পরিবারের হাল ধরতে ৯ বছর বয়সে স্কুল ছাড়েন, আত্মহত্যা করতে চাইতেন; তার ঝুলিতে এখন ২টি অস্কার, ২টি গ্র্যামি, ৬টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার...
তর্কযোগ্যভাবে ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত সংগীত পরিচালক এ আর রহমান। ভারতকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে গেছেন তিনি। তার ঝুলিতে আছে দুটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড (অস্কার), দুটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড, একটি বাফটা অ্যাওয়ার্ড, একটি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড, ছয়টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৫টি ফিল্মফেয়ার ও ১৭টি ফিল্মফেয়ার সাউথ পুরস্কার।
এ আর রহমান এখন ভারতের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া সংগীত পরিচালকদের একজন হলেও একসময় তার নিজের স্টুডিওর জন্য সরঞ্জাম কেনার সামর্থ্য ছিল না। এমনকি অ্যামপ্লিফায়ার বা রেকর্ডার কেনার টাকাও ছিল না তার।
কলেজে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না
এ আর রহমানের জন্ম তামিলনাড়ুর মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই), ১৯৬৭ সালে। ইসলাম গ্রহণের আগে তার নাম ছিল এ এস দিলীপ কুমার। তার বাবা আর কে শেখরও পেশায় তামিল ও মালয়ালাম চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক ছিলেন।
রহমানও ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রেমে পড়েন। চার বছর বয়সেই তিনি পিয়ানো বাজাতে শিখে যান। কিন্তু শৈশবেই বাবাকে হারানোর পর চরম অর্থকষ্টে পড়ে যান তারা।
এ বছর 'অমর সিং চামকিলা'-র সাফল্য উদযাপনকালে আলাপচারিতায় শৈশবের দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করেন এ আর রহমান। সেখানেই জানান, পড়াশোনার জন্য তিনি কলেজে যেতে পারেননি। সংগীত পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করার জন্যও তার কাছে পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না।
শৈশবের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'আমার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেত। কলেজেও যেতাম না; তাই মনে হতো কিছু একটা মিস করছি। আমার বয়স যখন বারো, তখন চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর বয়সি মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতাম। একঘেয়ে সময় কাটানোর কারণে আশপাশের অনেককিছু মনোযোগ দিয়ে শুনতাম।'
শৈশব
মাত্র ৯ বছর বয়সে এ আর রহমানের বাবা মারা যান। তার মৃত্যুর পর তাদের পারিবারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। এ আর রহমানের মা তখন প্রয়াত স্বামীর গানবাজনার যন্ত্রপাতি ভাড়া দিয়ে সংসার চালাতেন।
সে সময় এ আর রহমানের মা তাকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে সংগীতে মনোযোগ দিতে বলেন। পরিবারের দায়িত্বের অনেকটাই চাপে নয় বছর বয়সি শিশুর কাঁধে। পরিবারকে সহায়তা করতে তিনি পেশাদারভাবে পিয়ানো বাজানো শুরু করেন। অবশ্য চার বছর বয়স থেকেই তিনি বাবাকে স্টুডিওতে সাহায্য করতেন।
১১ বছর বয়সে রহমান ছোটবেলার বন্ধু শিবমণির সঙ্গে রহমান ব্যান্ড রুটস-এ সিন্থেসাইজার বাজাতেন। এছাড়াও চেন্নাইয়ের ব্যান্ড নেমেসিস অ্যাভিনিউ' প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
তিনি পিয়ানো, হারমোনিয়াম ও গিটার বাজাতেও দক্ষ।
স্কুল ছাড়ার কয়েক বছর পর অবশ্য এ আর রহমান কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু সংগীতে ক্যারিয়ার গড়তে কলেজও ছেড়ে দেন।
সংগ্রাম
কলেজ ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি নিজের ব্যান্ড গঠন করেন। এ সময় বিজ্ঞাপনের জিঙ্গলও লিখতে শুরু করেন। ৩০০-র বেশি বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল লিখেছেন তিনি।
পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এআর রহমান জানান, ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত তার মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা ঘুরপাক খেত। তিনি বলেন, '২৫ বছর বয়স পর্যন্ত আমি আত্মহত্যার কথা ভাবতাম। আমারা প্রায় সবাই-ই মনে করি, আমরা যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন নই। বাবাকে হারানোর কারণে আমার জীবনে এক ধরনের শূন্যতা ছিল…অনেক কিছু ঘটছিল। তবে এর ফলে আমি একরকম নির্ভীকই হয়ে উঠেছিলাম। মৃত্যু সবার জন্যই চিরন্তন ব্যাপার। সবকিছুরই তো মেয়াদ আছে। কাজেই কোনোকিছুকে ভয় পেয়ে কী লাভ?'
এ আর রহমান লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ থেকে সংগীতশিক্ষার জন্য বৃত্তি লাভ করেন। এছাড়া মাদ্রাজের সংগীত স্কুল থেকে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৮৪ সালে তার ছোট বোন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওই সময় তিনি কাদেরিয়া তরিকার সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯৮৯ সালে ২৩ বছর বয়সে এআর রহমান সপরিবারে ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন নিজের নাম পরিবর্তন করে আল্লাহ রাখা রহমান রাখেন।
ছেলের জন্য গয়না বেচে দিয়েছিলেন মা
'অমর সিং চমকিলা'র নির্মাতা ইমতিয়াজ আলি জানতে চেয়েছিলেন এ আর রহমানের প্রিয় সংগীতশিল্পী ও অনুপ্রেরণা কে। জবাবে তিনি বলেন, 'মাইকেল জ্যাকসন, জন উইলিয়ামস, মরিকোন, মরিস জারে।'
এ আর রহমান জানান, তার কাছে ইকুয়ালাইজার বা অ্যামপ্লিফায়ার কেনার টাকা ছিল না। শুরুর দিকে তার স্টুডিওতে কেবল একটি এসি, একটি শেলফ আর বসার জন্য কার্পেট বিছানো ছিল।
এই সংগীতস্রষ্টা বলেন, তিনি জীবনের প্রথম রেকর্ডার কিনেছিলেন মায়ের গয়না বন্ধক রেখে।
এক সাক্ষাৎকারে এ আর রহমান জানান, তিনি প্রথম পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ৫০ রুপি, রেকর্ড প্লেয়ার চালানোর জন্য।
সাফল্য
ধীরে ধীরে এ আর রহমান পরিচিত পেতে থাকেন। প্রথম বড় সাফল্য পান ১৯৯২ সালে, মণি রত্নমের তামিল চলচ্চিত্র 'রোজা'র হাত ধরে। এই ছবিতে তার সুর করা গানগুলো দর্শকদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। পরের বছর তিনি এ ছবির গানের জন্য জন্য সেরা সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান।
তবে এ আর রহমানের ইচ্ছা ছিল, 'রোজা'র পর আর কোনো চলচ্চিত্রের কাজ করবেন না। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত বদলে যায় ছবিটির গানের গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার পর।
এক সাক্ষাৎকারে এ আর রহমানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, 'রোজা' যে এমন 'ভূকম্পন' সৃষ্টি করবে, সেটি তিনি কখনও কল্পনা করতে পেরেছিলেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, 'আমি শুধু জানতাম, এটাই আমার শেষ ছবি হবে। তাই আমার সেরাটা দিয়ে এখান থেকে বিদায় নিতে চেয়েছিলাম।'
চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা শুরু করার পর এ আর রহমানের ক্যারিয়ার তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকে। এ আর রহমানের সংগীতে পশ্চিমা ধ্রুপদী সংগীত, ঐতিহ্যবাহী কর্ণাটক ও তামিল ফোক সংগীত, জ্যাজ, রক সংগীতের সংমিশ্রণ ঘটায় তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিত পেতে থাকেন।
জাভেদ আখতার, গুলজা, ভৈরামুথু, ভালি-র মতো প্রখ্যাত ভারতীয় কবি ও গীতিকারদের সঙ্গে কাজ করতে থাকেন এ আর রহমান। এছাড়া মণি রত্নম ও এস. শঙ্করের মতো পরিচালকদের ছবিতে বাণিজ্যিকভাবে সফল সংগীতও পরিচালনা করেন।
এ আর রহমান ২০০৯ সালে 'কাপলস রিট্রিট'-এর মাধ্যমে হলিউডের ছবিতে সুর দেওয়া শুরু করেন। তবে তিনি চূড়ান্ত সাফল্য পান ২০০৮ সালে। ওই বছর মুক্তি পাওয়া সিনেমা 'স্লামডগ মিলিয়নেয়ার'-এর গানের জন্য তিনি অস্কার জিতে নেন। ছবিটির 'জয় হো,' ও 'ও...সায়া' গান দুটি আন্তর্জাতিকভাবেও হিট ছিল।
'দিল সে…', 'তাল', 'রং দে বাসন্তী', 'স্বদেশ', 'জোধা আকবর', 'জানে তু... ইয়া জানে না'সহ বলিউডের আরও অনেক ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি। 'ইরুভার', 'বোম্বে', 'মিনসারা কানাভু', 'লগান', 'গুরু', 'রাভাণান', 'রকস্টার' 'এন্থিরান', 'কাদাল' ইত্যাদি ছবিতেও তার সুর করা গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।
চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হওয়া এ আর রহমান আজ ভারতের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া সংগীতশিল্পীদের একজন। ডিএনএ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতি গানের জন্য তিনি ৩ কোটি রুপি করে পারিশ্রমিক নেন। জাগরণ ইংলিশ-এর তথ্যানুসারে, তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৩৩৮ কোটি রুপি।
এ আর রহমান ১৯৯৫ সালে সায়রা বানুকে বিয়ে করেন। এই দম্পতি তিন সন্তানের বাবা-মা—খাতিজা রহমান, রাহিমা রহমান ও এ আর আমিন।