‘বৈশ্বিক আরএনডির সংমিশ্রণে প্রযুক্তি খাতে বড় পরিবর্তন আনবে ফেয়ার গ্রুপ’
বিশ্বের ১ নম্বর মুঠোফোন ব্র্যান্ড স্যামসাংয়ের ফোন সংযোজনের কারখানা করেছে ফেয়ার ইলেকট্রনিকস। কারখানাটিতে মুঠোফোনের পাশাপাশি ফ্রিজ, টেলিভিশন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ (এসি) মাইক্রোওয়েভ ওভেনও তৈরি হচ্ছে।
সম্প্রতি কোরিয়ান অটোমোবাইল জায়ান্ট হুন্দাইয়ের গাড়ি উৎপাদনে প্ল্যান্ট স্থাপন শুরু করেছে ফেয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ফেয়ার টেকনোলজিস।
এখনো নিজস্ব আরএনডি (গবেষণা ও উন্নয়ন) গড়ে না ওঠা ফেয়ার গ্রুপ এটিকে বলছে বৈশ্বিক আরএনডির মিশ্রনে দেশে দক্ষ জনবল তৈরি ও বড় ব্র্যান্ডকে সহলভ্য করার সুযোগ। দেশে প্রযুক্তি খাতে বড় পরিবর্তনে এটিকে বড় সুযোগ বলেও মনে করছে তারা।
সম্প্রতি স্যামসাংয়ের আরএনডি এবং ফেয়ার গ্রুপের ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেন ফেয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান রুহুল আলম আল মাহবুব।
নিজেদের আরএনডি ছাড়াই স্যামসাংয়ের পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদন প্রসঙ্গে রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, সারা বিশ্বে মোবাইল ফোনের ৯০ শতাংশ উৎপাদন করছে চীন। কিন্তু চীনের শুধু স্পেকট্রাম নামে একটি চিপ উৎপাদনকারী কোম্পানি রয়েছে। এটা মোট চিপ উৎপাদনের ৫ শতাংশের বেশি নয়। সবচেয়ে বেশি চিপ উৎপাদক হলো কোয়ালকম, এটি আমেরিকান কোম্পানি। এরপরেই মিডিয়াটেক-এর অবস্থান, এটি তাইওয়ানি কোম্পানি। পরের প্রতিষ্ঠানগুলোও আমেরিকান কিংবা তাইওয়ানভিত্তিক।
প্রযুক্তির এ স্তরে চীনের কোনো কোম্পানিরই বড় অবস্থান নেই। তবে চীন বিশ্বের শীর্ষ মোবাইল উৎপাদক। তারা বিদেশ থেকে আরএনডি নিয়ে এসেই সফল। 'আমরাও প্রডাক্টশন হাব হতে চাই।'
'ভালো মানের আরএনডির জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন। স্যামসাং প্রতি বছর আরএনডিতে ২ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। ওদের এই আরএনডি ব্যবহার করে আমরা ভোক্তাদের ভালো মানের পণ্য দিতে পারছি। কম টাকা বিনিয়োগ করে পুওর আরএনডি দিয়ে সাধারণ মানের প্রোডাক্ট মানুষের হাতে পৌঁছালে ব্র্যান্ড তৈরি হবে না। বহুদিন লেগে যাবে নিজেকে পরিচিত করাতে। দৌড়ানোর কারণে শেখার সুযোগও থাকবে না। ব্যবসা করার জন্য এজন্যই বিদেশি আরএনডিকে আমরা গ্রহণ করেছি।
'আমরা ধীরে ধীরে ইন্টারমিডিয়ারি প্রোডাক্টগুলো ওদের থেকে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। আমরা ওদেরকে বলছি, তোমাদের এই কাজটি আমরা করে দিচ্ছি। তাদের কাছ থেকে নেওয়ার পর আমরা সফল হয়েছিও। নিজেরা কিছু কিছু ম্যাটেরিয়াল বানানো শুরু করেছি। এভাবে পরিবর্তন শুরু হয়েছে।
'আমরা এখন হুন্দাইয়ের গাড়ি অ্যাসেম্বল করছি। ওরা আমাদের বলে দিয়েছে, তোমরা পার্টস বানানো শুরু করো। আমাদেরকে বলেছে, সিট, বেল্ট, বাম্পার বানাও।
'আমরা এখন আরএনডি বানাচ্ছি না, তবে ভবিষ্যতে তারা বলবে তোমরা এখন আরএনডি বানাও।
