মুহুরী বাঁধের মৃত্যু: বন্দুক হাতের খুনি আর কিছু লজ্জা
কুয়াশা ভেদ করে নিঃশব্দে এগিয়ে চলছিল আমাদের সরু নৌকা। সতর্কভাবে সাপের মতো লকলকে গলা বাঁকিয়ে আমাদের এক নজর দেখে নিল সাপ পাখি বা গয়ার। এদিকে, ভাসমান কচুরিপানার মধ্য দিয়ে সাঁতার কাটছিল একদল সরালী হাঁস। আমাদের ভারি ক্যামেরার চঞ্চল গতি পর্যবেক্ষণে মুহূর্তে তাদের মাঝেও দেখা দিল ব্যস্ততা।
মুহুরী বাঁধের স্লুইস গেটগুলোর দীর্ঘ সারি পেছনে ফেলে আমরা চলছিলাম উত্তর-পূর্বে। মুহুরী ও ফেনী নদীর সঙ্গমস্থলে নির্মিত এই বাঁধ তৈরি করেছে স্বচ্ছ পানির এক হ্রদ। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই জলাশয়টি অতিথি পাখিদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আমরা হাঁসের মতো শীতকালীন নিয়মিত পর্যটকদের আকর্ষণ টানতেও সক্ষম হলাম। কিন্তু পাখিরা এখানে পুরো শীতকালের জন্য ছুটি কাটাতে এলেও আমরা থাকছি মাত্র দুই-একদিন।
ফেনী শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে সোনাগাজী উপজেলায় বাঁধটির অবস্থান। সেচের জন্য নদীর পানি সংরক্ষণ এবং জোয়ারের ঢেউ থেকে চাষের জমি বাঁচাতেই বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বাঁধের কারণে সৃষ্ট সরু এই হ্রদের নিচে দেখা মিলবে জলজ সব উদ্ভিদের। শীতকালে অতিথি পাখিরা নিমজ্জিত এই জলজ গাছ-গাছরাগুলো খেতে ছুটে আসে।
অতিথি ঈগল পাখি, হ্যারিয়ার বা জলচিল এবং অসপ্রে বা মাছমুরালেরা হ্রদে আসে মাছ বা পাখি শিকার করতে। মাত্র দুই মাস আগে সাদা লেজের এক ঈগলের ছবি তুলতে ফটোগ্রাফাররা এখানে ভিড় জমিয়েছিলেন। বাংলাদেশে এ ধরনের ঈগলের দেখা সচরাচর মেলে না। তবে ফটোগ্রাফাররা মাত্র চারদিনের সময় পেয়েছিলেন। এরপর বিষাক্ত এক ইঁদুর খেয়ে মারা যায় ক্ষুধার্ত ওই অল্পবয়সী ঈগল।
ভাগ্যের ফেরে, আমাদের এই যাত্রায় আরেকটি মৃত্যুর সাক্ষী হতে হলো। এক ঘণ্টা ঘোরাঘুরি করার পরই কুয়াশা চিড়ে আমাদের কানে বন্দুকের তীক্ষ্ণ আওয়াজ এসে ঠেকে। অদৃশ্য শিকারির ব্যাপারে সতর্ক হই আমরা।
দ্রুম! দ্বিতীয়বারের মতো গর্জে উঠল বন্দুক। বাইনোকুলারের সাহায্যে এবার আমরা চার যাত্রীবাহী এক নৌকার দেখা পেলাম। নৌকায় চকমকে জাম্প-স্যুট পরা এক ব্যক্তির হাতে ডাবল-ব্যারেলের শটগান। শিকারির সহকারী বিজয়ানন্দে হ্রদের বুক থেকে তুলে নিলেন একটি সরালী হাঁস। হাঁসটির কুঁকড়ানো মৃতদেহ থেকে তখনো রক্ত ঝরছে। ভয়ার্ত হাঁসগুলো বুক চিরে ডাকতে ডাকতে হ্রদ ছাড়তে গাছের সারির দিকে ভিড়ছে।
হাঁসগুলোর সঙ্গে এবার যুক্ত হলো আমাদের চেঁচামেচি। শিকারির উদ্দেশ্যে আমরা তীর্যক বাক্য ছুঁড়লাম। সেই ব্যক্তি পুনরায় হাঁসগুলো লক্ষ্য করে দুবার গুলি ছুঁড়লেন। তবে সফল হলেন না। তিনি সম্ভবত দূর থেকে আমাদের গলা শুনতে পাননি বলেই আমরা রেহাই পেলাম। তবে পাখিদের আর্তনাদ, গলা ছেড়ে ডাকা সত্ত্বেও তিনি কিছুই শুনলেন না সম্ভবত আধ-কালা হয়ে যাওয়ার কারণেই।
কোনো সন্দেহ নেই, এসব শিকারিরা কম বয়সেই বধির হয়ে যান। আমি ওই অভাগা শিকারির সঙ্গে দেখা হলে তাকে কানে তুলা গোজার উপদেশ দিতে চাই। তাকে বলতে চাই, কোনো হাঁসের মাংসই তার ক্ষতিগ্রস্ত কান কিংবা বোধশক্তির অক্ষমতা ঠিক করতে পারবে না।
সহসাই কুয়াশা কমে আসায় ওই শিকারি আমাদের দেখতে পেয়ে দ্রুত বন্দুক নামিয়ে ফেললেন। এবার ক্যামেরা থেকে নিজের মুখ লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ আগেই যে অপকর্ম করেছেন, তারজন্য এখন তিনি লজ্জিত নাকি!
