শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরও গতিশীল করবে: গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
ঈদুল আজহার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পূর্ণাঙ্গ দ্বিপক্ষীয় ভারত সফরের মধ্য দিয়ে নতুন মেয়াদে দুই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের নতুন সূচনা হবে এবং আরও গতিশীল হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন দুই দেশের পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা।
শুক্রবার (১৪ জুন) এক গোলটেবিল বৈঠকে তারা বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন সারা বিশ্বের জন্য একটি উদাহরণ এবং এই সম্পর্কের সৌন্দর্য হলো ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মোকাবিলা করা।
ভোরের কাগজ সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় 'বাংলাদেশ ভারতের নতুন সরকার: সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের নতুন সূচনা' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে ছিলেন- সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব আনাম খান, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপনডেন্ট অব বাংলাদেশের (ডিক্যাব) সভাপতি নুরুল ইসলাম হাসিব, ঢাকা ট্রিবিউনের সিনিয়র রিপোর্টার শেখ শাহরিয়ার জামান এবং ভারত থেকে অনলাইনে যুক্ত হন প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ী, টেলিগ্রাফের হেড অব পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স দেবদীপ পুরোহিত।
শুক্রবার (১৪ জুন) সকালে রাজধানীতে ভোরের কাগজের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত এ বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, 'ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। দুই দেশের এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশ্বে দৃষ্টান্ত। দুই দেশের এই সম্পর্ক আরও নতুন উচ্চতায় এগিয়ে যাবে।'
তিনি আরও বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর ছাড়াও দ্বিপক্ষীয় সফর নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
গত ১৫ বছরের অর্জন তুলে ধরে শাহরিয়ার আলম বলেন, 'এই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমরা খুবই আনন্দিত।'
তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময়কার ৩৩ দফা যৌথ বিবৃতি ছিল, যেখানে ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সিইপিএ), জ্বালানি সহযোগিতা, জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ, বিস্তৃত সংযোগ এবং অন্যান্য বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফর এসব ক্ষেত্রে সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলে জানান শাহরিয়ার আলম।
যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) পরবর্তী বৈঠক শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ২০২২ সালের আগস্টে নয়াদিল্লিতে জেআরসির ৩৮তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে যেখানে পানি সম্পদ খাতে সহযোগিতা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত জেআরসি অভিন্ন নদী ব্যবস্থা থেকে সর্বাধিক সুবিধা অর্জনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক কার্যকর যৌথ প্রচেষ্টা নিশ্চিত করতে যোগাযোগ বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। জেআরসির নেতৃত্বে রয়েছেন দুই দেশের পানিসম্পদমন্ত্রী।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২১-২২ জুন অনুষ্ঠেয় দ্বিপক্ষীয় এই সফরে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক, চুক্তি সই রয়েছে হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া সহযোগিতার কয়েকটি ক্ষেত্র নিয়ে ঘোষণাও আসতে পারে।
উদ্বোধনী বক্তব্যে সঞ্চালক শ্যামল দত্ত বলেন, সম্পর্ককে আরও গভীর করতে দুই দেশের নতুন নির্বাচিত নেতৃত্বের ইচ্ছা রয়েছে।
দুই দেশের সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী ভারত সরকারের নতুন মেয়াদে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি দেখার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, 'আশা করছি আমাদের ন্যায্য হিস্যা পাব।'
এর আগে ২০২২ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের প্রাপ্ত পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য একটি সমীক্ষা পরিচালনার জন্য একটি যৌথ কারিগরি কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়েছেন দুই নেতা।
বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিবেশী এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে শমসের বলেন, '১৯৭১ সালে যদি আমরা রক্ত ভাগাভাগি করতে পারি, আমার বিশ্বাস আমরা পানি ভাগাভাগি করতে পারব।'
বৈঠকে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই উপনিবেশমুক্ত হওয়ার ফলে উপকৃত হচ্ছে এবং দুই দেশকে এগিয়ে যেতে থাকা এই সম্পর্কে নতুন মাত্রা আনতে হবে।
তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন কিছু আনতে হবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানি বণ্টন ও সীমান্ত হত্যা ইস্যুতে কথা বলে আসছি।'
জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মনের বিকাশের প্রয়োজন।
এ সময় 'তিস্তা রিভার কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট' প্রকল্পের কথা বলেন তিনি। এ প্রকল্পে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ধারণার বিষয়ে চীন আগ্রহ দেখিয়েছে।
একই প্রকল্পে ভারতের আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের বক্তব্যের কথাও উল্লেখ করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।
তিনি আরও বলেন, 'আমি মনে করি, সংঘাতের ভূ-রাজনীতিকে সহযোগিতার ভূ-রাজনীতিতে রূপান্তর সম্ভব। কারণ, বাণিজ্যসহ অনেক ক্ষেত্রেই চীনের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে।'
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমদ বলেন, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে নেতৃত্বের ভূমিকা নেওয়ার ইচ্ছা আছে ভারতের। এটি দেশটির জন্য সবাইকে একত্রিত করে নেতৃত্ব গ্রহণের একটি সুযোগ।
তিনি বলেন, 'তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি নাও থাকতে পারে, কিন্তু ব্যবহারের জন্য যা পাওয়া যায় তা ভাগ করে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে সমস্যা সেখানেই সমাধান খুঁজতে হবে।
তিস্তা প্রকল্প প্রসঙ্গে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, এটি চীনের নিজস্ব প্রস্তাব নয়, তবে বাংলাদেশের অনুরোধে তারা আগ্রহ দেখিয়েছেন।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক সাহাব বলেন, বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে বিশাল লাইন অব ক্রেডিটস (এলওসি) পাচ্ছে তবে এর বাস্তবায়ন ধীর গতিতে চলছে।
তিনি বলেন, 'বিশাল এলওসি আসছে, যা খুবই আকর্ষণীয়। টাকা তো আছেই। রাজনৈতিক অঙ্গীকারও তো আছে। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমি মনে করি দুটি দেশকে আরও বাস্তববাদী হতে হবে।'
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, চীনের প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি খুবই দ্রুত, এমনকি এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও খুব দ্রুত গতির। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ এবং চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার।
প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ী বলেন, দুই দেশ বহু বছর পর স্থলসীমানা সমস্যার সমাধান করেছে এবং তিস্তা বিষয়ে সমস্যার সমাধানও হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সিইপিএ নিয়ে আলোচনায় অগ্রসর হওয়া দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের সময় নষ্ট করা উচিত নয়। আমাদের দ্রুত এগোতে হবে।'
পানি ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগ প্রয়োজন এবং বন্যা এড়াতে যৌথভাবে তিস্তায় ড্রেজিংয়ের চেষ্টা করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন গৌতম।
তিনি বলেন, ভারত বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশ এমন কিছু করবে না যা ভারতের স্বার্থের ক্ষতি করতে পারে এবং বাংলাদেশের 'স্মার্ট বাংলাদেশ' হওয়ার লক্ষ্য পূরণে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন সফর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন গৌতম।
ভারতের টেলিগ্রাফের হেড অব পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স দেবদীপ পুরোহিত বলেন, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে দেখে। এরই মধ্যে ভারতের কাছে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন ৩৬০ ডিগ্রিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
তিস্তা নদীর জল ভাগাভাগির বিষয়ে দেবদীপ বলেন, দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে তিস্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন তিস্তার জল ভাগাভাগির কথা ওঠে, তখন প্রশ্ন আসে, সেচের লক্ষ্য কীভাবে পূরণ হবে। কারণ, শুকনা মৌসুমে তো নদীতে জল থাকে না। তিস্তায় পর্যাপ্ত জল না থাকায় দুই দেশ কীভাবে তিস্তাকে ব্যবহার করবে, তা নিয়ে নতুন ভাবনা-চিন্তা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, 'সব মিলিয়ে তিস্তাকে বাঁচাতে হবে। এ নিয়ে বিভিন্ন রকমের প্রস্তাবও আছে। চায়নাও প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতও প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ কার সঙ্গে যাবে এটা নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই।'
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের কথা উল্লেখ করে দেবদীপ পুরোহিত বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে এসে বিজেপির প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি, কংগ্রেস প্রধান সোনিয়া গান্ধী, রাজীব গান্ধী ও প্রিয়াংকা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছেন। সে সাক্ষাতের ছবি রাহুল গান্ধী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন। সেই ছবি ভীষণ ভাইরাল হয়েছে। এতেই বুঝা যায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় চলছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে বর্ণনা করে তিনি আরও বলেন, 'কলকাতার সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যরকম সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক পরের ধাপে নিতে আমাদের দৃঢ় বাস্তববাদী মনোভাব দরকার।