স্থানীয় সরকার নাকি প্রথমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন?: দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিরোধ এখন এনিয়েই
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/13/feature-1_1_1.jpg)
স্থানীয় সরকার নির্বাচন কবে হবে— জাতীয় নির্বাচনের আগে নাকি পরে? এনিয়েই এখন গভীর এক মতভেদ দেখা দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। বিরোধী দুই শিবিরের নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত দুটি কমিশন— জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সুপারিশ দিয়েছে। যেকারণে এনিয়ে বিতর্কের পাল্লা আরও ভারী হয়েছে।
এই অবস্থায়, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আগামী দিনগুলোয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় নিয়ে রাজনীতিতে উত্তাপ আরও বাড়বে।
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগই এখন দেশ ছেড়েছেন, নাহলে দেশে আত্মগোপনে আছেন। এই প্রেক্ষাপটে, একমাত্র বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে বিএনপি। দলটি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার বা অন্য যেকোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানের কথা বার বার বলছে।
অন্যদিকে, বিএনপির সাবেক রাজনৈতিক জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী নিজেদের বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরছে রাজনীতির ময়দানে। হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে যা এক নতুন অধ্যায়। জামায়াত সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনই চাইছে।
এনিয়ে আজ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জামায়াতের ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, "জনগণ চায় স্থানীয় সরকার সচল হোক। আমরাও চাই জাতীয় নির্বাচনের আগে— স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক।"
এদিন দুপুরে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হবে, ততই রাজনীতি সহজ হবে, বাংলাদেশের মানুষ স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে আসবে।
বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, নির্বাচনটা হওয়া দ্রুত দরকার প্রধানত দুটি কারণে। একটি হচ্ছে, বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসা, অন্যটি সুশাসন চালু করা।
নির্বাচন কমিশনও (ইসি) ইতোমধ্যে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে, এই অবস্থায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়ছে বলেই মনে হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দলের এক কর্মশালায় সরকারকে সতর্ক করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন হবে না। "আমরা ১৭ বছর আন্দোলন করেছি, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার দাবিতে। অন্য কোনো নির্বাচনের জন্য নয়।"
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ঘোষণা দিলে আওয়ামী লীগ মাথা বের করে হাজির হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না। "নির্বাচন বানচালের কোনো ষড়যন্ত্র না থাকলে, আমরা আশা করি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।"
এর মাত্র দুদিন আগেই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এক বৈঠকের পরে মির্জা আব্বাস বলেছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে সরকার আমাদের আশ্বস্ত করেছে। এসময় তিনি আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন মেনে নেবে না বিএনপি।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনার সময় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি উঠে আসে। "এবিষয়ে সব দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে"- বলে জানান তিনি।
এদিকে এই মাসের শুরুতে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের কাছে ১৬টি সুপারিশ জমা দেয় জাতীয় নাগরিক কমিটি। এরমধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার তাগিদও রয়েছে।
এর আগে গত বছরের নভেম্বরে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মতামত দেওয়া হচ্ছে, কারণ স্থানীয় নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা আরও বাড়বে।
জনগণ কী চাইছেন?
গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, এতে অংশগ্রহণকারীদের ৬৫ শতাংশই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছেন।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অনুরোধে, নির্বাচনি সংস্কারগুলোর বিষয়ে এই জাতীয় জনমত জরিপ পরিচালনা করে বিবিএস।
কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন ও এ সংক্রান্ত বিষয়ে মানুষের মনোভাব বুঝতেই এ জরিপ পরিচালিত হয়। বর্তমানে আমাদের কোনো ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় সরকারের কর্তৃপক্ষ নেই, যেকারণে জনগণ জরুরি বিভিন্ন সেবা-বঞ্চিত হচ্ছে।
সংস্কার নিয়েও বিভেদ?
জাতীয় নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ কতোটা হবে— এনিয়েও বড় দুই দলের মধ্যে বিভেদ দেখা যাচ্ছে।
'ন্যূনতম সংস্কার' করেই জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছে বিএনপি, অন্যদিকে জামায়াত চাইছে নির্বাচনের আগে আরও সংস্কার।
এই অবস্থায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। ছয় সংস্কার কমিশনের দেওয়া সুপারিশগুলো বিবেচনা ও গ্রহণের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে, এবং এ বিষয়ে পদক্ষেপের সুপারিশ করবে এই কমিশন।
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করবে, আগামী ছয় মাস কমিশনের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে, জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন— রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পুলিশের কার্যক্রমসহ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য পদক্ষেপের সুপারিশ করবে।