এবারও পুরান ঢাকায় ব্যাপক উদ্দীপনায় সাকরাইন উদযাপিত
পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসব বাংলাদেশের প্রাচীন উৎসবগুলোর একটি। এটি মূলত পৌষসংক্রান্তি; তবে ঘুড়ি উৎসব নামেও পরিচিত। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ১৪ জানুয়ারি পুরান ঢাকায় সাকরাইন উৎসব সার্বজনীন ঢাকার উৎসবে রূপ নেয়।
চারশো বছরের ঐতিহ্যের ধারায় এবারও সারাদিন ঘুড়ি ওড়ানো, একে অপরের ঘুড়ি কাটাকাটি, বাড়িঘর, ছাদে জমকালো আলোকসজ্জা, আগুন নিয়ে খেলা, সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজিতে ছেয়ে যায় পুরান ঢাকার আকাশ। তবে এবার প্রশাসনের বিধিনিষেধের কারণে তুলনামূলক কম ফানুস উড়াতে দেখা গেছে।
পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতিবাজার, কলতাবাজার, শিংটোলা, কাগজিটোলা, সূত্রাপুর, লক্ষীবাজার, বাংলাবাজার, ফরাশগঞ্জ, বানিয়ানগর, আইজি গেট, আরসিন গেট, গেন্ডারিয়া প্রভৃতি এলাকা ঘুরে দেখা যায় সাকরাইনের দিনে যেন পুরান ঢাকা নতুন প্রাণ পেয়েছে।
মোহাম্মদ আলম, মোস্তপা জামান, মেহেদী, আশিক- এই চার যুবক সূত্রাপুর এলাকায় ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করেন।
মোহাম্মদ আলম (৩৭) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বুঝ হওয়ার পর থেকে প্রতি বছরই এই ঘুড়ি উড়াইছি, ছোট্ট বেলায় ১৩ বছর বয়সে ঘুড়ি উড়াতে যেয়ে আমি বৈদ্যুৎতিক শকও খেয়েছিলাম, তারপরও এই উৎসব বাদ দেইনি জন্মের পর থেকে।"
৭ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী, আনুস ইসলাম আদিল বলেন, "আজকে আমার আনন্দের দিন, আজকে আমি ১১টা ঘুড়ি কেটেছি,আর আমার কাটা পরেছে মাত্র ৪টি, আমার আরও তিনটা ঘুড়ি আছে এখনো।"
সূত্রাপুর ঘুড়ি উড়ানো উদযাপন কমিটির সভাপতি আরেফিন সান্জু (৪০) টিবিএসকে বলেন, "মেয়র তাপস সাহেব করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় এবার সরকারিভাবে একটু কম উদযাপন হচ্ছে, আমরা নিজেরাই অর্থ দিয়ে সাউন্ড সিস্টেম ভাড়াসহ বিভিন্ন আয়োজন করেছি। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে আমাদের পুরান ঢাকার ৭৫টি ওয়ার্ডে ১০০ করে ঘুড়ি দিয়েছে।"
পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারের বাসিন্দা সমীর সেন (৪০) বাসার ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছিলেন। তিনি বলেন, "এই দিনটা আমাদের পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য খুবই আনন্দের। এই দিনে আমরা ঘুড়ি উৎসব করি, ফানুস উড়াই, আগুন মুখে নিয়ে খেলি, আমাদের মা-বোনেরা বাসায় পিঠাপুলিসহ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার বানায়।"
শাঁখারিবাজারে গত ৫ বছর যাবত ঘুড়ি বিক্রি করেন দিলীপ নাথ (৫৯)। তিনি বলেন, "গত বছর থেকে এবছর বেশি ঘুড়ি বিক্রি হচ্ছে, গতকাল ও আজকে মিলে ২ হাজার ঘুড়ি বিক্রি করেছি , ২০০টির অধিক নাটাই বিক্রি করেছি। গত বছর এ সময়ে এর অর্ধেক বিক্রি হয়েছিল, আশা করি এবছর সব মিলিয়ে ১০ হাজার ঘুড়ি বিক্রি করতে পারবো।"
সর্বজনীন ঢাকাইয়া উৎসবে রূপ নেয়া এ উৎসব উদযাপনের ধরনে এসেছে পরিবর্তন। তাছাড়া এ বছরের আয়োজনেও করোনার প্রভাব কিছুটা থাকছে।
"করোনার জন্য অনেক পরিবারের কিছুটা অর্থনৈতিক সংকট চলছে। আমরা মহল্লার সিনিয়র-জুনিয়র সবাই মিলে প্রায় ২০ হাজার টাকা সংগ্রহ করেছি, তাছাড়া এবার চাঁদা সংগ্রহের হারও অনেক কম, নয়তো এবছর আরো বড় সাকরাইন উৎসবের আয়োজন করতে পারতাম," বলেন তাঁতিবাজার এলাকার মোঃ ওয়ালিদ ফাহিম।
থার্টি ফার্স্ট নাইটে ফানুস ও আতশবাজি থেকে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে।
তবে বিধিনিষেধ থাকলেও পুরান ঢাকাবাসীর প্রাণের এই উৎসবের জন্য এ বছরেও শুরু থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল আয়োজকদের।
সাকরাইনের আয়োজন মূলত দুই দিনব্যাপী- ১৪ এবং ১৫ জানুয়ারি। সাধারণত ১৪ জানুয়ারিতেই সাকরাইন পালন করতে দেখা যায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পঞ্জিকা অনুসারে পরদিন ১৫ জানুয়ারি পালন করে থাকে ।
এদিকে পুরান ঢাকার সাকরাইনকে কেন্দ্র ঢাকার অন্যান্য এলাকায় বহু মানুষ আসেন উৎসবকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে। ফলে গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন থাকলেও উৎসবের লোকসমাগমে পুরান ঢাকার অলিগলিতে ছিল যানজট।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা নুসরাত জাহান মিষ্টি সাকরাইন উৎসবে যোগ দিতে বান্ধবীদের সাথে তাঁতিবাজার এলাকায় আসেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, "আমি আর কখনো সাকরাইন উৎসব দেখিনি। বান্ধবীর মুখ থেকে এই উৎসবের কথা শুনে আজ তার বাসায় এসেছি, আমি খুবই আনন্দিত এবং উৎফুল্লতা বোধ করছি।"