কবিদের স্মৃতি: ‘আমার যে মৃত্যুতেও মৃত্যু নেই’
আজকের দিনে যখন ফেলে আসা ৬০'এর দশকের কথা ভাবি; তখন একটা বিষয় খুব নাড়া দেয়, সেটা হলো বই পড়ার সংস্কৃতি। আমাদের মতো উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে বই ছিল একটি আলাদা আনন্দ প্রাপ্তির দুনিয়ার মতো। পরিবারের জ্যেষ্ঠজন থেকে শুরু করে সর্বকনিষ্ঠ সকলের মধ্যে বই পড়ার অভ্যেস ছিল। প্রচুর বই থাকতো আমাদের বাড়িতে।
অবসর মানেই তখন বই
তখন অবশ্য লেখক বা সাহিত্যিকদের সংখ্যা এত বেশি ছিল না- তাই যখন যে বই বের হতো, মানুষ তা-ই কিনে ফেলতো। এই যে বই কিনে বাসায় ফেরা, এই অভ্যাসটা এখন কতটা আছে জানি না, কিন্তু তখন ছিল। নতুন জামাকাপড়ের চেয়েও অনেক আনন্দ লাগতো যখন, নতুন বই বাসায় আসতো!
আমার মায়ের মতো বাড়ির মেয়েরা দুপুরের খাবার দাবার শেষ করে, বই হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তো। এই দৃশ্যগুলো এখন মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
শুধু পড়তামই না, বই নিয়ে আলোচনাও হতো তখন বাড়িতে। এখন অবসর সময় কাটানোর জন্য আমাদের টিভি আছে, ইউটিউব আছে, মোবাইল- ফেসবুক আছে। মানুষ এখন পড়ে কম।
আমার বড় মামা ব্যবসা করতেন, কিন্তু তিনিও সৈয়দ শামসুল হকের গল্পের ভাষা নিয়ে আলোচনা করতেন। একজন সাধারণ মানুষ যে সাহিত্যের কাছাকাছিও যায় না, সে-ও সৈয়দ শামসুল হকের ভাষা নিয়ে কথা বলতে পারতেন। আজকাল ব্যবসায়ীদের মধ্যে কি এমন সাহিত্যচর্চা দেখা যায়? আমার মেজো মামা ছিলেন বিভূতি-ভক্ত। তিনি সব সময় বলতেন, 'ওনার (বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় ) ৪-৫টা নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল।'
আবার আমার মা ছিলেন পুরোদস্তুর একজন গৃহিণী। খুব দরকার নাহলে, তিনি বাসার বাইরে বেরোতেন না। সে-ই মা-ও আলোচনা করতেন এসব বই নিয়ে। কারণ সেই চর্চাটা ছিল তখন তাদের মধ্যে। একটা ঐতিহ্য ছিল। মানুষ অনেক আধুনিক সাহিত্য পড়তে পছন্দ করতো তখন।
মানুষ তখন সবল ছিল নিজের মেধা দিয়ে
মধ্যবিত্ত শ্রেণি আগে যতটা শক্তিশালী আর সচেতন ছিল, এখন সে-ই জোরটা আর নেই তাদের মধ্যে। এর একটা বড় কারণ, তখন মানুষ বই পড়তো! মানুষ তখন সবল ছিল নিজের মেধা দিয়ে। তাকে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হতো। এখন বোঝাপড়া করতে হয় দলের সাথে। বোঝাপড়া করতে হয় গোষ্ঠীর সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, আরও কত গোষ্ঠীর সঙ্গে। তখন এতসব ছিল না।
আমার বাবা- মা দুজনেই বই পড়তো, তবে মা বেশি পড়তো। তার বেশিরভাগ বই ছিল ভারতীয় বই। আমার ভাইয়েরা 'সন্দেশ' পড়তো, ইংরেজি উপন্যাসও পড়তো।
পত্রপত্রিকায় যে ঈদ সংখ্যা বের হতো, সেখানে যে গল্পগুলো বের হতো- ওগুলো পড়তাম। আমার একটা বইয়ের কথা মনে আছে। নাম- 'আনন্দের মৃত্যু'। বইটা বোধহয় শামসুল হকের গল্পগ্রন্থ। আমার মনে আছে, ৬৭ এর দিকে এই বইটা অনেক আলোচিত হয়। আমরা সবাই বইটা পড়েছিলাম, খুব ভালো লেগেছিল আমার।
তার লেখায় একধরনের নয়া-আধুনিকতার প্রভাব ছিল
আমি তখনো কলেজে উঠিনি। সৈয়দ শামসুল হককে অনেক আধুনিক মনে হতো আমার। তার লেখায় এক ধরনের নয়া-আধুনিকতার প্রভাব ছিল, যেটা কলকাতার বইতে ছিল না। আমি যেহেতু অনেক বেশি ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্য পড়তাম, তাই হক সাহেবের লেখার ধাঁচ আমার খুব ভালো লাগতো, কিছুটা পশ্চিমা বলেই হয়তো।
