ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা, স্যালাইন সংকট এড়ানোর পথ খোঁজা হচ্ছে
দেশে অফ-সিজনে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকায় এ মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কায় বাড়তি ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইন সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
গত বছর দেশে ডেঙ্গু রোগে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ছিলো ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৭০৫ জন। ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইনের অভাবের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছিল।
এ বছর যাতে ফের স্যালাইন সংকট না হয়, সেজন্য স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ সম্প্রতি এক বৈঠকে ওষুধটির স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারি হাসপাতালে ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইনের মজুত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
বর্তমানে দেশে ছয়টি ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি এই আইভি ফ্লুইড বা স্যালাইন উৎপাদন করে। সরকার এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেডেরমাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে স্যালাইন সংগ্রহ করে থাকে।
বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, কৃত্রিম সংকট মোকাবেলা করতে চাহিদার চেয়ে বেশি স্যালাইন উৎপাদন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
তিনি জানান, এসেনশিয়াল ড্রাগের একটি স্যালাইন উৎপাদন ইউনিট গত ডিসেম্বরে চালু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটি চালু হয়নি। এখন প্রতিষ্ঠানটিকে এই ইউনিট আগামী জুনে চালু করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এরকম পরিস্থিতিতে প্রত্যেক হাসপাতালকে মেডিক্যাল অ্যান্ড সার্জিক্যাল ফান্ড ব্যবহার করে স্যালাইন কিনে মজুত করার নির্দেশনা দিয়েছেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম। এর পাশাপাশি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার চিকিৎসার জন্য প্লাজমা ও হিউম্যান অ্যালবুমিন আমদানি করা যায় কি না, তা যাচাই-বাছাই করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ওষুধ প্রশাসন বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
এসেনশিয়াল ড্রাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসানুল কবির সভায় জানান যে, কোম্পানিটি বেসরকারি ছয়টি কোম্পানি থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৩০ লাখ লিটার স্যালাইনের চাহিদার বিপরীতে ৫.৬৬ লাখ লিটার স্যালাইন সরকারি হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করেছে।
যদিও এই ছয়টি কোম্পানি এই সময়ে বাজারে ৫০ লাখ লিটার স্যালাইন সরবরাহ করেছে বলে জানান তিনি।
এ সময়ে এসেনশিয়াল ড্রাগ ভারত থেকে ২৩ লাখ লিটার স্যালাইন আমদানির অনুমোদনের বিপরীতে ১৩ লাখ লিটার স্যালাইন আমাদানি করেছে। বাকি চাহিদা দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে মেটানো যায় কি না, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) মইনুল আহসান সভায় জানান, ডেঙ্গুর পিক সময়ে দেশের হাসপাতালে প্রায় ১০ হাজার রোগী ভর্তি থাকে। প্রতিদিন ভর্তি রোগীর জন্য ওই সময় দৈনিক মাথাপিছু ২.৫ লিটার ফ্লুইড লাগলে প্রতি মাসে চাহিদা ৭.৫ লাখ লিটার থেকে ৮ লাখ লিটার।
সভায় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্মসচিব মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বলেন, ২০২৩ সালের ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২০২২ সালে ডেঙ্গু রোগীর মোট সংখ্যার চেয়ে বেশি ছিল। গত বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যাও ২০২২ সালের মৃত্যুর তুলনায় দ্বিগুণ ছিল। চলতি বছরের ২৪ মার্চ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করলে আইডি স্যালাইনের চাহিদা বেড়ে যায়। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছেছে, তখন দেশের কোনো কোনো স্থানে স্যালাইন পাওয়া যায়নি। আর যেসব জায়গায় স্যালাইন পাওয়া গেছে, সেখানেও চার থেকে পাঁচগুণ দামে কিনতে হয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। সাধারণত এসব স্যালাইনের দাম ১০০ টাকার কম।
মার্চ-অক্টোবরের পিক মৌসুমে ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইনের মাসিক চাহিদা প্রায় ৫০ লাখ লিটারে পৌঁছে যায় বলে জানান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। অফ-পিক মৌসুমে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে এ স্যালাইনের মাসিক চাহিদা প্রায় ৩০ লাখ লিটারে থাকে।
সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করছে না উৎপাদকরা
দেশে স্যালাইন উৎপাদনকারী ছয়টি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে: বেক্সিমকো ফার্মা, লিব্রা ইনফিউশন, ওরিয়ন ইনফিউশন, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস, একমি ল্যাবরেটরিজ ও অপসোনিন ফার্মা। এর বাইরে স্কয়ার ফার্মার স্যালাইন উৎপাকারী ইউনিট থাকলেও সেটি বন্ধ রয়েছে।
ওরিয়ন ইনফিউশনের সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল বাশার টিবিএসকে বলেন, বর্তমানে ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইন উৎপাদনকারীরা বিভিন্ন কারণে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, 'স্যালাইন ব্যাগ এবং অন্যান্য কাঁচামাল আমদানির জন্য ১০০ শতাংশ মার্জিনে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হয়। অন্যদিকে ডলারের দামও বেড়েছে। কিন্তু গত নয় বছরে স্যালাইনের দাম বাড়েনি। ফলে কোম্পানিগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না।'
খায়রুল বাশার আরও বলেন, 'এখন কোনো নতুন কোম্পানি স্যালাইন উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে আগ্রহী নয়।'
এজন্য বাজারে কৃত্রিম সংকট রোধ করতে চাহিদার তুলনায় বেশি স্যালাইন উৎপাদন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
কিন্তু দেশের স্যালাইন উৎপাদনকারি ছয় কোম্পানির কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী পণ্যটি পাওয়া যাচ্ছে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও প্রয়োজনীয় স্যালাইন আমদানি সম্ভব হচ্ছে না।