বাংলাদেশি তরুণদের কোরিয়ান সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণের নেপথ্যে
বাংলাদেশি তরুণী নাফিসা আনজুম ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ পর্যন্ত জানতেনই না বাংলাদেশে কী বিপুল পরিমাণ ছেলেমেয়ে কোরিয়ান সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট।
তবে কোরিয়ান সংগীতেই কেবল উন্মাদনা সীমাবদ্ধ ছিলনা,আস্তে আস্তে নাফিসা অবাক বিষ্ময়ে আবিষ্কার করতে লাগলেন তার নিজের সহপাঠীদের অনেকেও কোরিয়ান সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে মেতে উঠেছে।
তখন কী আর নাফিসা বুঝেছিলেন একদিন নিজেও ভিড়বেন এই দলে! কোরিয়ান সংগীত, নাটক, খাবার এবং ফ্যাশনে একই রকম আগ্রহ থাকায় নাফিসার এখন জুটেছে নতুন অনেক বন্ধু; জীবনটাও যেন আরও অনেক আনন্দময় আর উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
শুধু নাফিসাই নয়, বর্তমানে কোরিয়ান সংস্কৃতির উন্মাদনায় বিভোর বাংলাদেশের অনেকে। দিন দিন বেড়েই চলেছে কোরিয়ান ভক্ত-অনুরাগীর সংখ্যা ।
২০১৮ সালের ১২ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত কোরিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে ঢাকায় নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত হু ক্যাং-ইল বলেছিলেন, 'কোরিয়ান সংস্কৃতি বাংলাদেশে দিনে দিনে যেভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে,তাতে আমি আশা করি যে এই চলচ্চিত্র উৎসবটির মাধ্যমে আমাদের দু'দেশের মধ্যে বোঝাপড়া এবং বন্ধুত্বের চমৎকার ক্ষেত্র তৈরী হবে'।
একই কথা তিনি সে বছর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত কে-পপ ফেস্টিভ্যালেও বলেছিলেন। সে উৎসবে যোগ দিয়েছিল হাজারও কোরীয় ভক্ত।
কেননা ততদিনে বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে হালিয়ু (হাল্যু) বা 'কোরিয়ান তরঙ্গ'। এ তরঙ্গের জোয়ারে ভেসে গেছে এশিয়া থেকে আমেরিকা-পুরো পৃথিবী।
'হালিয়ু' (হাল্যু) মূলত একটি কোরিয়ান শব্দ যার দ্বারা বিশ্বব্যাপী সিনেমা, নাটক, সংগীত, প্রসাধনী পণ্য প্রভৃতির মাধ্যমে কোরিয়ান সংস্কৃতির দ্রুত প্রসারকে বোঝায়।
দূরত্ব যখন চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি
১৯৭০ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ কোরিয়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপন করে, যদিও শতাব্দীর সমাপ্তির সাথে শেষ হয়ে যায় সে সম্পর্কও।
কিন্তু পরে ২০১০ সালে যখন প্রযুক্তির কল্যাণে কে-পপ, কে-ড্রামা এবং অন্যান্য কোরিয়ান সাংস্কৃতিক উপাদানের সম্প্রচার হতে শুরু করে তখন আবার দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক নতুন করে জোড়া লাগতে শুরু করে।
বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মাঝে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উভয় দেশই নিজেদের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে বর্তমানে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।
১০৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শীর্ষে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া।
দক্ষিণ কোরিয়ানরা বাংলাদেশের এসইজেডে (বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল) প্রযোজনা ইউনিট স্থাপন করেছে, যা ইয়ংওন কর্পোরেশনের (দক্ষিণ কোরিয়ার পোশাক এবং ক্রীড়া সামগ্রী প্রস্তুতকারক) মত কোরিয়ান বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে এদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করছে। এর ফলে ২০১৮ সালে ৬৫,০০০ বাংলাদেশির কর্মসংস্থান হয়।
বিগত বছরগুলোতে দক্ষিণ কোরিয়ানরা কয়েক হাজার অভিবাসী বাংলাদেশি শ্রমিককে তাদের দেশে স্বাগত জানিয়েছে।
এসব কারণেও, বাংলাদেশিরা দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে একটি দৃঢ় বন্ধন অনুভব করে যা কোরিয়ান ওয়েভকে দেশে অন্য মাত্রায় পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম বিভিন্ন সাক্ষাতকারে ইতিপূর্বে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। শুধু তৈরি পোশাকশিল্পই নয়, চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ, প্রসাধনী এবং বাংলাদেশী অর্থনীতির অন্যান্য খাতে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন উদ্যোগের কথা স্মরণ করেন তিনি।
ডিনামাইট অ্যান্ড দ্য আর্মি