৬৯ এর দিকে হক সাহেবের 'বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা' কবিতার বইটি বের হয়। তার উপন্যাসও আমি সব পড়েছি। ৭০ এর দিকে বের হলো, "খেলারাম খেলে যা"। এটা নিয়ে তো বিরাট তোলপাড় হলো সেসময়। কিন্তু আমার এত ভালো লাগেনি। ওনার যত উপন্যাস আছে, তার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে কম ভালো লাগার উপন্যাস 'খেলারাম খেলে যা'। কিন্তু যৌনতা নিয়ে লেখা আমাদের সাহিত্যে কম আছে। তা-ই সেদিক থেকে তার লেখাটা গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু 'বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা' যখন ছাপা হলো, আমাকে একদম মুগ্ধ করে ফেললো বইটা। বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত যত কবিতার বই পড়েছি, এটার মতো কোনো বই আমাকে এতটা টানেনি। কারণ গোটা বই একটা কবিতা। আমার মনে হয়েছে, এই বই যেভাবে কবির ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে, সেটা খুব দূর্লভ। এরকম কবিতাও লেখা হয়নি, এভাবে কেউ বলেওনি, এবং যে বাকপ্রতিভা সেটাও কোনো বইতে আসেনি আমাদের দেশে। হক ভাইকে মানুষ নাটকের জন্যও চেনে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, তার সবচেয়ে বড় অর্জন, তার কবিতার অর্জন।
স্বাধীনতার পরে তিনি যে উপন্যাসগুলো রচনা করেছেন, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের উপরে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব নিয়ে। তাতেও আমার মনে হয়েছে উনি খুব সাবলীলভাবে লিখছেন, ভাষা গদ্য খুব সাবলীল।
মাঝেই মাঝেই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, আমার কোন কাজটা তুমি শ্রেষ্ঠ মনে করো? আমি বলতাম, আপনার সকল লেখার মধ্যে 'বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা' শ্রেষ্ঠ কাজ। শুধু কাব্য নয়, যেকোনো ভাবেই বিচার করতে গেলে বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা শ্রেষ্ঠ। মনে আছে, আমি যখন এই বইটা পড়ি, আমি একটানা পড়েই গেছি, পড়েই গেছি। আর ছাড়তে পারিনি।
হাসান হাফিজুর রহমান ভাইয়ের রুমে যেহেতু সব লেখক-কবিরা আসতেন, এটা ছিল আমার জন্য বিশাল সুযোগ তাদের কাছাকাছি আসার। কারণ হাসান ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করা না হলে হয়তো এতজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়ার সুযোগ হতো না। হক ভাইয়ের সঙ্গেও সেখানেই পরিচয়। এর আগে আমরা তাকে চিনতাম বিবিসির মাধ্যমে। বিবিসিতে তার কন্ঠ শুনতাম। সেভাবেই আমরা তাকে চিনতাম।
বিলেত থেকে ফিরে এসে সচিত্র সন্ধানীতে যোগদান করেন সৈয়দ শামসুল হক। এটি ছিল একটা সাহিত্যনির্ভর পত্রিকা, যেটা সেসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল।
(ছবি)
ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে কথা বলার মানুষ তেমন নেই
হক ভাই ইংরেজিতে কথা বলতেন। ইংরেজির প্রতি তার একটা দূর্বলতা ছিল। আমার ইংরেজি সাহিত্যে দখল ভালো ছিল বলে, আমার সঙ্গেই সেসব নিয়ে আলোচনা করতেন। কারণ বাংলা সাহিত্য নিয়ে কথা বলার মানুষ পেলেও, ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে কথা বলার মানুষ তেমন নেই।
৭৭ এর দিকে আমি তার বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা গ্রন্থটি অনুবাদ করা শুরু করি। যে কারণে তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা একটা ভিন্ন মাত্রায় যায়। আগেই বলে রাখি, আমার বন্ধুবান্ধবদের কাছে আমার সাহিত্যচর্চা কিন্তু কখনো তেমন বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু যখন এই অনুবাদের হাত দিলাম, সবাই পছন্দ করলো! আমার বন্ধু হাসান ফেরদৌস আমাকে বললেন, 'অন্য সবগুলোর মধ্যে তোমার সবচেয়ে ভালো কাজ এটা'। হাসান আমাদের ঢাকা কলেজের সাহিত্য পত্রিকা পূর্বপত্রের সম্পাদক। আমার খুব কাছের মানুষ।