'আমাদের এখানে প্রগেসিভ ম্যানুফ্যাকচারিং হচ্ছে। মার্কেট ছোট হওয়ার কারণে আরএনডির খরচ পোষানোর মতো পরিস্থিতি আমাদের এখনও হয়নি। ভলিউম বাড়লে আমরা করতে পারবো। তবে আমরা রি-ইঞ্জিনিয়ারিং করছি। আমরা অল্প অল্প করে নিয়োগও দিচ্ছি। একসময় দেখবেন, আমাদের বিশাল একটি আরএনডি টিম রেডি,' বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, 'আমরা চাইলে নিজেরাই একটা ব্র্যান্ড করতে পারতাম, কিন্তু এর পেছনে বিপুল সময় লাগত। আমাদের ছেলেমেয়েরাও শেখার সুযোগ পেত না। বড় ব্র্যান্ডের কোনো প্রডাক্ট আমরা এখানে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে গেলে তারা বাধ্য হয়েই নলেজ শেয়ার করবে।
'আমাদের ছেলেমেয়েদের যারা শিখে অভিজ্ঞ হবে, তারাই একসময় ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। আমরা এখনই রি-ইঞ্জিনিয়ারিং শুরু করেছি। টেলিভিশন ও মনিটরের ডিসপ্লে ছাড়া বাকি এলিমেন্টগুলো আমরা ম্যানুফ্যাকচারিং শুরু করব।'
ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে ভিয়েতনামের এত এগোনোর পেছনের কারণ জানিয়ে রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, 'স্যামসাংয়ের ভিয়েতনামের কারখানার জন্য দেশটির সরকার এয়ারপোর্ট থেকে তাদের জন্য ৮ লেনের রাস্তা করে দিয়েছে। ওদের এয়ারপোর্টের অবকাঠামো আমাদের চেয়ে বহু এগিয়ে। আমাদের এখানে ভালো একটা স্টোর রুম নেই। আমাদের পলিসি কনসিসটেন্সি এবং অবকাঠামো উন্নয়ন অনেক বেশি জরুরি। ইলেকট্রিক পণ্যের এক্সেপোর্টের ক্ষেত্রে কেমিক্যাল পরীক্ষাসহ নানা শর্ত দেয় অন্যান্য দেশ। ভিয়েতনাম থেকে যেটা সহজ'
দেশে কনজিউমার মার্কেটের বর্তমান অবস্থা ও চাহিদা নিয়ে তিনি বলেন, 'বর্তমানে দেশে কনজিউমার ইলেকট্রনিক্সের মার্কেট ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। ২০২২-২৩ ও ২০৩-২৪ অর্থবছর হবে কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স মার্কেটের জন্য একটা ভাইব্র্যান্ট সময়। কারণ নগরায়ন বেশ দ্রুত গতিতে হচ্ছে।
'এ মার্কেটের মোট শেয়ার হিসাব করলে আমরা ২ নম্বর হব। তবে ইনডিভিজুয়াল ক্যাটাগরিতে ধরলে ফ্রিজসহ কিছু ব্র্যান্ডে ওয়ালটন সেরা, এসিতে গ্রি ও জেনারেল সেরা। অন্যদিকে মোবাইলে আমরা সেরা। তবে ওভারল মাকের্টে বিদেশি ব্র্যান্ড হিসাবে স্যামসাং সেরা ।'
'মার্কেট কেমন বড় হতে পারে, এর উদাহরণ দিয়ে বললে এভাবে বলা যায়, দুটি মোবাইল, একটি টিভি, একটি ফ্রিজ, একটি ওয়াশিং মেশিন, এসি, ওভেনসহ একটি পরিবারের ২ লাখ টাকার ইলেকট্রনিক্স পণ্য দরকার হয়। দেশে যদি চার কোটি পরিবার হয় তবে মার্কেট ৮ লাখ কোটি টাকার হওয়ার কথা। বাংলাদেশে একসময় এরা সবাই এই নেটওয়ার্কের মধ্যে আসবে। বাংলাদেশ জনসংখ্যায় অষ্টম বৃহত্তম দেশ। মার্কেটের ক্ষেত্রেও অষ্টম বৃহত্তম দেশ হওয়ার কথা। একটা সময় হবেও ।'
স্যামসাংয়ের পণ্য দেশে উৎপাদনের সফলতা নিয়ে তিনি বলেন, তাদের সাফল্যর পেছনে তিনটি বিষয় মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসার জন্য স্যামসাং সাশ্রয়ী পণ্য দিয়ে তাদের সহযোগিতা করেছে, পরিবেশক নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করে এবং 'স্যামসাং ব্র্যান্ড শপ স্থাপনের মাধ্যমে আমরা গ্রাহকের আস্থা অর্জন করেছি।'
সরকার উৎপাদনমুখী নীতিমালা প্রণয়ন এবং কর অবকাশ সুবিধা দিয়ে মোবাইল ফোনসহ ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন শিল্পকে উৎসাহিত করেছে। স্যামসাংয়ের দেখাদেখি অনেক বৈশ্বিক ব্র্যান্ডই কারখানা করছে। 'এখন আমরা স্বপ্ন দেখি, মোবাইল ফোন উৎপাদনের পাশাপাশি রপ্তানির। সবাই মিলে আমরা একটি প্রযুক্তিবান্ধব শিল্প গড়ে তুলতে চাই।'