পায়রায় সমুদ্রবন্দর তৈরি কি বাস্তবসম্মত?
ছোটবেলায় ২০ কিলোমিটার দূরের গ্রামের বাড়ি যেতাম লঞ্চে করে। যে দূরত্ব এখন ২০ মিনিটে যাওয়া যায়, আগে যেতে লাগত ৮ ঘণ্টা। ছোট্ট লঞ্চে আবার ছিল আপার ক্লাস। দোতলায় যেখান থেকে লঞ্চ চালানো হতো, তার পেছনের বসার জায়গাটাই হলো আপার ক্লাস, যেখানে বসার জন্য আবার দেড়গুণ ভারা গুনতে হতো।
অনেক সময় লঞ্চ চালাত সুকানিরা, সারেংয়ের সহকারী। সারেং পাশে বসে গাইড করত। দূর থেকে কোন নৌকা আসছে, আগে ভাগেই সতর্ক করে দিত, 'একটু ডাইনে চাপাইয়া রাখ।' পেছন থেকে বড় জাহাজ, আবার মোড়ের কাছে চর জাগছে, বাঁশ পুতে রাখা হয়েছে গভীরতা নির্দেশক হিসেবে, এরকম সব কিছুর ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখে সুকারি বা যে স্টিয়ারিং করত, তাকে পরামর্শ দিয়ে যেত।
সাগরে আবার ভিন্ন ব্যপার। চারদিকে শুধু পানি আর পানি; কূল নাই, কিনারা নাই। ৪০-৫০ কিলোমিটার দূর থেকেও একটি জাহাজ দেখা যায় রাডারে। শুধু তাই না, দেড়-দু'ঘণ্টা আগে থেকেই জানি সে জাহাজের স্পিড কত, আমার কত দূর দিয়ে সে অতিক্রম করবে, সে কোনদিকে যাচ্ছে।
এর মতো নির্ভাবনার কাজ আর নেই!
আসলে আমাদের ভাবনা পানির উপরের জন্য না, নিচের জন্য, বিশেষ করে বড় জাহাজগুলোর, যাদের আমরা বলি ডিপ ড্রাফট ভেসেল (শিপ)।
বড় জাহাজগুলো চলার জন্য ৫০-৬০-৭০ ফুট পানির প্রয়োজন। উপর থেকে দেখতে একদম খোলামেলা সাগর মনে হলেও নিচে লুকিয়ে আছে আমাদের বিপদ।
একটি নৌকা স্বল্প পানিতে আটকে গেল, একটু হইচই হলো, লোকজন লুঙ্গি কাছা মেরে নিচে নেমে গেল। ঝামেলার ব্যপার, কিন্তু সমস্যা সেখানেই শেষ।
কিন্তু আমি যদি চরে জাহাজ উঠিয়ে দিই, তাহলে আমার চাকরি সে মুহূর্তেই শেষ। শুধু তাই নয়, হয়ত পৃথিবীর কোনো কোম্পানি আমাকে আর চাকরি দেবে না। আর আমরা যারা তেলের ট্যাংকার চালাই, তারা এমন কাজ করলে ঘটনা সারা বিশ্বের সংবাদ শিরোনামে চলে আসবে, এবং প্রচণ্ড আশঙ্কা যে, চাকরি হারিয়ে আমি বাসায় ফিরতে পারব না, জেলখানায় যেতে হবে।
তাই সাগরের নিচের অংশটা আমাদের জন্য সবচেয়ে দুশ্চিন্তার ব্যাপার।
তাহলে আমরা কীভাবে জাহাজ চালাই?
সাগরের নিচে দেখা যায়?
নাহ, দেখা যায় না।
শুধু জাহাজটা যেখানে আছে, তার নিচের গভীরতা দেখা যায়। কিন্তু জাহাজ তো চলমান, আমার নিচে কত পানি আছে তা জেনে তো কোনো লাভ নাই। আমার প্রয়োজন, আমার সামনে বা চারদিকে কি আছে তা জানা।
তাহলে কীভাবে আমরা চলি?
