপরতা ওভাবে শুরু করা যায়নি।"
এদিকে টানা বর্ষণে সাতকানিয়া লোহাগাড়া এলাকায় লাখো মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করলেও তাদের পাশে দেখা যায়নি চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সংসদ সদস্য ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীকে। আগামী ১১ আগস্ট সকাল সাড়ে নয়টায় বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনের কথা জানান তিনি।
জানতে চাইলে আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী বলেন, "আমাদের নেতাকর্মীরা স্থানীয়দের পাশে থাকার চেষ্টা করছে।"