দেশের ইতিহাসে চা উৎপাদনে রেকর্ড
কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও গেল বছর দেশে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদিত হয়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে ৯৬.৫০৬ মিলিয়ন কেজি (৯.৬ কোটি কেজি) চা উৎপাদিত হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
মহামারিকালীন সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশে বিভিন্ন শস্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও, চা উৎপাদন খাত ছিল ব্যতিক্রম। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ৯.১১৬ মিলিয়ন কেজি চা বেশি উপাদন হয়েছে দেশে। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে ১৬৭ বছরের চা চাষের ইতিহাসে উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ডও এটি।
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানের মাধ্যমে এই অঞ্চলে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয়। চা চাষ শুরুর পর থেকে এতদিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ পরিমাণ চা উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ২০১৯ সালে ৯৬.৭ মিলিয়ন কেজি। তবে, ২০১৮ সালে উৎপাদন কমে ৮২.১৩ মিলিয়ন কেজিতে গিয়ে ঠেকে; একইভাবে ২০১৭ সালে চায়ের উৎপাদন ছিল ৭৮.৯৫ কেজি।
বাগানমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চা উৎপাদনে রেকর্ড সাফল্যের পিছনে রয়েছে গত এক দশকে সরকার ও বাগানমালিকদের নেওয়া নানামুখী পদক্ষেপ। উত্তরাঞ্চলে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবানে চা চাষের পরিধি বাড়ছে। পরিত্যক্ত বাগান চা চাষের আওতায় এসেছে। কয়েক বছর ভালো দাম পাওয়ায় বাগানমালিকেরাও নতুন নতুন বিনিয়োগ করেছেন। বাগানে প্রযুক্তির ব্যবহারও বেড়েছে।
২০২৫ সালে ১৪ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ড।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মোঃ আশরাফুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কোভিড পরিস্থিতিতেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশের সকল চা বাগানের সার্বিক কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল। সরকারের আর্থিক প্রণোদনা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ চা বোর্ডের নিয়মিত মনিটরিং ও পরামর্শ প্রদান, বাগান মালিক ও শ্রমিকদের নিরলস প্রচেষ্টা, সঠিক সময়ে ভর্তুকি মূল্যে সার বিতরণ, স্বাস্থ্য বিধি মেনে চা নিলাম কেন্দ্র চালু রাখা, চা শ্রমিকদের মজুরি, রেশন এবং স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণের ফলে ২০২১ সালে দেশের চা উৎপাদন অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে।"
তিনি জানান, উত্তরাঞ্চলে চা চাষীদের 'ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুলে'র মাধ্যমে চা আবাদ বিষয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহের ফলে শুধুমাত্র সমতলের চা বাগান ও ক্ষুদ্র চা চাষ থেকে ২০২১ সালে এর আগের বছরের তুলনায় ৪১ শতাংশ চা বেশি উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
চা বাগানমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের সভাপতি শাহ আলম টিবিএসকে বলেন, "চা বাগানে কয়েক বছর ধরেই সংস্কার কার্যক্রম চলছে। পুরোনো চারা উঠিয়ে নতুন চারা লাগানো হয়েছে। দেশের বাগানগুলো চা উৎপাদনে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এগিয়ে গেছে।"
এছাড়া, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ছাড়াও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে প্রতি বছরই চা উৎপাদন বাড়ছে; সেইসঙ্গে বাগানমালিকেরা এইখাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ করছে বলে জানান তিনি।
উৎপাদন বৃদ্ধির এই প্রবণতা বজায় থাকলে বিদেশ থেকে আর বড় আকারের আমদানি করতে হবে নাও বলেও আশা প্রকাশ করেন শাহ আলম।
দেশে চায়ের বার্ষিক চাহিদা প্রায় সাড়ে নয় কোটি কেজি। তবে, করোনাকালের চাহিদা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসায় বড় ধরনের লোকসান গুণেছেন বাগান মালিকরা। লোকসান কাটিয়ে উঠতে সরকারি প্রণোদনা ছাড়াও নিজ উদ্যোগে নতুন বিনিয়োগে যেতে হচ্ছে তাদের। এছাড়া, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো, রেশনের ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা অর্জন করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি করেছে বাগানগুলো।
আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ ও অবৈধ চা প্রবেশ বন্ধ হলে দেশের চা খাত নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা করছেন বাগান মালিকরা।