হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বয়ান ‘ভুয়া’ ছিল: রয়টার্সকে ড. ইউনূস
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বয়ান "ভুয়া" ছিল। বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি। হাসিনার দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন না করায় বিশ্ব সম্প্রদায়েরও সমালোচনা করেন তিনি।
১৫ বছরের শাসনকালে দেশের অর্থনীতি এবং বিশাল গার্মেন্টস শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য শেখ হাসিনা কৃতিত্ব নিয়েছিলেন। তবে সমালোচকরা তার বিরুদ্ধে বাকস্বাধীনতা ও ভিন্নমত দমনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন।
২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশকে শাসন করা শেখ হাসিনা বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, হত্যা, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগে তদন্তের সম্মুখীন। ঢাকার পক্ষ থেকে নয়া দিল্লি থেকে তাকে প্রত্যর্পণ করার আবেদন জানানো হয়েছে।
তবে, হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে, নয়াদিল্লি হাসিনার প্রত্যর্পণের আবেদন নিয়ে এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
ড. ইউনূস রয়টার্সকে বলেন, "তিনি (হাসিনা) দাভোসে সবাইকে দেশের শাসনব্যবস্থা কীভাবে চালাতে হয় তা বলেছিলেন। কেউ সেটি নিয়ে প্রশ্ন করেনি। এটি একেবারেই ভালো বিশ্বব্যবস্থা নয়।"
তিনি বলেন, "এটি ঘটানোর জন্য সম্পূর্ণ বিশ্বই দায়ী। সুতরাং এটি বিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।"
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "তিনি বলেছিলেন, আমরা প্রবৃদ্ধির দিক থেকে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছি– এটি একেবারে মিথ্যা।"
তিনি কেন ওই প্রবৃদ্ধিকে ভুয়া মনে করেন, সে বিষয়ে রয়টার্সকে বিস্তারিত কিছু না বললেও সকলের জন্য সমতাভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ওপর জোড় দিয়েছেন ড. ইউনূস। পাশাপাশি, সম্পদে অসমতা কমানোর প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে কোভিড মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ শতাংশে পৌঁছেছিল। তবে, ২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতায় আসার সময় প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৫ শতাংশ।
২০২৩ সালে বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, "১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে ২০১৫ সালে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।"
বাংলাদেশে ছাত্র নেতৃত্বাধীন আন্দোলনটি সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যমে শুরু হলেও, জুলাই মাসে সেটি সহিংস হয়ে ওঠে এবং ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। তবে হাসিনার সরকার আন্দোলন দমনে অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেছিল।
হাসিনার পতনের পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ইউনূসের নাম অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন। এই সরকারের কাজ ছিল, নতুন নির্বাচন আয়োজন করা।
২০২৫ সালের শেষে বা ২০২৬ সালের শুরুতে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া ইউনূস জানিয়েছেন, তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী নন।
"গরিবদের ব্যাংকার" হিসেবে পরিচিত ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার পেয়েছে, কারণ তারা গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ১০০ ডলারের কম ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনেন। সাধারণত, এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারত না।
রয়টার্সকে ড. ইউনূস বলেন, "আমি প্রবৃদ্ধির হারের জন্য খুব বেশি চালিত নই।" তিনি বলেন, "আমি সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষদের জীবনযাত্রার মান দ্বারা প্রভাবিত।। আমি এমন একটি অর্থনীতি চাই, যেটি সম্পদের কেন্দ্রীকরণ থেকে মুক্ত।"
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে শক্তিশালী বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক থাকলেও, হাসিনার পদত্যাগের পর এবং তিনি দিল্লিতে আশ্রয় নেওয়ার কারণে সম্পর্ক কিছুটা টানাপড়েন দেখা দিয়েছে।
ইউনূস ভারতের কাছে দাবি করেছেন, হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হোক, যাতে তিনি তার শাসনামলে করা অপরাধ এবং তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জন্য বিচারের সম্মুখীন হতে পারেন।
এই কঠিন সময়ে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি বন্ধু উল্লেখ করে ইউনূস রয়টার্সকে বলেন, দিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন "ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অনেক কষ্ট দেয়"। তিনি বলেন, "বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অবশ্যই সবচেয়ে শক্তিশালী হওয়া উচিত, কারণ বাংলাদেশের অংশ বাদ দিয়ে ভারতের মানচিত্র আঁকা যায় না।"