মানা হচ্ছে না বিধিনিষেধ, জনগণকে সম্পৃক্ত করার আহবান বিশেষজ্ঞদের
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করেছে সরকার। বিধিনিষেধ অনুযায়ী রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে ভ্যাকসিন কার্ড দেখানো, গণপরিবহন, জনসমাগম স্থলে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার বিধান থাকলেও মানা হচ্ছে না কিছুই। বিধিনিষেধ না মানলে দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বিধিনিষেধ কার্যকর করতে জনগণকে সম্পৃক্ত করার আহবান বিশেষজ্ঞদের।
১৩ জানুয়ারি জারি করা বিধিনিষেধের তৃতীয় দিন শনিবার রাজধানীর মগবাজার, শাহবাগ, মৎস্যভবনের সামনে ঘুরে দেখা যায়, বাসে অধিকাংশ যাত্রীর মাস্ক থাকলেও তা সঠিকভাবে পরছেন না অনেকেই। প্রায় প্রতিটি গাড়ির চালক-সহকারীর মাস্ক থুতনিতে ঝুলছে। কিছু যাত্রী মাস্ক ছাড়াই বসে রয়েছেন। হোটেলগুলোতে দেখা হচ্ছে না ভ্যাকসিন কার্ড।
"গাড়িতে ডিউটি করলে সব সময় মাস্ক পরে থাকা যায় না। দম বন্ধ হয়ে আসে", বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ কথা বলেন গুলিস্তান থেকে গাজীপুর রুটে চলাচলকারী গাজীপুর পরিবহনের হেলপার মোহাম্মদ সজিব। তবে থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে রাখলেও সজিব তার টিকাকার্ড সাথে রাখেন। তিনি বলেন, "কার্ড সাথে রাখি আর পুলিশ দেখলে মাস্ক পরি।"
মঞ্জুর হোসাইন নামের এক যাত্রী বলেন, "মাত্রই মাস্ক খুলে রাখলাম। বাসের ভেতর বেশিক্ষণ মাস্ক পরে থাকা যায় না।"
মাস্ক পরার মত উপেক্ষিত ভ্যাকসিন কার্ড দেখানোর বিধিনিষেধও।
মগবাজার বাসস্ট্যান্ডের নিউ স্টার হোটেলে বেলা ১১টায় দেখা যায় টেবিলে পাশাপাশি চেয়ারে ৪ জন বসে গায়ে গায়ে লেগে খাচ্ছেন। লোকজন অনায়াসে আসছে, খেয়ে চলে যাচ্ছে। কারো টিকার সনদ দেখা হয়নি।
হোটেলের ক্যাশিয়ার মোহম্মদ মহিবুরের মাস্ক থুতনিতে ছিল। তিনি বলেন, "দুই-একজন টিকা কার্ড দেখিয়ে খেয়েছে। তবে যার নেই, তাকেও খাবার দিচ্ছি আমরা। এটা পুরোপুরি মানা সম্ভব নয়। আমরা কীভাবে কাস্টমারকে বলবো টিকা কার্ড দেখান।"
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান টিবিএসকে বলেন, "আমরা নির্দেশনা দিয়েছি রেস্তোরাঁয় যারা কাজ করবে তাদের যেন টিকা সনদ থাকে। আর ক্রেতাদের যাদের টিকা কার্ড থাকবে না তাদের বোঝানোর জন্য বলা হয়েছে যে, তাদের খেতে দিলে রেস্তোরাঁ মালিক বিপদে পরবে। এখন ক্রেতা যদি না মানে সেক্ষেত্রে তো জোর করতে পারবো না।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিধিনিষেধের কিছু কিছু পয়েন্ট বিজ্ঞানভিত্তিক হলেও বাস্তবায়ন করা কঠিন। বড় বড় রেস্টুরেন্টে ভ্যাকসিন কার্ড নিশ্চিত করা গেলেও ছোট রেস্টুরেন্ট বা স্ট্রিট ফুডের দোকানে সেটি নিশ্চিত করা যাবে না। আর দেশের ৫০% মানুষ এখন পর্যন্ত এক ডোজ ভ্যাকসিনও পায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, দেশে এখন পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার ৩২.৩৩% দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছে; এক ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে ৪৮.৩১% মানুষ।
ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুজাহেরুল হক বলেন, "মানুষকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করা যাবে না। ডব্লিউএইচও এর পরামর্শ অনুযায়ী কোভিড মোকিাবেলায় সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সরকার সচেতনতা তৈরীতে কাজ করছে কিন্তু খুব মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারছেনা।"
অধ্যাপক মুজাহেরুল হক বলেন, "সংক্রমণ মোকাবেলায় সরকারকে প্রতিটি ওয়ার্ডের সব মানুষকে তিন স্তরের পুনর্ব্যবহারযোগ্য দুটি করে মাস্ক দিতে হবে। তারপর কেউ মাস্ক পরতে না চাইলে তাকে এবং ওয়ার্ড কমিশনারকে জরিমানা করতে হবে। সব মানুষ মাস্ক পরলে সংক্রমণ ছড়াবেনা, তখন ভ্যাকসিনের দরকার হবে না। একজন মানুষকে তিন ডোজ ভ্যাকসিন দিতে যে খরচ হয় তার চেয়ে দুটি মাস্ক দিলে খরচ অনেক কম হবে।"
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. এম মুশতাক হোসেন টিবিএসকে বলেন, "প্রতি সপ্তাহে সংক্রমণ আগের সপ্তাহের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেড়ে যাচ্ছে। তাই সংক্রমণ মোকাবেলায় বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করা না গেলে অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় সংক্রমণের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনগুলো বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।"
তিনি বলেন, "আমাদের দেশে রেড ক্রিসেন্ট, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) প্রভৃতি মানুষকে সম্পৃক্ত করতে কাজ করে। তাদের কাজে লাগিয়ে কোভিড মোকাবেলায় জনগণকে সম্পৃক্ত করা গেলে কোভিড শেষ হলেও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা স্বাস্থ্য সমস্যা নির্মূলে এই পদক্ষেপ কাজে দিবে।"
স্বাস্থ্যবিধি না মানলে লকডাউনের চিন্তা: জাহিদ মালেক
কোভিড-১৯ এবং এর নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সরকার ঘোষিত ১১ দফা বিধিনিষেধ যথাযথভাবে অনুসরণ করা না হলে দেশে লকডাউন দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, "আমরা মাত্রই ১১ দফার একটি কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েছি। আমরা জনসাধারণকে এই নির্দেশনা মানতে আহবান করব। এই নির্দেশনা মানলে দেশে লকডাউনের প্রয়োজন হবে না। কারণ লকডাউন দিলে দেশের ক্ষতি, মানুষের ক্ষতি। নির্দেশনা না মানলেই লকডাউন দেয়ার চিন্তা রয়েছে।"