আমাদের কাছে পানির নিচের ছবি থাকে, তাই আমরা জানি আমাদের সামনে বা চারদিকে কী আছে।
আমরা যদি আমাদের উপকূলীয় ম্যাপের দিকে তাকাই, ম্যাপটি নিচের কোনো ছবি দেখায় না, কিন্তু কোথায় কতটুকু গভীরতা আছে তা বোঝা যায়, এবং এতটুকুই নাবিকদের প্রয়োজন।
ম্যাপটির হলুদ অংশটি যে স্থলভাগ সেটা বোঝাই যায়, কিন্তু জলভাগে রয়েছে বিভিন্ন রঙ। নিচের একদম সাদা এলাকাটি গভীর পানি। হাল্কা নীল রঙের এলাকাটি একটু কম গভীর, আর গাঢ় নীল রঙের এলাকাটি অগভীর পানি। আর পুরো জলভাগে যে ডিজিট বা সংখ্যা লেখা থাকে, তা সে স্থানের গভীরতা। এসব গভীরতা দেখে আমরা নিজ জাহাজের ড্রাফট (পানির নিচে ডুবে থাকা অংশ) অনুযায়ী রুট প্রস্তুত করি।
পৃথিবীর সমস্ত জলভাগের ম্যাপ রয়েছে, এবং এসব ম্যাপের ভিত্তিতেই সমুদ্রে জাহাজ চলাচল করে। এসব ম্যপে সমুদ্রের প্রত্যেকটি এলাকার গভীরতা, তলদেশের বৈশিষ্ট্য, চ্যানেলের বয়া, তীরের বাতিঘর, সবকিছুই নিখুঁতভাবে দেওয়া থাকে। শুধু তাই নয়, প্রতি সপ্তাহে তা আপডেট করা হয়। যেমন আজকে যদি কর্নফুলী নদীর একটি বয়ার লাইট নষ্ট হয়ে যায়, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব জাহাজে সতর্কবার্তা চলে যাবে, আর কয়েক দিনের মধ্যে সব জাহাজে ম্যাপের সংশোধনী চলে যাবে।
পৃথিবীর সমস্ত বন্দর, উপকূল ও সাগর-মহাসাগরের জন্য প্রায় চার হাজার চার্ট রয়েছে। যেসব জাহাজ ট্রাম্পিং করে, মানে ক্ষেপ মারে ট্রাকের মতো, তাদের সব ম্যাপই রাখতে হয়। প্রতি সপ্তাহে নুতন সংশোধনী আসে, জাহাজের সেকেন্ড মেট সব ম্যাপ কারেক্ট করে। জাহাজ কোথায় আছে বা কোথায় যাবে, সেটা বড় কথা নয়, সংশোধনী আসামাত্রই জাহাজের সমস্ত ম্যাপ কারেক্ট করতে হবে। ফলে কোনো ন্যাভিগেটিং অফিসার হয়তো জীবনেও চিটাগাং আসেননি, কিন্তু এ এলাকার ম্যাপ তার চেনা, কারণ তাকে কারেক্ট করতে হয়।
বঙ্গোপসাগর তথা বাংলাদেশ উপকূলের সাথেও পরিচয় একইভাবে। দেশ হিসেবে ছোট হলেও বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ উপকূল। আবার উপকূল দীর্ঘ হলেও গভীরতা খুবই কম, ফলে বড় জাহাজ চলাচলের জন্য মোটেও সুবিধাজনক নয়। উপকূলের ম্যাপের দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যায় দক্ষিণাঞ্চলের উপকূল জুড়েই নীল রঙের এলাকা মানে অগভীর পানি। চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে হলে কক্সবাজার থেকেই অগভীর জলের মাঝে এক চিলতে গভীর পানির চ্যানেল ধরে খুব সাবধানে এগোতে হয়। চট্টগ্রাম থেকে মোংলা বন্দর খুব দূরে নয়। কিন্তু জাহাজে করে যেতে হলে অনেক ঘুরে যেতে হয়। চট্টগ্রাম থেকে সোজা দক্ষিণে যেতে হয় কক্সবাজার, সেখান থেকে পশ্চিমে সুন্দরবন বরাবর গিয়ে আবার উত্তরে আসতে হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের গভীরতা মাত্র ৯.৫ মিটার বা ৩১ ফুট, একটি তিন তলা বিল্ডিংয়ের সমান। মোংলায় আরও কম। তারচেয়েও বড় সমস্যা, বন্দরে আসার পথেও গভীরতা কম। সেই কক্সবাজারেই শেষ হয়ে যায় গভীর সমুদ্র, এরপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোতে হয়।
আমাদের পুরো উপকূলব্যাপী বিস্তীর্ণ এলাকার মাঝে একমাত্র কুতুবদিয়া চ্যানেলে কিছুটা গভীরতা আছে, এবং তা ১৪.৫ মিটার বা ৪৮ ফুটের মতো। কুতুবদিয়া দ্বীপ আর মেইনল্যান্ডের মধ্যে যে সামান্য জলভাগ, তাকেই বলা হয় কুতুবদিয়া চ্যানেল। কিন্তু গভীরতা বেশি থাকলেও এখানে আসার রাস্তার কিছু অংশে গভীরতা কম। ফলে এটা ডিঙিয়ে কুতুবদিয়া আসা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। কক্সবাজার এসে জাহাজ নোঙর ফেলে জোয়ারের অপেক্ষা করে। জোয়ার শুরু হবার ছয় ঘণ্টা পর পিক টাইড হয়, মানে তখন পানির উচ্চতা সবচেয়ে বাড়ে, এবং ভাটা শুরু হয়। জাহাজের উদ্দেশ্য থাকে, পানির সর্বোচ্চ উচ্চতায় যাতে সে অগভীর এলাকা পার হয়ে যেতে পারে। তাই জোয়ার শুরু হবার পর নোঙর তোলে, জাহাজের গতি হিসেব করে ছয় ঘণ্টার মধ্যেই সে অগভীর এলাকা পার হয়ে চলে যায়। চট্টগ্রাম বন্দর বা কুতুবদিয়া চ্যানেলে আসা জাহাজের ক্যাপ্টেনদের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ, হাজার বন্দরের মধ্যেও এমন উটকো ঝামেলার যাত্রাপথ পাওয়া যাবে না!
এতক্ষণ চট্টগ্রাম, কুতুবদিয়া, মোংলার গভীরতা মিটারে বলেছি। কিন্তু জাহাজের সাইজের অনুপাতে এটা কত?
চট্টগ্রাম বন্দরে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টনের একটি জাহাজ তার আকার আকৃতির ভিত্তিতে হয়তো ফুল লোডেড অবস্থায় প্রবেশ করতে পারে। ধারণক্ষমতার বিবেচনায় বড় জাহাজ হলো ক্রুড বা অপরিশোধিত তেলের ট্যাংকার। সে হিসেবে কুতুবদিয়াতে আসতে পারে সবচেয়ে ছোট সাইজের ক্রুড ট্যাংকার, আনুমানিক ১ লাখ টনের আফ্রাম্যাকস ট্যাংকার, যাদের ১৪ মিটারের মতো পানির প্রয়োজন হয়।
ডিপ ড্রাফট বা গভীর সমুদ্রবন্দর শব্দটি আপেক্ষিক, তারপরও আমরা ২০ মিটার বা ৬৫ ফুট ড্রাফটের জাহাজগলোকে ডিপ ড্রাফট জাহাজ বলি, এদের ধারণক্ষমতা তিন লাখ টনের উপরে।
চাকরি জীবনের শুরুতেই কুতুবদিয়া চ্যানেলে আসা যাওয়া করতে হতো। বিদেশ থেকে আড়াই লাখ টনের সুপার ট্যাংকারগুলো পুরো কার্গো নিয়ে কুতুবদিয়া আসতে পারত না। অর্ধেক কার্গো থাইল্যান্ড কিংবা বার্মার বন্দরে খালি করে বাকি অর্ধেক নিয়ে কুতুবদিয়া চ্যানেলে নোঙর করত। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ১৫ হাজার টনের লাইটার জাহাজ নিয়ে বড় জাহাজ থেকে আট দশ ট্রিপে পণ্য খালাস করে নিয়ে আসতাম। লাইটারিং সবসময়েই খুব ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল। নবাবপুর থেকে এক ট্রাক পণ্য মিরপুর বয়ে নিতে হয়তো ২০০০ টাকা নেবে। কিন্তু গন্তব্যের শেষ ৫০০ মিটার হয়তো সরু গলি, ট্রাক ঢুকে না। তখন দেখা যাবে ভ্যানে করে সব মাল নিতে ট্রাক ভাড়ার চেয়ে বেশি লেগে যাবে, সময় নষ্ট হবে। সেজন্য গভীর সমুদ্রবন্দর থাকা একটি দেশের জন্য অনেক বড় সুবিধা, এবং সেই প্রথম থেকেই জানি, কুতুবদিয়া হলো একমাত্র এলাকা যেখানে বড় জাহাজের জন্য বন্দর করা সম্ভব।
এরপর অনেকদিন পার হয়েছে। ক্যাডেট জীবনের পরেই চট্টগ্রাম এবং বঙ্গোপসাগরের সাথে সম্পর্কচ্যূত্য। বছর বিশেক আগে হঠাৎ শুনলাম, কক্সবাজারের পাশে সোনাদিয়াতে গভীর সমুদ্রবন্দর করা হচ্ছে। কক্সবাজারে ১০০ টনের বে ক্রুজ জাহাজ ভিড়তে পারে না, সেখানে লাখ টনের জাহাজের জন্য বন্দর? ব্যাপারটা হজম করতে পারছিলাম না। শুনলাম, দীর্ঘ খাল বা চ্যানেল কেটে জাহাজ আগমনের পথ করা হবে।
যা হোক, ব্যপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। বছর পাঁচেক আগে, বন্ধুদের আড্ডায় আবার গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে কথা উঠল। দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা নামক একটি জায়গায় গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে। জাহাজে থাকলে অনেক সময় এ রকম ব্রেকিং নিউজ মিস করি। বন্ধুদের কাছ থেকে শুনলাম পায়রাতে নাকি এ এলাকার সর্বাধুনিক এবং বিশাল দিপ-সি পোর্ট হচ্ছে।
সোনাদিয়ায় সমুদ্রবন্দর হচ্ছে, এটা শুনে বুদ্ধিবৃত্তি আহত হয়েছিল, পায়রার কথা শুনে নিহত হলো! বন্দর তৈরি করা অনেক জটিল কাজ। তলদেশের বৈশিষ্ট্য দেখতে হয়, সিলট্রেশন বা পলি জমার প্রকৃতি দেখতে হয়, স্রোতের গতিবিধি, জোয়ার-ভাটা, ঝড় ঝাপটা থেকে নিরাপত্তা, এ রকম অনেক বৈশিষ্ট্য যাচাই করে বন্দরের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। কিন্তু সব পয়েন্টের বাবা হলো গভীরতা। নাবিকরা পানি বিশেষজ্ঞ নন, কিন্তু বন্দর বানানো হয় নাবিকদের জন্য। শত শত বন্দরের তুলনামূলক ব্যবহারিক বিশ্লেষণ নাবিকরা ভাল বোঝেন। আমি নাবিক, তাই আড্ডার কেউ কেউ পায়রা সমন্ধে জানতে চাইল। আমি আমার মতো করে বিশ্লেষণ করলাম। উপকূলের স্বল্প গভীরতা, অ্যাপ্রোচ চ্যানেল, সিলট্রেশন- এসব নানাবিধ কারণে পায়রা কখনো গভীর বন্দর হিসেবে পছন্দের কেন, সম্ভাবনার তালিকায়ও আসার কথা না। আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিজ্ঞতা থেকে এসব বর্ণনা করছিলাম।
আমার পেছনে দাঁড়িয়ে মনযোগ সহকারে শুনছিল বন্ধু শ্যামল। আমার কথা শেষ হবার পর খুব শান্তভাবে বলল, 'একটা বন্দর প্রায় হয়ে যাচ্ছে, আর তুমি বলছ এখানে বন্দর হওয় সম্ভব না? তুমি কি মনে করো যারা পরিকল্পনা করেছে তারা পাগল? এত বড় বন্দর বানাচ্ছে কিছু না বুঝেই?'
এরপর জানলাম, এটা হতে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ডিপ-সী পোর্ট।
সত্যি একটা ধাক্কা খেলাম, সত্যিই তো, এত বড় একটি প্রজেক্ট তো আর এমনি হতে পারে না।
বছরের পর বছর স্টাডি হয়। পোর্ট তৈরির আগেই প্রচুর রিসার্চ হয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে পানির গতিপথ, পলি পরার ধরন, বাতাসের গতি প্রকৃতি, প্রত্যেকটা ব্যপার পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ যুগে আরেকটা কাজ করা হয়, তা হল সিমুলেশন। গত বছর দিল্লির অ্যাডভান্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ট্রেনিংয়ের সময় তারা কিছু বন্দরের প্লানিং স্টেজের সিমুলেশন দেখাচ্ছিল। কত ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি যাচাই বাছাইয়ের পর বন্দরের পরিকল্পনা করা হয় দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম।
যাহোক, বন্ধুর কথাগুলো শুনে থমকে যেতে হলো। মনে মনে স্মৃতি হাতড়াতে লাগলাম, এটা কি সম্ভব? কি জানি, নাথিং ইম্পসিবল!
ছোটবেলায় একটি গল্প শুনেছিলাম। রাজা রাজকুমারকে নিয়ে পদ্মদীঘির পারে হাঁটছিলেন। হঠাৎ দুজনে একটি দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যান। একটি সাপ দীঘির এক পার থেকে আরেক পার যাচ্ছে, তার পিঠে একটি ব্যাঙ বসে আছে। রাজপ্রাসাদে ফিরে রাজপুত্র উজিরকে বলল, 'চাচা জানো, আজ সাপের পিঠে বসে একটি ব্যাঙকে দীঘি পার হতে দেখলাম।' উজির বলল, 'বাবা এটা হতে পারে না। সাপ প্রথমেই ব্যাঙকে খেয়ে ফেলবে।'
রাজকুমার বলল, 'বাবাও আমার সাথে ছিল।'
রাজা সে পথেই আসছিলেন। উজির তাকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'জাহাঁপনা, এটা কি সত্যি যে সাপের পিঠে চরে একটি ব্যাঙ দীঘি পার হচ্ছিল?'
রাজা মৃদু হেসে বলল, 'আরে দৃষ্টিভ্রম হয়েছিল, এটা হয় নাকি?'
ছেলে বাবার উত্তরে অবাক হয়ে গেল। উজির চলে গেলে বাবাকে বলল, 'বাবা, আমরা দুজনে একসাথেই তো ঘটনাটা দেখলাম, আপনি অস্বীকার করলেন কেন?'
রাজা বললেন, 'বাবা, তোমার সত্যি যদি সবার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়, তাহলে তা নিয়ে বিতর্কে না যাওয়াই ভালো। সবাই তোমাকে মানসিকভাবে অসুস্থ ভাববে।'
বুঝে গেলাম, পুরো জাতি জানে পায়রায় দক্ষিণ এশিয়ার বিখ্যাত ডিপ-সি পোর্ট হতে যাচ্ছে। এটা আমাদের ঐতিহ্য, চেতনার ব্যাপার। এটা ভুল হতে পারে না; আমিই ভুল।
কিন্তু এরপর যা হলো, তা হচ্ছে, পায়রা বন্দর আমার একাডেমিক ইন্টারেস্ট হয়ে দাঁড়াল। নিয়মিত ফলো করতে লাগলাম এর অগ্রগতি। কীভাবে এ বন্দরের পরিকল্পনা হলো, কবে শুরু হলো, কবে শেষ হবে, এ ব্যাপারে মাঝে মধ্যে খোঁজ-খবর নিতাম।
২০১৬ সালে প্রথম যখন বন্ধুদের আড্ডায় পায়রার ব্যপারে শুনি, তখন পায়রা খাঁচা থেকে বের হবার মুখে, মানে উদ্বোধনের পর্যায়ে। দেশি-বিদেশি নিউজ সাইটগুলো থেকে পায়রা সমন্ধে স্টাডি শুরু করলাম এবং এখনো তা চলমান।
বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী যতটুকু জানতে পেরেছি, তা নীচে সংক্ষেপে লিখলাম:
- ২০১৩ সালে বন্দরের কাজ উদ্বোধন হয়, কিন্তু বন্দর নির্মাণে তেমন গতি সঞ্চার হয়নি।
- ২০১৫ সালে ১১২৮ কোটি টাকা খরচ ধরে বন্দরের কাজ শুরু হয় দ্রুতগতিতে। কিন্তু প্রথম রিভিশনেই খরচ ১১২৮ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৩৫০ কোটি টাকা ধার্য করা হয়।
- ২০১৬ সালের জুলাইয়ে বন্দর উদ্বোধন করা হয় সীমিতভাবে, ছোট জাহাজের জন্য।
- দেশপ্রেমিক জনগণ পায়রা বন্দরের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে বন্দরের চারদিকে জমি কেনা শুরু করে!
