তাপপ্রবাহের প্রভাবে সরবরাহ সংকট: দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যের
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এতে চাপ বাড়ছে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর।
ব্যাবসায়ীরা বলছেন, গত মাসজুড়ে টানা তীব্র তাপপ্রবাহে পোল্ট্রি সেক্টরে মুরগি ও ডিমের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সবজির উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাবে বাজারে সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে এসব নিত্যপণ্যের।
শুক্রবার (১০ মে) রাজধানীর কয়েকটি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা পর্যায়ে ডিমের দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দামও অন্তত ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এছাড়া, বিভিন্ন সবজির দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ১০ থেকে ৩০ টাকা।
শাহজাদপুর, বাড্ডা, ফকিরাপুল ও কারওয়ানবাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা পর্যায়ে প্রতি ডজন বাদামি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকা। একদিন আগেও এ ডিম ১৩৫-১৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩৯-১৪০ টাকা। এছাড়া, ব্রয়লার মুরগি প্রতিকেজি ২২০-২৩০ টাকা এবং সোনালি মুরগি ৪০০-৪১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিডজন ডিমে ৩০ টাকা, ব্রয়লার কেজিতে ৩০ টাকা ও সোনালি মুরগির দাম কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা বেড়েছে।
এক সপ্তাহ আগে বাদামি ডিমের দাম ছিল প্রতি ডজন ১১৫-১২০ টাকা ও সাদা ডিমের ডজন ছিল ১০৫-১১০ টাকা। ব্রয়লারের দাম ছিল প্রতিকেজি ১৯০-২০০ টাকা এবং সোনালি মুরগির দাম ছিল ৩৫০-৩৬০ টাকা কেজি।
কারওয়ানবাজারের পাইকারি ডিম বিক্রেতা মো. সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "ডিমের দাম বাড়তির দিকে। এখন বাদামি ডিম ১৪০ টাকা ডজন বিক্রি করছি। আর সাদা ডিম ১৩০ টাকা ডজন। একদিনে ডজনে ৫ টাকা করে বেড়েছে।"
রাজধানীতে ডিমের অন্যতম বড় আড়ৎ তেজগাঁওয়ে। তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গতকাল প্রতি ১০০ বাদামি ডিমের পাইকারি দাম ছিল ১,০৯০ টাকা, যা দুইদিন আগেও ছিল ১,০৩০ টাকা। আর সাদা ডিম বিক্রি হয়েছে ১,০১০ টাকায়, দুইদিন আগে যার দাম ছিল ৯৭০ টাকা।
যদিও চলতি মাসের ২ তারিখে প্রতি ১০০ বাদামি ডিমের দাম ৮৮০ টাকা এবং সাদা ডিমের দাম ছিল ৮০০ টাকা ছিল।
ডিম ও মুরগির দাম বৃদ্ধির বিষয়ে মে মাসের তাপপ্রবাহের পাশাপাশি সিন্ডিকেশনকেও দায়ী করছেন প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "খামারগুলোতে ডিম মুরগির সংকট রয়েছে এখন। উৎপাদন স্বাভাবিক হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু তাই বলে দাম এতো বাড়ার কথা নয়। এখানে ঢাকার আড়ৎ থেকে ডিমের দাম ঠিক করে দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রান্তিক খামারিরা দাম বাড়লেও খুব বেশি সুফল পান না। সিন্ডিকেট টাকা হাতিয়ে নেয়।"
সবজির দাম কেজিতে ১৫-৩০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি
এদিকে, বাজারে প্রায় সব ধরনের সবজির দাম ঊর্ধ্বমুখী। কিছু সবজির দাম শতক ছুঁয়েছে।
প্রতিকেজি বেগুন মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৯০-১২০ টাকা দরে; পেপে ৯০-১০০ টাকা, কচুমুখী ১২০ টাকা ও বরবটি বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকায়।
এছাড়া ধুন্দুল, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, করলা ও ঢেঁড়শ প্রতিকেজি বাজারভেদে ৭০-৮০ টাকা, পটল ৬০ টাকা ও টমেটো ৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। আর প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের দাম এখন ১৬০ টাকা।
বাজারে সবজির সরবরাহ প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ কম জানিয়ে বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ৎ মালিক সমিতির সভাপতি মো. ইমরান মাস্টার টিবিএসকে বলেন, মে মাসজুড়ে তীব্র তাপপ্রবাহে সবজির উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
"সবজির ফুল ঝরে গেছে। যদিও এ সময় বাজারে ডাটা, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল— এসব সবজি প্রচুর আসার কথা। কিন্তু সরবরাহ কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই দাম একটু বেড়েছে," বলেন তিনি।
এদিকে, পেঁয়াজ ও আলুর দাম কেজিতে আরও ৫ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকায়। রাজধানীর কারওয়ানবাজারে গতকাল পাইকারিতে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬৬-৭০ টাকা দরে। আর ভারত থেকে আসা আমদানিকৃত পেঁয়াজ পাইকারিতে বিক্রি হয়েছে ৬৪-৬৬ টাকায়। অন্যদিকে, খুচরা পর্যায়ে আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৫৫-৬০ টাকা দরে।
সম্প্রতি ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলেও দাম বেশি থাকায় পুরোপুরিভাবে আমদানি শুরু করেননি ব্যবসায়ীরা। কারওয়ান বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মো. বাবুল মিয়া টিবিএসকে গতকাল বলেন, "ভারতের পেঁয়াজ আসছে না। গতকাল দুই ট্রাক আসছে কারওয়ানবাজারে। দাম দেশি পেঁয়াজের মতোই।"
গতকাল পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে পেঁয়াজের আড়তে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬০-৬২ টাকায়। আড়তে এখনো ভারতের পেঁয়াজ আসেনি। শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মাজেদ টিবিএসকে বলেন, "ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করলে ৪০ শতাংশ ট্যাক্স দেওয়ার পর তার দাম পড়ে যায় দেশি পেঁয়াজের চেয়েও বেশি। এ কারণে ব্যবসায়ীরা ভারতের পেঁয়াজ আমদানি করছেন না।"
চাপ বাড়ছে ভোক্তাদের ওপর
বাজারে ডিম, মুরগি ও সবজির মূল্য বৃদ্ধি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের ওপর চাপ তৈরি করছে। রাজধানীর বাড্ডায় বাজার করতে আসলে কথা হয় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মো. রায়হান হোসেনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, "আয়ের সাথে ব্যায়ের কোন হিসাব পাইনা। মাছ-মাংস সব সময় খাওয়া যায় না। কিছুটা কম দামের মধ্যে রয়েছে ডিম, মুরগি ও সবজি। এগুলোর দামও এখন আকাশচুম্বী। এক কেজি পেঁপের দাম ১০০ টাকা। সংসার চালানো এখন আসলেই অনেক চ্যালেঞ্জের।"
সার্বিক বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন টিবিএসকে বলেন, ডিম, মুরগি, সবজি— এগুলো মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের নিত্যদিনের খাবার। এর কোনো একটির দাম বাড়লেই জীবিকা নির্বাহে এসব মানুষকে চাপে পড়তে হয়।
"সবকিছুর দাম এখন বেশি। অপরাধীরা যখন বারবার অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই বেপরোয়া হয়ে পড়ে। বাজার এখন কিছু মানুষের হাতের মুঠোয় বন্দি। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখছি না। শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে না পারলে এমন অস্থিতিশীলতা চলতেই থাকবে," যোগ করেন তিনি।