জলবায়ু পরিবর্তন, শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাবে চায়ের উৎপাদন ১ কোটি কেজি কমেছে
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/08/p_3-tea-production-declines.jpg)
২০২৩ সালে রেকর্ড ১০২.৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের পর ২০২৪ সালে এসে উৎপাদন নেমে এসেছে ৯৩.০৪ মিলিয়নে– যা আগের বছরের চাইতে প্রায় ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি কেজি কম।
২০২৩ সালে রেকর্ড উৎপাদনের পরের বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১০৮ মিলিয়ন। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনিয়মিত বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও অতিরিক্ত উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে চায়ের উৎপাদন কমে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ তো দূরের কথা– আগের বছরের চেয়ে উৎপাদন আরও কম হয়েছে বলে জানান চা বাগানিরা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সাম্প্রতিক শ্রমিক আন্দোলন।
বাগান মালিকদের মতে, বাংলাদেশের চা চাষ ও উৎপাদন প্রক্রিয়া অনেকটা প্রকৃতিনির্ভর। বর্ষা মৌসুমের জুন-অক্টোবর পর্যন্ত চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম। এ সময় সর্বোচ্চ পরিমাণ ও সবচেয়ে ভালো মানের চা উৎপাদন করে নিলামে বিক্রি করা হয়। চায়ের জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, পরিমিত ও নিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া প্রয়োজন। বিশেষত, রাতে বৃষ্টি ও দিনের সূর্যালোকের তাপ ভালো চা উৎপাদনে সহায়ক।
কিন্তু গত বছর গরমের তীব্রতার পাশাপাশি বৃষ্টিপাত ছিল অনিয়মিত। ফলে বাগানগুলো কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ চা উৎপাদন করতে পারেনি।
বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান তানভিরুর রহমান বলেন, "বৃষ্টিপাত হলেও চায়ের উৎপাদন আশানুরূপ হয়নি। গত বছর নিয়মিত বৃষ্টিপাতের পরিবর্তে স্বল্প সময়ে ভারি বৃষ্টিপাতের পরিমাণই ছিল বেশি। এ কারণে বাগানগুলোয় উৎপাদন কম হয়েছে।"
তবে, বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) ড. পীযূষ দত্ত চায়ের উৎপাদন কম হওয়ার আরও দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, শ্রমিক আন্দোলনের কারণে বেশ কিছু বাগানে চা আহরণ দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকা। দ্বিতীয়ত, উত্তরবঙ্গের বাগানগুলো থেকে আহরিত চায়ের মান উন্নয়ন।
তিনি বলেন, "চায়ে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মান উন্নয়নের ওপর নজর দিয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। এজন্য চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবন চলমান আছে।"
বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক একেএম রফিকুল হক বলেন, "১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা চা চাষের জন্য উপযোগী হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক অঞ্চলে বেশি তাপমাত্রা দেখা যাচ্ছে। খরার পাশাপাশি বাড়ছে কীটপতঙ্গের উপদ্রব। এতে চায়ের উৎপাদন কমছে।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে একদিকে যেমন গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে বৃষ্টিপাতের ধরনেও এসেছে পরিবর্তন। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে চায়ের উৎপাদন বাড়াতে জলবায়ু সহিষ্ণু ও উচ্চ ফলনশীল চায়ের জাত উদ্ভাবনের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি আবহাওয়ার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে উন্নত সেচ ব্যবস্থা ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন তারা।
নিলামের দাম বৃদ্ধি
এদিকে, উৎপাদন ঘাটতির প্রভাবে চায়ের নিলামে বেড়ে গেছে গড় দাম। ২০২৩-২৪ মৌসুমে যেখানে চায়ের গড় নিলাম দর ছিল ১৮৭ টাকা, ২০২৪-২৫ মৌসুমে সেই দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১০ টাকা।
তবে উৎপাদন কম হলেও ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে চায়ের রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে চা রপ্তানি হয়েছিল ১.০৪ মিলিয়ন কেজি। ২০২৪ সালে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৪৫ মিলিয়ন কেজি। গত বছরের বাড়তি উৎপাদন থেকে মজুদের কারণে এ বছর চা রপ্তানি বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
চা উৎপাদনে পিছিয়ে বাংলাদেশ
চা উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বলে দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদবিদ্যা ও চা উৎপাদন প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক এএফএম সাইফুল ইসলাম তার সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে বলেন, 'বাংলাদেশে প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে ১,৭৪০ কিলোগ্রাম চা উৎপাদিত হয়– যেখানে ভারতে হয় ২,৫০০ কেজি এবং শ্রীলঙ্কায় ৩,৩০০ কেজি।'
তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশের চা বাগানে গাছের তিন-চতুর্থাংশই কয়েক দশক, এমনকি শত বছর পুরোনো জাতের। এর গুণগত মান কম ও উৎপাদন অপ্রতুল।'
জলবায়ু-সহনশীল জাতগুলোতে বিনিয়োগের আহ্বান
এ সমস্যাগুলোকে আমলে নিয়ে, সাইফুল ইসলাম সরকারকে উচ্চ ফলনশীল, জলবায়ু-সহনশীল চায়ের জাতগুলোতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে বলেন, জলবায়ু-সহিঞ্চু গুণগত মানসম্পন্ন উচ্চ ফলনশীল চায়ের জাত উদ্ভাবনে মনযোগী হতে হবে।
তিনি বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খরার কারণে চা উৎপাদন বছরে ২১ থেকে ৩১ শতাংশ কমে যাচ্ছে। কীটের প্রাদুর্ভাবে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম হচ্ছে।"
তিনি জানান, ১৯৯০ সালে দেশে ৪৫.০৩ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল। তখন স্থানীয় চাহিদা ছিল ১৯.২১ মিলিয়ন কেজি। বাকি ২৫.৪০ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, "গত বছর দেশে ১০২ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়। তখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা ছিল ৯৫ মিলিয়ন কেজি। মাত্র ১.০৪ মিলিয়ন কেজি চা বিদেশে রপ্তানি হয়েছে।"
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চায়ের জন্য জার্মপ্লাজম সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। চারটি টেকসই চা গাছের জাত উদ্ভাবন করেছে তারা। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় চা গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিটিআরআই এখন পর্যন্ত ২৩টি জাত উদ্ভাবন করলেও বিটি২ ছাড়া অন্য জাতগুলো তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি।
সাইফুল ইসলাম জলবায়ুসহিঞ্চু গুণগত মানসম্পন্ন উচ্চ ফলনশীল চায়ের জাত উদ্ভাবনের জন্য বিটিআরআইয়ের বৈজ্ঞানিক গবেষণার লক্ষ্যে লোকবল ও সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও বিশেষায়িত বিভাগ, যেমন– চায়ের জেনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগ খোলার দাবি জানান।
বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান তানভিরুর রহমান বলেন, "সারের দাম, শ্রমিক সংকট, জমি নিয়ে বিরোধ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহে সমস্যা, ব্যাংক ঋণের প্রাপ্যতা না থাকা, পুরোনো যন্ত্রপাতি ও নিলাম নিয়ে বিরোধও এই শিল্পকে প্রভাবিত করছে।"
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় কৃত্রিম সেচ ও নতুন জলবায়ু পরিবর্তন-অনুযোজিত জাত এবং চাষীদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে বৃহত্তর পরিসরে উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।