- ২০১৭ সালে আবার নুতন করে প্রকল্পের পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ ১১১৬ কোটি টাকা দেড় বছরের মাথায় বৃদ্ধি পেয়ে ২৩৩৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়; কারণ জনগণ জমির মূল্য তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়।
- ২০১৮ সালে প্রকল্পে নুতন জেটি সংযোজিত হয়। এর জন্য নুতন করে ৩৯৮২ কোটি টাকা যোগ হয়।
- প্রকল্পের সঙ্গে কনসালটেন্ট হিসেবে যোগ করা হয় বন্দর তৈরিতে অভিজ্ঞ বুয়েটকে। আমরা জানি, অতীতে বুয়েট অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। রড আর সিমেন্টের স্ট্রেন্থ বা শক্তিমত্তা নির্ণয়ের জটিল কাজ করাই বুয়েটের একমাত্র কাজ নয়। অতীতে বিশ্বের বিস্ময় তিন চাকার 'মিশুক' আবিস্কারের পর বুয়েট যোগ দেয় আরেক বিস্ময় পায়রা বন্দরে।
- পায়রা বন্দরের কাজকে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই কাজ তরান্বিত করার জন্য বন্দর ব্যবস্থাপনা এবং বড় বড় জাহাজ চালনায় সবচেয়ে অভিজ্ঞ নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
- ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮: পায়রা বন্দরের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের অবস্থান নিয়ে প্রথম আলো বিস্তারিত রিপোর্ট করে। উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে আবারও বাংলাদেশ নিজেকে তুলে ধরে।
- চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়েও বড় বে-টার্মিনালের খরচ ধরা হয় ২১ হাজার কোটি টাকা।
- কক্সবাজার মাতারবাড়ী ডিপ-সি পোর্ট নির্মানের ব্যয় ধরা হয় ১৫০০০ কোটি টাকা।
- পায়রা বন্দরে জাহাজ আসার জন্য চ্যানেল ড্রেজিংয়ের জন্য ব্যয় ধরা হয় ৪৫০০০ কোটি টাকা।
- মাতারবাড়ী ডিপ-সি পোর্ট এবং বে-টার্মিনালের সম্মিলিত খরচের সোয়াগুণ খরচ ধরা হয় পায়রা বন্দরের শুধু ড্রেজিংয়ের জন্য।
- ২০১৬ সালে সিঙ্গাপুরে তোয়াস মেগাপোর্টের কাজ শুরু হয়, যার খরচ ধরা হয় ৩৮০০০ কোটি টাকা।
- মিয়ানমারের রাখাইনে চীন গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির বাজেট ধরা হয়েছে ৬০,০০০ কোটি টাকা।
- শুরুতে ১১১৮ কোটি টাকার প্রাথমিক বাজেটে শুরু হওয়া পায়রা বন্দরে আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প যোগ হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি এ প্রকল্পে এখন বন্দরের জন্য ৮০৭ কোটি ডলার, সহযোগী অবকাঠামোর জন্য ৯০৫ কোটি ডলার খরচ ধরা হয়। সব মিলিয়ে ১৮৩৪ কোটি ডলার বা এক লক্ষ চুয়ান্ন হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে, যা বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিগ বাজেট বন্দর রাখাইন ডিপ-সি প্রজেক্টের আড়াইগুণ, এবং নিঃসন্দেহে ১৫৪০০০ কোটি টাকার পায়রা বন্দর বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্দর প্রকল্প।
- ২২ এপ্রিল ২০১৯: জার্মানি, বেলজিয়াম ও বাংলাদেশের ৫ গবেষকের সমন্বয়ে পায়রা বন্দরের ওপর গবেষণামূলক একটি সমীক্ষার বরাত দিয়ে রিপোর্ট করে প্রথম আলো পত্রিকা। ১১ জানুয়ারি প্রকাশিত সমীক্ষার গবেষকদের নেতৃত্বে ছিলেন জার্মান সরকারের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান ও জার্মানির ব্রেহম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হারমান আর কুদরাস। জনাব কুদরাস প্রায় বিশ বছর যাবত বঙ্গোপসাগরের পলি ও পানিপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা করছেন। ২০১১ সালে তার