তবে বিষয়টি আমাকে একটু নরম করে তুলল। আমি জানি, পৃথিবীতে এমন বহু শিকারি আছেন, যারা তাদের নির্মম হত্যার জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা বোধ করেন না। উল্টো বুক ফুলিয়ে গর্ব করেন।
অন্তত মুহুরী বাঁধের এই শিকারি জানতেন, বাংলাদেশে পাখি শিকার করা কোনো গৌরবের বিষয় না। তিনি ভাঁড়ের মতো এক হাতে শিকার তুলে আরেক হাতে বন্দুক নিয়ে আমাদের ক্যামেরার সামনে পোজ দেননি।
আমাদের নৌকা শিকারি নৌকার কাছাকাছি যেতেই লোকটির চেহারায় ভীতির রেশ ফুটে উঠল। হুট করেই আমাদের ক্যামেরা বন্দুকের চেয়েও শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত হলো। হাঁসের জন্য তারা না যতটা ভয়ংকর ছিলেন, আমরা যেন তারচেয়েও ভয়াবহ শত্রুপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হলাম।
মৃত হাঁসটি সেই প্রবাদপ্রতীম নাবিকের গলায় ঝুলানো আলবাট্রসের মতোই লোকটির গায়ে জেঁকে বসেছিল। পাখি হত্যার সেই তীব্র মনস্তাপের কথা ব্যক্ত করেছিলেন স্যামুয়েল টেইলার কোলারিজ। হত্যাকারী নাবিক আর্তনাদ করে বলেছিল:
'…বুড়ো থেকে ছোকড়ারা
সবাই আমায় কী ঘৃণার চোখেই না দেখছিল!
ক্রুশের বদলে আমার গলায়
সেই আলবাট্রস ছিল ঝুলানো।'
আমরা শিকারির দুর্দশা না বাড়িয়ে নৌকা ঘুরিয়ে নিলাম। তবে আমাদের মাঝি ব্যাপারটা এত সহজে ছাড়লেন না। তিনি বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানানোর প্রতিজ্ঞা করলেন। বুক ফুলিয়ে এটাও জানালেন, শিকারি নৌকাটি মুহুরী হ্রদের মাঝি সম্প্রদায়ের কারও নয়।
তিনি বললেন, 'আমরা কোনো শিকারির জন্য কাজ করি না। আমরা এখানে আসা পর্যটক যারা পাখি দেখতে ও ছবি তুলতে আসেন, তাদের নৌকায় তুলি। শিকারি নৌকাটি সম্ভবত আশেপাশের গ্রাম থেকে এসেছে।'
আমরা ঘাটে ফিরতেই মাঝি পাখি শিকারের বিষয়টি জানাতে উপজেলা প্রশাসনের কাছে ফোন করলেন। একজন উপজেলা কর্মকর্তা ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে আমাদের ফোন করেন। তিনি আমাদের শিকারির ছবি পাঠানোর অনুরোধও করেন। সোনাগাজি উপজেলা প্রশাসনের প্রশংসা না করে পারছি না!
- লেখক: পাখি বিশেষজ্ঞ, আলোকচিত্রী, লেখক ও পর্যটক
- মূল লেখা: Death at Muhuri Dam: Killer with a shotgun and some shame
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা