যে রাজনীতি খুনি বানিয়েছে জিয়নকে
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেছে ঢাকার একটি আদালত। আজ বুধবার (৮ ডিসেম্বর) দেওয়া এই রায়ে ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে একজন হলেন মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন। বুয়েটের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র তিনি।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের শোঠিবাড়ি ধলারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা জিয়ন। পরিবারে তিন ভাইবোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। তার বড় ভাই ছিলেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ছাত্র। বর্তমানে তিনি কমিউনিটি মেডিকেল কলেজে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। জিয়নের ছোট বোন জেরিন রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী।
জিয়নের বাবা পেশায় একজন মুদি ব্যবসায়ী। স্কুলজীবন থেকেই পড়াশোনায় ভাল ছাত্র জিয়ন বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে; স্বপ্ন দেখতেন তার বাবা-মা।
বড় মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর ২০১৩ সালে নটরডেম কলেজে ভর্তি হন তিনি।
তার লেখাপড়ার খরচ মূলত চালাতেন তার বাবা-ই। এমনকি আবরার হত্যার ছয় মাস আগে তাকে একটি মোটরসাইকেলও কিনে দেন তিনি।
আশেপাশের সবাই জিয়নকে ভদ্র ছেলে হিসেবে জানলেও বুয়েটে যোগদানের পর তার আচরণগত পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাঁচ-ছয় মাস আগে তার পরিবার জানতে পারে, জিয়ন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক (বুয়েট ইউনিট) ছিলেন তিনি।
জিয়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে তার চাচা সেলিম বলেন, সে ছোটবেলা থেকেই সে একজন ভালো ছাত্র। বুয়েটে ভর্তির পর ছুটি পেলেই ৮-১০ দিনের জন্য বাড়িতে আসতেন তিনি।
তার চাচা আরও বলেন, "পাঁচ-ছয় মাস আগে আমরা শুনেছিলাম সে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছে। তারপর থেকে আমরা তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি।"
প্রতিবশী হাজিফুর রহমান বলেন, "শৈশব থেকেই জিয়ন ভদ্র ছিল। সে খুব কমই বাড়ির বাইরে আসতো। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর সে ঠিক কী করেছে তা আমরা জানি না।"
এছাড়া, এলাকার চা-বিক্রেতা আব্দুল হাকিম বলেন, "ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরলেই সে আমার দোকানে আসতো। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতো না। চা শেষ করার সাথে সাথেই চলে যেত সে।"
জিয়নের এলাকার অন্যান্য স্থানীয় লোকজন বলেন, তার পরিবার একটি সাধারণ জীবনযাপন করে এবং তার বাবা সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত নন।
এদিকে সাঠিবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরেন্দ্রনাথ সাহা বলেন, "মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন সিজিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে। তার শিক্ষকরা তাকে একজন ভালো ছাত্র এবং ভদ্র কিশোর হিসেবেই জানতেন। আমরা তার মধ্যে কোনো উচ্ছৃঙ্খল মনোভাব লক্ষ্য করিনি আমরা। বুয়েটে ভর্তির পর সে কী করেছে তা আমরা জানি না।"
দুর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান জানান, "জিয়নের বাবা একসময় জাতীয় পার্টিকে সমর্থন করতেন, পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল। দলের কোনো পদে বহাল না থাকলেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন তিনি।"
তিনি আরো বলেন, আবরার হত্যায় জিয়নের জড়িত থাকার কথা তিনি শুনেছেন এবং দোষী প্রমাণিত হলে জিয়নের শাস্তি হওয়া উচিত।
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জের ধরে আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের নিচতলা ও দোতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহত আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
পরদিন ৭ অক্টোবর আবরারের বাবা চকবাজার থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন।
মামলাটি তদন্ত করে বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
এরপর গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ২৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হয়।