গবেষণার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই মিয়ানমার এবং ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ সংক্রান্ত মামলায় বাংলাদেশের আবেদনপত্র তৈরি করা হয়। জনাব কুদরাস বলেন, মেঘনা অববাহিকা দিয়ে বছরে প্রায় ১১০ কোটি ঘনমিটার পলি সাগরে এসে পরে। এর মধ্যে ৪০ কোটি ঘনমিটার শুধু পায়রা নদীর আশেপাশে জমা হয়, এবং প্রতি বছর এই পলি সরাতে প্রায় ৮০০০-১০০০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। গবেষণায় কুদরাস আরও বলেন, একটি মাঝারি মানের ঝড়ের কারণে পলি পড়ে বন্দর সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যেতে পারে। সারাংশ হিসেবে মিঃ কুদরাস বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে পায়রা বন্দর তেমন উপযোগী নয়। তবে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, যেকোনো বড় প্রকল্পে এরকম বিশেষজ্ঞরা নেতিবাচক রিপোর্ট নিয়ে আসে, কিন্তু সরকার সব অসম্ভবকে সম্ভব করে। মি. কুদসের নেতিবাচক রিপোর্ট যদিও লোকজনকে কিছুটা বিভ্রান্ত করেছিল, কিন্তু নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য সবাইকে আবার উজ্জীবিত করে।
- ১৬ জানুয়ারি ২০২১: পায়রা ডিপ-সি পোর্টে জাহাজ ঢুকার জন্য ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রাবনাবাদ চ্যানেল ড্রেজিংয়ের কাজ উদ্বোধন। ৪৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৮ মাসব্যাপী ড্রেজিং প্রকল্প শেষ হলেই পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরে বড় বড় জাহাজ আসতে পারবে। ড্রেজিং শেষে চ্যানেলের গভীরতা দাঁড়াবে ৬.৩ মিটার (চট্টগ্রাম ৯.৫ মিটার) , এবং এই গভীরতায় অনায়াসে ৭০০০ টনের সুপার ট্যাংকার বন্দরে প্রবেশ করতে পারবে।
- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সফলতার খবর হলো, সাড়ে চার বছরে বন্দর থেকে ২৫৩ কোটি টাকার মতো বিশাল অংকের আয় (যে বন্দরের বাৎসরিক ড্রেজিং ব্যয় হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা।)
- ১৬ মার্চ ২০২১: দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ধার নিয়ে প্রথমবারের মতো 'বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন তহবিলে'র যাত্রা শুরু। এ তহবিল থেকে প্রথম অর্থ পাবে পায়রা বন্দর। প্রাথমিকভাবে পায়রা বন্দর এই তহবিল থেকে ৫৪১৭ কোটি টাকা পাবে।
- ২৫ এপ্রিল ২০২১: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, পাঁচ বছর প্রচেষ্টার পর সরকার পায়রা বন্দরকে গভীর সমুদ্রবন্দর করার পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বক্তব্যে বলেন, নুতন পরিকল্পনায় পায়রাকে এখন সাধারণ সমুদ্রবন্দর হিসেবেই রাখা হয়েছে সাইক্লোনের মতো মৌসুমী ঝড়ের কথা চিন্তা করে। কক্সবাজারের মাতারবাড়ী হবে একমাত্র ডিপ-সি পোর্ট, সেখান থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে পায়রায় পণ্য আনা হবে।
যাহোক, পায়রা এখনো বিশ্বের বিস্ময়। এই মহাপ্রকল্পের জন্য হাজার হাজার একর জমি আছে, চার লেনের মহাসড়ক আছে, মেরিন পার্ক আছে, অ্যাকুইরিয়াম আছে, পর্যটকদের জন্য রেসর্ট আছে, বিনোদন কেন্দ্র আছে, শুধু জাহাজ প্রবেশ করার মতো গভীরতা নেই। আর এতে আমার একটি বড় লাভ হয়েছে। পাঁচ বছর আগে বন্ধু শ্যামলের কথায় আমার নিজের মানসিক সুস্থতা নিয়ে শংকায় পড়ে গিয়েছিলাম। দেশে-বিদেশে মস্তিষ্ক পরীক্ষার জন্য যোগাযোগও করেছিলাম। কিন্তু এখন ভাবছি, আমি মনে হয় সুস্থ।
দীর্ঘ রসকসহীন একটি গল্প শেষ করব আরেকটি বস্তা পচা জোঁক দিয়ে!
বাংলাদেশ থেকে এক ব্যক্তি আমেরিকা এসেছেন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য। তিনি চাকরির জন্য গেলেন ফ্লোরিডার একটি মেগা-শপে, যেখানে এক ছাদের নিচে গাড়ি থেকে দেশলাই পর্যন্ত সবকিছুই পাওয়া যায়।
দোকানের মালিক বললেন, 'আমাদের সেলসম্যানের কিছু পোস্ট খালি আছে। তোমাকে একদিনের জন্য সুযোগ দিতে পারি, তবে চাকরি পার্মানেন্ট হবে কি না, তা নির্ভর করবে তোমার পারফরম্যান্সের উপর।
আজকে সারাদিন কাজ করো, আমি বিকেলে এসে যাচাই করব।'
মালিক ভদ্রলোক বিকেলে এসেই জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি সারাদিনে কতজন কাস্টমারের কাছে বিক্রি করতে পেরেছে?'
বাংলাদেশি ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, 'একজন।'
মালিক হতাশ হয়ে বললেন, 'দেখো, আমার সেলস পার্সনরা প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জনের কাছে পণ্য বিক্রয় করে। সেখানে তুমি মাত্র ১ জনের কাছে?'
বাংলাদেশি ভদ্রলোক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
-আচ্ছা তুমি মোট কত টাকার পণ্য বিক্রয় করেছ?
- ১,০১,৫৮৭ ডলার।
- হোয়াট! একজনের কাছেই তুমি এক লাখ ডলারের পণ্য বিক্রি করেছ?
- হ্যাঁ।
-কী বিক্রি করেছ তুমি?
-প্রথমে একটি ছোট বড়শি বিক্রি করেছি, তারপর বললাম ছোট বড়শির সাথে মাঝারি এবং বড় বড়শিও দরকার, সুতরাং সেই দুটো বড়শিও বিক্রি করেছি। পরে একটি একটি ছিপ বিক্রি করেছি। বললাম, বোটে বসে মাছ ধরার মজাই আলাদা। ওনার বোট ছিল না, তাই বোট সেকশনে গিয়ে একটি ডাবল ইঞ্জিন ফিশিং বোট কিনে দিলাম। কিন্তু তার ছোট গাড়ি দিয়ে বোট টেনে নেওয়া সম্ভব না, তাই তাকে নিয়ে কার সেকশনে গিয়ে একটি হেভি পিকআপ ভ্যান কিনে দিলাম।
মালিক তার বিস্ময় কাটিয়ে জানতে চাইলেন, 'ভদ্রলোক আসলে কী কিনতে এসেছিল?'
'স্যার, উনি এক কেস বিয়ার কিনতে এসেছিলেন। বললাম, এরকম সুন্দর আবহাওয়ায় বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে ধরতে বিয়ার খাবার মজাই আলাদা। পরে অবশ্য উনি বিয়ার কেনার কথা ভুলে গিয়েছিলেন।'
'ভদ্রলোক এসেছিল বিয়ার কিনতে, আর তুমি তার কাছে ডাবল ইঞ্জিন বোট আর পিকআপ ভ্যান বিক্রি করেছ? আচ্ছা ভাই, এর আগে তুমি কোথায় সেলসের কাজ করেছ?'
'স্যার আমি কখনো সেলস এর কাজ করিনি। আমি দেশে থাকতে পায়রা বন্দর প্রকল্পে জড়িত ছিলাম!'
-
লেখক: নৌ কর্মকর্তা