তবে বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি বিকাশে সবচেয়ে বড় প্রভাব রেখেছে কোরিয়ান সংগীত। হাজার হাজার বাংলাদেশি বিটিএস'র মতো কোরিয়ান ব্যান্ডগুলোর সংগীতে মজে রয়েছেন।
কে-পপ অনুরাগীদের যখন বিটিএস বা অন্যান্য কে-পপ ব্যান্ড সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, কেন তাদের এ সংগীতের প্রতি এত আকর্ষণ জানতে চাওয়া হয় -তখন বিচিত্র সব উত্তর মেলে। সবচেয়ে সাধারণ উত্তর হিসেবে সবাই বলে যে, কে-পপ তাদের ভেতরে আনন্দের উদ্রেক করে। তাছাড়া গানগুলোর মিউজিক ভিডিও বা নাচের কোরিওগ্রাফিই নিজেই যেন ব্যাখ্যা করে কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে 'বিটিএস আর্মি অফ বাংলাদেশ'র মত গ্রুপগুলোতে হাজার হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছেন ।
২০১২ সালে প্রচারিত সাই এর 'গ্যাংনাম স্টাইল' গানের কথা মনে আছে! ইউটিউবে কোটিবার দেখা হয়ে গেছে এই গানের মিউজিক ভিডিও, বলা যায় তখন আধুনিক বিশ্বে নতুন যুগের সূচনার আভাস দিয়েছিল এই গানই।
বর্তমান সময়ে সর্বাধিকবার দেখা মিউজিক ভিডিও'র মধ্যে অন্যতম বিটিএসের 'ডিনামাইট'। অজস্র গানের বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে চুরে দিয়েছে এই সংগীত। বিলবোর্ডের সেরা ১০০ শীর্ষ সংগীতের তালিকায় স্থান করে নেয়াসহ জিতে নিয়েছে গ্র্যামি মনোনয়ন।
তবে এসব উন্মাদনা শুধুই শহুরে তরুণদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিশেষত বাংলাদেশে একটু বয়স্ক এবং গ্রামের মানুষের মধ্যে কোরিয়ার বিনোদন জ্বরে ভোগার কোন লক্ষণ এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি! সুতরাং কেবল একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির ভেতরেই যে এই সংস্কৃতির প্রভাব গড়ে উঠছে তা বললে ভুল হবেনা।
মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের কোরীয় অনুরাগীরা শুধু যে কে-পপের আকর্ষণীয় গান, ছন্দবদ্ধ নৃত্য এবং ফ্যাশন উপভোগ করে তা নয়, তাদের অনেকে কোরিয়ান পারফর্মারদের অনুকরনে পোশাক, চুলের কাট এবং কথা বলার ভঙ্গিও আজকাল পরিবর্তন করে ফেলছে।
কে-ড্রামায় বুঁদ
কোরিয়ান সংস্কৃতির অন্য যে ধারাটি বাংলাদেশি সমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয় তা হলো এর নাটক, যা কে-ড্রামা হিসেবেই অধিক পরিচিত। 'ডিসেন্ড্যান্টস অফ দ্য সান', 'ক্র্যাশ ল্যান্ডিং অন ইউ' এর মত কে-ড্রামায় বুঁদ হয়ে থাকছে একশ্রেণীর দর্শক।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী নাফিসা আনজুম রথি কে-ড্রামার ভীষণ ভক্ত। তিনি জানান, 'আমার যে কারণে এই নাটকগুলো ভাল লাগে তার মধ্যে একটি কারণ এই যে, এগুলো মাত্র ১৬-২০ পর্বেই সীমাবদ্ধ'।
আরেকজন তরুণ 'হালিয়ু ফ্যান', ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের স্নাতক শিক্ষার্থী তাশীফ হোসেন জানান, কোরিয়ার নাটকগুলোর দেখতে বসলে মনে হয় যেন কেউ গল্প বলে যাচ্ছে। কাহিনীর তীব্রতা এবং ঘটনার মোড় নেয়ার ক্ষমতা কোরিয়ান নাটকের অন্যতম সেরা ব্যাপার।
তাছাড়া এশিয়ান দেশ হওয়ায় কোরিয়ান সংস্কৃতির সাথে বাংলাদেশি সংস্কৃতির রয়েছে অনেক মিল। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, রক্ষণশীল বা যৌথ পারিবারিক কাঠামো, পরিবারের পছন্দে বিয়ের মত অনেক কিছুতেই বাংলাদেশি সংস্কৃতির ছাপ দেখতে পাওয়া যায় এসব নাটকে; এর ফলে তরুণদের একটা বড় অংশ কে-ড্রামা উপভোগ করে।
যেন কোন রূপকথা
বাংলাদেশে কোরিয়ান-সংস্কৃতি্র অনেক ভক্ত নাটক বা মিউজিক ভিডিওতে দেখা পছন্দের তারকাকে বাস্তব জীবনে অনুকরণ করে থাকে। তরুণদের বড় একটা অংশ বর্তমানে তাদের মত করে জীবনধারায়ও পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে কোরিয়ান প্রসাধনী এবং সৌন্দর্য পণ্যগুলোর চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঢাকা এবং চট্টগ্রামে গড়ে তোলা বিভিন্ন দোকানের পাশাপাশি বর্তমানে অনলাইন শপগুলোও কোরিয়ান অনুষ্ঠানে দেখানো বিভিন্ন 'ট্রেন্ডি' পোশাক-আশাক বিক্রি করতে শুরু করেছে। কোরিয়াতে ঘুরতে যাবার ইচ্ছা চেপে বসেছে বহু তরুণের মাথায়, ঢাকার রাস্তায় হরহামেশাই দেখা মিলছে কোরিয়ান রেস্তরাঁও।
বাহারী এসব রেস্তরাঁর পাশাপাশি অনলাইন শপগুলো কোরিয়ান বার্বিকিউ, গ্রিল্ড বিফ বুলগোগী বা ঝাল ঝাল কিমচির বিকিকিনি শুরু করে দিয়েছে। তাতেই বোঝা যায়, এসব এখন আমাদের দেশে কতটা জনপ্রিয়!
মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে সংস্কৃতি: ভাল না মন্দ?
সবশেষে এটাই বলা যায়, বাংলাদেশে কোরিয়ান সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা কেবলমাত্র দ্রুত বিশ্বায়নের প্রভাবকেই নির্দেশ করে না, এটি বিনোদনের জন্য শহুরে তরুণদের আকুলতার দিকেও ইঙ্গিত করে; কোরিয়ার নাটক, সিনেমা, সংগীতের জনপ্রিয়তার উত্থান দেখে বোঝা যায় এখন তরুণেরা পছন্দ করে রিলেটেবল বা প্রাসঙ্গিক কনটেন্ট।
এটা সত্যি যে কোরিয়ান তরঙ্গ বাংলাদেশের সব শ্রেণির দর্শককে একইভাবে আন্দোলিত করতে পারে নি, তবু বাংলাদেশে এখন কোরিয়ান সংস্কৃতির যে বিশাল ভক্তকুল দাঁড়িয়ে গেছে সেটি অস্বীকারের উপায় নেই। এর অন্তর্নিহিত কারণ হয়তো বা দুই দেশের আর্থ-সামাজিক এবং আর্থ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।
এটি তরুন প্রজন্মের মধ্যে উপলব্ধি পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দেয়, যারা কোরিয়ান তরঙ্গকে অন্যদের চেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করেছেন।
সমাজের একটি অংশের কাছে এসব কে-ভক্তরা হাসির খোরাক এবং প্রতিনিয়ত উপেক্ষার পাত্র হিসেবে গণ্য হলেও, তাতে হালিয়ুর পদযাত্রা কিন্তু থেমে যায়নি।
বাংলাদেশের বৃহত্তর রক্ষণশীল সমাজ এখনও কোরিয়ান সংস্কৃতিকে দেশীয় সংস্কৃতির জন্য ধ্বংসাত্মক হিসাবে চিহ্নিত করেনি, যা অতীতে ভারতীয় বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ঘটেছে।
এর কারণ, কোরিয়ান সংস্কৃতি নতুন একটি পরিবেশের সাথে সহজেই খাপ খাইয়ে নেয়, স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে কোরিয়ান তরঙ্গ মিশে এমন একটি হাইব্রিড (মিশ্র) সংস্কৃতি গড়ে তুলছে যা অভিযোজন ক্ষমতা সম্পন্ন আবার একইসাথে অনেক বেশি স্বাগতও।
যেমন হাল্যু আমাদের এমন সব কোরিয়ান খাবারের সাথে পরিচয় করিয়েছে যা আমাদের বিরিয়ানীর সাথেই সাইড ডিশ হিসেবে খাওয়া যাবে কিংবা এমন কিছু পোশাক চিনিয়েছে যা অনায়াসে আমাদের দেশীয় পোশাকের সাথে সংযোজন করে নেয়া যাবে। কিছু কোরিয়ান শব্দ এবং স্টাইল তো রীতিমত আমাদেরই হয়ে উঠেছে।
এর অর্থ হল বাংলাদেশিদের একটি নির্দিষ্ট অংশ অন্যান্য সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে উপভোগ করে।
আজকের এই যুগে যখন জাতীয়তাবাদ এবং স্বজাত্যকেন্দ্রিকতা দানা বাঁধছে, এমনকি আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির ভেতরেও আমরা যখন গ্রহণযোগ্যতার ও সমানুভূতির অভাব দেখতে পাই, সেখানে বিপরীতে বিদেশী একটি সংস্কৃতির প্রতি বাংলাদেশের যুবসমাজের সহজাত গ্রহণযোগ্যতা এবং ভালবাসা তাদের ইতিবাচক মনোভাবেরই পরিচয় দেয়।
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)