কবিকে না বুঝলে, অনুবাদ করা যায় না
আমার মনে হয়, আমি হক ভাইকে সেদিক থেকে কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম। তাকে নিয়ে কথা বলার মতো আরও অনেক বিষয় থাকলেও, আমি একটা বই নিয়েই লিখছি আজ।
হক ভাই আর আমার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মাঝে আলোচনা হতো। কিন্তু তার বই যে অনুবাদ করছি তা তখনো বলিনি তাকে। যখন বই অনুবাদ করার কথা বললাম (তখন কিন্তু আসলে অনুবাদ করে ফেলেছি ইতোমধ্যে আমি), তিনি শুনে বলেন, 'তুমি আমার বাসায় চলে আসো'। উনি তখন বনানীর বাসায় থাকতেন। হাতে তখন সিনেমার স্ক্রিপ্টের কাজ বোধহয়। শরীর একটু নাজুক। তিনি ফোনে একজনকে বলছিলেন, 'আমি কিন্তু মাংস খাই না, ডাক্তার মানা করে দিয়েছেন।' বোধহয় হার্টে একটু সমস্যা ছিল তার। ফোন রাখার পর তাকে আমার অনুবাদকৃত কবিতাটি পড়ে শোনালাম। খুব পছন্দ করেছিলেন তিনি।
গল্প করতে করতে একসময় আমরা বাগানে দাঁড়ালাম, বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা নিয়ে অনেক্ষণ গল্প করলেন তিনি আমার সঙ্গে। এদিকে আমার কাজ তো শেষ। তিনি আমার কাজ দেখে বললেন, 'আফসান পারফেক্টলি অলরাইট। তুমি যা করেছো, আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট।'
তারপর অনেকদিন কোনো যোগাযোগ হয়নি, আমিও কানাডা চলে যাই। ২০১২ সালে আবার ফিরে আসি দেশে। আমার অনুবাদের কথা তখন অনেকেই জেনে গেছে। একদিন এডর্ন প্রকাশনার জাকির হোসেইন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনি কি এটাকে বই হিসেবে করতে রাজি আছেন? তখন আমি বললাম, হ্যাঁ, যদি হক ভাই রাজি হয়। হক ভাই রাজি হলেন।
শেষপর্যন্ত যখন কবিতার বইটা বেরোলো, তখন আমার মনে হচ্ছিল, এটা জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি। এরপর একদিন বইটি নিয়ে নিয়াজ জামান ম্যাডাম একটি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলেন আইউইবিতে। সেই অনুষ্ঠানে আমি আর হক ভাই একসাথে বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা পাঠ করছিলাম। হক ভাই পড়ছিলেন বাংলা থেকে, আমি পড়ছিলাম ইংরেজি থেকে। শেষ অংশটা আমার খুব প্রিয় ছিল, বাংলা থেকে হক সাহেব পড়লেন, আমি পড়লাম ইংরেজিটা। 'জন্মে জন্মে বার বার কবি হয়ে ফিরে আসবো আমি বাংলায় …'।
আমরা বিত্তশালী হয়েছি তাঁদের হাত ধরেই...
হক ভাইয়ের ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হক ছিলেন আমার স্ত্রীর ছাত্র। আমাদের বিয়েতে উপহার দিয়েছিলেন হক ভাই।
আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে যেভাবে তিনি মিশেছেন, তা সত্যিই অচিন্তনীয়। এই মানুষগুলো শুধু মিশেই যাননি, আমাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের তুলনায় এত ক্ষুদ্র হয়েও তারা কখনো আমাদের হেয় করেননি।
এই মানুষগুলো কেবল আমদের দিয়েই গেছেন, আমাদের বিত্তবান করেছেন। এটাই সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যগুলোই আমাদের দেশে নানাভাবে নষ্ট হয়ে গেছে এখন। হয়তো আরও নষ্টের দিকে যাবে।
আধুনিক কবি বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন একেবারে সেরকম একজন মানুষ। গ্রামের ছেলে হয়েও, গ্রাম তাকে কিন্তু ধরে রাখেনি। উনি গ্রামীণও না, গ্রাম্যও না। ওনার সাহিত্যে গ্রাম এসেছে, কিন্তু একদম আধুনিক নাগরিক চোখ দিয়ে। বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা ছিল- নগরের কবিতা, একেবারে নাগরিক কেন্দ্রিক। আমি যা একদম অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পেরেছিলাম।
- লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক