ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নিয়ে যেকোনো ধরনের সংশয় দূর করতে হবে
বাংলার ইতিহাস কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস। বাংলাকে প্রথম ভাগ করে ব্রিটিশ উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ১৯০৫ সালে। দ্বিতীয়বার বাংলা ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে। যে বিভাজন স্থায়ী আকার ধারণ করেছে: বিভাজিত বাংলা পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ। পূর্ববঙ্গ এখন বাংলাদেশ। পশ্চিমবঙ্গ পশ্চিম বাংলা। এই দুই ভূখণ্ডই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা দ্বারা আক্রান্ত। পূর্ববঙ্গ যা পরবর্তী প্রথম ৮ বছর পূর্ববঙ্গ এবং পরের ১৫ বছর ছিল পূর্ব-পাকিস্তান নামে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর থেকে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। নতুন চিন্তা ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের অন্যতম স্তম্ভ। এখনকার বাস্তবতা, বাংলাদেশি ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা আজ হেফাজতিদের সঙ্গে লড়াইয়ে ব্যস্ত। পশ্চিমবাংলার অবস্থাও অনুরূপ। ভারতীয় এই রাজ্য ৪৭ সালের বিভক্তির পিছনে ছিল হিন্দুত্ববাদী। হিন্দুত্বের পরিণামে সেই সময়ে বাংলা ভাগের প্রস্তাব এবং বাস্তবায়ন হয়েছিল হিন্দুত্বের দ্বারাই। '৪৭ থেকে '৭৭ দীর্ঘ ত্রিশ বছর পশ্চিমবাংলা শাসিত হয়েছে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল কংগ্রেস দ্বারা। এরপরে পশ্চিম বাংলার ক্ষমতা সমাজতান্ত্রিকদের হাতে। ১৯৭৭ থেকে ৩৪ বছর তারা এই ক্ষমতা ধরে রাখে। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের পর তৃতীয় দফায় তৃণমূল শাসন।
পশ্চিমবাংলার বিচার বিভাগ কিংবা পূর্ববর্তী পূর্ববঙ্গের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের বিচার বিভাগের এক অদ্ভুত মিল দেখা যায়। পশ্চিম বাংলার বর্তমান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আছেন বিচারপতি রাজেশ বিন্দাল। তিনি পাঞ্জাব থেকে আগত একজন মানুষ যার জীবন শুরু হয়েছিল পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায়। বি.কম ও এল এল বি করা বিন্দাল ১৯৮৫ সালে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট এবং সেন্ট্রাল এডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনালে করারোপ, সাংবিধানিক, সিভিল ও পরিষেবা মামলাগুলো পরিচালনা করতেন। ২০০৬ সালে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে কেন্দ্র শাসিত জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখের কমন হাইকোর্টে বদলি হন এবং ২০২০ সালের ডিসেম্বরে কার্যকরি প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। ২০২১ এর জানুয়ারিতে কলকাতা হাইকোর্টে বদলি হন। চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল ভারতীয় রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বিচারপতি রাজেশ বিন্দালকে কলকাতা হাইকোর্টের কার্যকরী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন। ২৯ এপ্রিল ২০২১ কার্যকরী প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব বুঝে নেন।
২০১৮ সালে রাজেশ বিন্দাল যখন জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টে বদলি হন তখন ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের ৪৬তম প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈই। বিচারপতি রঞ্জন গগৈই অবসর গ্রহণের পর বিজেপিতে যোগ দেন এবং রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন। তিনি সম্ভবত প্রথম যিনি (অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি) অবসরের পর রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে রাজ্যসভার সদস্য হন। বিজেপি সরকার কোনো পূর্ববর্তী আলাপ-আলোচনা ব্যতিরেকেই জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে দেয়। স্বভাবিক কারণেই কাশ্মীর জুড়ে এর প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে জম্মু কাশ্মীরের ভারতীয় কাঠামোতে যোগদানের শর্তই ছিল সংবিধানে ৩৭০ ধারা যুক্ত করতে হবে। ফলশ্রুতিতে ১৯৫০ সালে ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারা যুক্ত করেই সংবিধান গ্রহণ করা হয়। সংবিধানের এই ৩৭০ ধারা যখন বাতিল করা হয় সেই সময় বর্তমান পশ্চিমবাংলার প্রধান বিচারপতি কাশ্মীর অংশের হাইকোর্ট ডিভিশনে কর্মরত ছিলেন। কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতারা সেসময় ব্যাপক হারে জামিন বঞ্চিত হতেন। এই অব্যাহত ঘটনাগুলোর ভেতর থেকে কাশ্মীরকে দীর্ঘকাল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে বিজেপি তার ধর্মীয় মৌলবাদ কাশ্মীরের উপর চাপিয়ে দিয়েছে।
বিজেপি সরকারের বর্তমান রাজ্যসভার সদস্য ভারতীয় প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি আসামের গগৈ বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে জম্মু-কাশ্মীরে নিয়োগ করেছিলেন। সেই সময় বোঝা যাচ্ছিল ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার উপর এক ধরনের অশুভ থাবা বিস্তারের ঘটনা ঘটতে চলেছে। যদিও বিষয়টি ওই সময়ে শুরু হয়েছে কথা বলা যাবে না।
অতীতেও বহু ঘটনা ঘটেছে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায়। আগামী দিনে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা তাদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অবস্থান হারাবে। ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সরকার নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে কারণ ইতিমধ্যে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কংগ্রেস এবং বিজেপি যৌথভাবে বিচারক নিয়োগের আইনে কিছু পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, যদিও সুপ্রিমকোর্ট তা গ্রহণ করেনি। তবুও সেই ঘটনায় বিবেকবান মানুষের কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে, এই দুটি রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের স্বার্থে অভিন্ন। তারা বিচারব্যবস্থার উপরে নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিল। যার প্রকাশ ঘটেছে আজকের কলকাতায়।
সিবিআই চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত ৪ জন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদকে যেভাবে গ্রেপ্তার, জামিন মঞ্জুর ও মধ্যরাতে হাই কোর্ট কর্তৃক স্থগিত, তারপর হাইকোর্টের বিচারক জামিনের পক্ষে, প্রধান বিচারপতি অস্থায়ী জামিনের বিপক্ষে গৃহবন্দির সুপারিশ, তারপরে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে। সেখানে সেই জামিনের পক্ষের বিচারক অনুপস্থিত। অনুমান করা যাচ্ছে যে, অতি শীঘ্রই হয়তো এই রাজনৈতিক নেতৃত্ব জামিন পাবেন না। তাদেরকে আরো কিছুকাল এইভাবে গৃহবন্দি অবস্থায় থাকতে হবে। যা ঘটেছিল কাশ্মীরে। কাশ্মীরে একাধিক নেতাকে গৃহবন্দী রেখেই বিজেপি কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। আগামী দিনে যদি পশ্চিমবাংলায় ভারতীয় সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করতে হয় তা হলে বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাকে এভাবেই তারা গৃহবন্দী করবেন। প্রাথমিকভাবে সে দিক থেকে দেখা যায়, এই পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নবগঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ আগামীতে কী অবস্থান গ্রহণ করেন।
আজকের বাংলাদেশে বেশকিছু ঘটনা ঘটছে যা সর্বস্তরের মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। দেশের উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত এবং গতিশীল রাখার জন্যই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অত্যন্ত জরুরী। গত সপ্তাহান্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে ঘটনা ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিণতিতে রোজিনা ইসলাম নামক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে 'রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য চুরির' অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলো। যেখানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে অন্যান্য নেতারা বারবার বলছেন যে, রোজিনা ইসলাম ন্যায় বিচার পাবেন। ন্যায় বিচারের প্রশ্নটা এখানে কতটা প্রাসঙ্গিক। রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তা হচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের গোপন তথ্য ফাঁস করতে চেয়েছিলেন। প্রশ্ন দাঁড়ায়, এখানে কীভাবে রোজিনা ইসলাম সেই গোপন তথ্য হস্তগত করলেন? কোন যাদুবলে রোজিনা ইসলামের কাছে সেই গোপন তথ্য পৌঁছালো? ছবি তুললেন? এ প্রশ্নগুলোর মীমাংসা মন্ত্রণালয় করেনি। রোজিনাকে যে ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে সে ধারা গত ৫০ বছরে কারো প্রতি গ্রয়োগ করা হয়নি। জামিনের শুনানি হয়েছে গত বৃহস্পতিবার আর জামিনের আদেশ রবিবার পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। রবিবারেও রোজিনা ইসলাম জামিন পাবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই উপমহাদেশে আদালতের উপর রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা তার বিপরীতে আমাদের বিচার ব্যবস্থায় প্রকৃত স্বাধীন ও নিরপেক্ষতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটিই আমাদের ভরসার মূল জায়গা।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক