করোনার টিকাদানের অগ্রাধিকার ও সুশাসনের প্রতিফলন
কিছুদিন আগে (৩ ডিসেম্বর ) একটি ফেসবুকে পোস্টে বলেছিলাম, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে অচিরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে। তবে ভ্যাকসিনের লভ্যতা (দাম, সরবরাহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা) এবং টিকাদান কর্মসূচির সক্ষমতার বিবেচনায় প্রথম ধাপে কেবল সীমিত সংখ্যক মানুষকেই এই টিকা দেয়া সম্ভব হবে এবং পরবর্তীতে ধাপে ধাপে এই কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা যাবে। সেজন্য কারা আগে টিকা পাবে তার একটা গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ যে গাগাইডলাইন অনুযায়ী তাদের টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে, তাতে প্রত্যাশিত ভাবেই অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে আছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাদের মধ্যে আবার যেসব ডাক্তার ও নার্স সরাসরি করোনা রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন তারা প্রথমে আছেন। এর সঙ্গে নার্সিং হোমে থাকা বয়োবৃদ্ধরাও আছেন। এরপর আছেন ৭৫ এর বেশি বয়সের মানুষ এবং জনগণের সংস্পর্শে আসা (যেমন, ফুড মার্কেটের কর্মচারী) এবং জরুরী সেবাদানে নিয়োজিত যারা যেমন; পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড, ইত্যাদি সংস্থার কর্মী। তারপরের ধাপে আছেন ৬৫ থেকে ৭৫ বয়সের মানুষেরা এবং তার কম বয়সের যারা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন। সেইসাথে জরুরি আরও কিছু কাজে নিয়োজিতরা। জনসংখ্যার অন্য সবাইকে পরবর্তী পর্যায়ে কর্মসূচীর আওতায় আনা হবে। যুক্তরাজ্যের গাইডলাইনও প্রায় একই রকম।
আমাদের প্রতিবেশী ভারতে আপাতত প্রথম পর্যায়ের জন্য তিনটি অগ্রাধিকার গ্রুপ নির্দিষ্ট করা হয়েছে: প্রথম, ঝুঁকিতে থাকা সব স্বাস্থ্যকর্মী; দ্বিতীয়, পুলিশসহ জরুরি সরকারি সেবাদানে নিয়োজিতরা এবং তৃতীয়, পঞ্চাশের ঊর্ধ্বের জনগোষ্ঠী এবং তার থেকে কম বয়সের যারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে।
বাংলাদেশেও এধরনের আগ্রাধিকারের গাইডলাইন তৈরি হয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর কিছুটা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আছে বলে মনে হচ্ছে। বয়োবৃদ্ধদের কোনো উল্লেখই নেই। যেখানে অন্য দেশগুলোতে এরা সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া শ্রেণীগুলোর অন্যতম। আমাদের তালিকার স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রত্যাশিত ভাবেই অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষেই আছেন। তবে জনপ্রতিনিধিরাসহ ঢালাওভাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তালিকার উপরের দিকেই আছেন।
এছাড়া, অন্য দেশগুলোতে রোগ সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের সুনির্দিষ্ট মতামতের ভিত্তিতেই স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ অগ্রাধিকার ঠিক করেছে। আমাদের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটির বিষয়ে তেমন জানা যাচ্ছে না। নীতিমালার অগ্রাধিকার নির্ধারণের বিষয়ে অমর্ত্য সেন অর্থনীতির সামাজিক পছন্দক্রম বাছাই তত্ত্বের (social choice theory) একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করেছেন: যাদের পছন্দের ভিত্তিতে অগ্রাধিকার নির্ণয় করা হচ্ছে তারা কি ব্যক্তিস্বার্থের বিবেচনায় মতামত দিচ্ছেন, নাকি তিনি সমাজের যে কেউ হতে পারতেন- তা মনে করে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ মূল্যবোধের অবস্থান থেকে তা করছেন।
একথা ঠিক যে, আর্থ-সামাজিক পরিবেশ এবং সংক্রমণের গতি-প্রকৃতির বিবেচনায় বিভিন্ন দেশের অগ্রাধিকার এক রকম না হবার যুক্তিসঙ্গ কারণ থাকতে পারে। এছাড়া, গাইডলাইন যাই থাকুক, তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনিয়মের মাত্রা কতটুকু সেটাও জরুরি বিষয়। টিকার ন্যায়সঙ্গত মুল্য নির্ধারণও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
তবে সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, এই টিকাদান কর্মসূচির অগ্রাধিকার নির্ণয় ও বাস্তবায়নের মাপকাঠিতে একটি দেশের শাসন ব্যবস্থা কতখানি মানবিক গুনে সমৃদ্ধ- তা অনেকখানি বোঝা যাবে। বিষয়গুলোর মধ্যে আছে: জনস্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব, স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের সুরক্ষা, বয়োবৃদ্ধদের সুরক্ষায় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, নাগরিকদের সমানাধিকার, ক্ষমতা ও পদ বিবেচনা না করে শুধু স্বাস্থ্যের ঝুঁকির বিবেচনায় অগ্রাধিকার নির্ণয়, বা করোনার টিকাদানের মত জরুরি জনস্বাস্থ্যসেবাকে বাজার অর্থনীতির উপর ছেড়ে না দিয়ে সরকারি স্বাস্থ্য খাতের যথাযথ দায়িত্ব পালন।
এটি মানুষের বাঁচা-মারার বিষয়, এবং সেকারণেই এক্ষেত্রে কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি হলে করোনা সংক্রমণ রোধের সাফল্য-ব্যর্থতা ছাড়াও এর ব্যাপক তাৎপর্য আছে। সুশাসনের মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বা উন্নয়ন-অনুন্নয়নের লক্ষণ বুঝতে গেলেও এটা একটা মাপকাঠি হতে পারে।
[লেখাটি অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিনের ফেসবুক থেকে নেওয়া]
- লেখক: অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা