আল মাহমুদ: আজকাল চোখে আর অন্য কোনো স্বপ্নই জাগে না
১৯৬৯ সালে, তখন কেবল কলেজে উঠেছি। কলেজের সাহিত্য পত্রিকায় লেখা ছাপানো নিয়ে তখন বেশ ব্যস্ত থাকতে হতো আমাদের। বন্ধুরা মিলে বিভিন্ন লেখক, সাহিত্যিকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতাম তাদের লেখা সংগ্রহের জন্য। আল মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় এই লেখা সংগ্রহ করতে গিয়েই।
যেহেতু ফোনের তেমন সুযোগ ছিল না, তাই গিয়েই দেখা করতে হতো। এভাবেই একদিন লেখা নিতে গিয়েছিলাম আল-মাহমুদের কাছে। তিনি তখন ইত্তেফাকের অফিসে বসতেন। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন, 'কোথা থেকে এসেছ তোমরা?' ঢাকা কলেজের নাম শুনে বললেন, 'তাহলে তো তোমরা মেধাবী ছাত্র'।
এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার দেশ কই'। আমি একটু বিব্রত হলাম। আমার দেশ কই তাতো আমি ভালো করে জানি না। আমি তো ঢাকা শহরেই বড় হয়েছি। কিন্তু জানতাম, নোয়াখালী ছিল আমার বাবার গ্রামের বাড়ি।
যা-হোক, আমাদের সাথে একজন ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। কবি আল মাহমুদের বাড়িও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে। নিজের এলাকার মানুষ পেয়ে তিনি খুশি হয়ে গেলেন। এরপর ওখানেই একটা কবিতা লিখে দিলেন আমাদের জন্য।
তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখাটা এভাবেই হয়েছিল। এরপর তাকে দেখেছি ৭০- এর সময় এক জনমঞ্চে।
মুজিবনগরে কবি
আল মাহমুদ ভাই খুব সহজ সরল মানুষ ছিলেন। আমার ধারণা, তিনি কী করছেন বা বলছেন- তা সবসময় নিজে বুঝতেও পারতেন না। কোনো কাজ করার পর সেটার কী প্রভাব পড়তে পারে, তা তিনি ভেবে দেখতেন না। বেলাল ভাইও তার এরকম একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন একবার। ৭১' এর সময় তিনি যখন কলকাতায় চলে যান, এরপর তার মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরি হয়েছিল। কলকাতার কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তার ভাব ছিল। চাকরি পাওয়ার পর তিনি তাদের বললেন, 'কাউকে বলো না যে আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরি পেয়েছি।'কিন্তু তার দুদিনের মাথায় কলকাতার অর্ধেক কবি-সাহিত্যিক জেনে গেল যে, তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরি পেয়েছেন। সুতরাং কত সাধাসিধা যে ছিলেন এই মানুষটি- তা বোঝা যায়।
আমাদের দেশের কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে কলকাতাপ্রীতিটা খুব প্রবল। এটা আমি খেয়াল করেছি। কলকাতায় গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার একটা অতৃপ্ত ইচ্ছে আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখা যায়। বেলাল চৌধুরী এ ব্যাপারে বলেন, 'আল মাহমুদ কলকাতা থেকে কিন্তু খুব সাড়া পায়। বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে তো কলকাতার মানুষের ধারণা খুব একটা ভালো না। তাই মাহমুদ ভাইয়ের কবিতা তখন তাদের খুব বিস্মিত করলো। বাংলাদেশের মানুষ এত ভালো লেখে!'
কিন্তু আল মাহমুদ ছিলেন অন্যদের থেকে আলাদা। কলকাতার আদলে কখনো নিজেকে গড়তে চাননি। সুশীল মধ্যবিত্ত ধারা থেকে ফিরে এসে তিনি চেয়েছেন নিজের একটা আলাদা ধারা তৈরি করতে। এটা তার কবিতাগুলো পড়ে আমি ধরতে পেরেছিলাম। তার কবিতা এতই স্পষ্ট ছিল যে, এক লাইন পড়েই বলে দেওয়া যেত এটা তার লেখা।
তিনি যে একজন রাজনৈতিক মানুষ, তা কখনো আমার মনে হয়নি
তার সঙ্গে আবার দেখা হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। জাসদ তখন 'দৈণিক গণকন্ঠ' নামে একটি পত্রিকা বের করতো, যা ছিল প্রথম কোনো বিরোধী দলের পত্রিকা। ১৯৭২ সালে আল মাহমুদ তৎকালীন গণকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
সম্পাদক থাকাকালীন সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে জাসদ একটা বড় কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল সে সময়ে। অনেকেই বলে যে গণকন্ঠ চালাতো অন্যরা এবং তাদের সামনে ছিল আল মাহমুদ ভাই। আল মাহমুদ ভাই এত রাজনৈতিক ছিলেন আমার মনে হয় না।
১৯৭৪ সালের ১৭ই মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির সামনে জাসদের উদ্যোগে ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দেয়া হয়। সেদিন রাতেই তৎকালীন গণকন্ঠের সম্পাদক আল মাহমুদ ভাইকে গ্রেফতার করা হয়। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। কারণ মাহমুদ ভাই যে একজন রাজনৈতিক মানুষ, তা কখনো মনে হয়নি। আমাকে একদিন তিনি বলেওছিলেন, 'তুমি লেখো না কেন আমাদের পত্রিকায়'।
আবার যখন গণকন্ঠ চালু করার কথা উঠলো, তখন একটা তালিকা করা হয়েছিল রাজনৈতিক আর অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে। সেখানে কিন্তু আল মাহমুদ রাজনৈতিক হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিলেন।
আল মাহমুদকে জানার জন্য 'মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো' কাব্যগ্রন্থটি খুব গুরুত্বপূর্ণ
পচাত্তরের আগেই মাহমুদ ভাই জেল থেকে ফেরত এলেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যোগ দিলেন শিল্পকলা একাডেমিতে। আগের চেয়ে অনেকখানি নরম হয়ে গেছেন তখন তিনি।
এই মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার ভাব হলো ৭৭ সালে, যখন মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস প্রকল্পে কাজ করছি। এই প্রকল্পে কাজ করার ফলে আমি যে জীবনে কত বড় বড় মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি! কারণ ওখানে কবিরা আসতেন, আড্ডা দিতেন। হাসান হাফিজুর রহমান আসতেন, সৈয়দ শামসুল হক আসতেন, শামসুর রহমান, বেলাল চৌধুরী, ফজল সাহাবুদ্দীন আসতেন। আসতেন তরুণ কবিরাও। ওখানে কোনো রজানৈতিক আড্ডা হতো না। কবি –সাহিত্যিকদের আড্ডাই হতো।
কবি আল মাহমুদও সেখানে আসতেন। তবে একা একা আসতেন, অন্যদের মতো দলবেঁধে আসতেন না। হাসান হাফিজুর রহমানও আল মাহমুদকে একটু অন্য চোখে দেখতেন। সবার থেকে আলাদা, একটু বিশেষ স্নেহের।
মাঝে মাঝে এসে কবিতাও শোনাতেন মাহমুদ ভাই। আবার অনেক সময় আকবর হোটেল থেকে খাবার এনে খেতে খেতে তারা কবিতা নিয়ে আলাপ করতেন। শুরুর দিকে বামপন্থী চিন্তাধারার হলেও, সেখান থেকে সরে এসেছিলেন আল মাহমুদ। গণকন্ঠের জেল থেকে ফিরে এসে 'মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো' তে আল মাহমুদ ভাই তার এই মার্ক্সবাদী চিন্তাকে ত্যাগ করতে চেয়েছেন- সেরকম একটা ইঙ্গিত রয়েছে। একটা কবিতা আছেই যেখানে বৈজ্ঞানিক সমাজের কথা বলেছেন। অর্থাৎ, তিনি যে জাসদের রাজনীতির সঙ্গে আর নেই, তা খুব পরিষ্কার ছিল।
একদিন শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান একসঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। শামসুর রাহমান আর হাসান হাফিজুর রহমান কী কথায় একসঙ্গে বলে উঠলেন, 'আল মাহমুদ যে কাব্যশৈলীতে তার কবিতাকে নিয়ে যেতে পেরেছিল, সেটা অন্যরা পারেনি'।
হাসান ভাই এটাও বলেছিলেন যে, আল মাহমুদের কবিতা পড়ে তার নিজেরই কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত লাগে। এ-ই যে অন্য কবিকে এতবড় করে দেখা, সম্মান দেওয়া , এটা এখন হয় কি-না জানি না। এখন আমাদের দেশে সাহিত্যের আলোচনাও হয়– রাজনীতিকে ঘিরেই। কিন্তু ঐ সময়ে সাহিত্য নিয়েই শুধু আলোচনা করা সম্ভব হতো। সাহিত্যের ভিতর সেখানে রাজনীতি ঢুকে যায়নি।
মাহমুদ ভাইয়ের কবিতা যদি অনুবাদ করতে পারতাম
আল মাহমুদের সঙ্গে এ ছাড়া আর দুইবার দেখা হয়েছিল আমার। একবার আমি শিল্পকলায় গেছি। আমাকে দেখে বললেন, 'আফসান আমার একটা বই বের হবে, আপনি কি আসতে পারবেন?'
আমি বলেছিলাম 'আমি নিশ্চিত না, কাজ থাকতে পারে'। তখন তিনি বললেন, 'সমস্যা নাই আমি আপনাকে একটা বই পড়তে দেব।' খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম, এতবড় কবি কেন আমাকে তার বই পড়াতে চাচ্ছেন??
আরেকদিন প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে দেখি, আমাকে ডাকছেন। ডেকে বললেন, 'আফসান আমার কবিতাগুলো ইংরেজি অনুবাদ করে দেওয়ার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি'।
তখন তাকে বলেছিলাম, বিষয়টা অনুবাদ করার না। আপনার যে কবিতার ভাষা- তা ইংরেজি ভাষায় যায় না। অনুবাদ শুধু ভাষা দিয়ে করলেই হবে না। এখানে সংস্কৃতি ও আবহের বিষয়ও আছে। আপনার কবিতায় যে ভাব, তা সংস্কৃতির সঙ্গে না মিললে ভালো হবে না'।
সে-বার মাহমুদ ভাই দুঃখ পেয়েছিলেন।
কিন্তু, মাহমুদ ভাইয়ের কবিতা যদি করতে পারতাম, খুব ভালো হতো। এই আফসোসটা আমার হয় এখন।
আমি মনে করি, কবিতার ভিতর থাকে একধরনের সঙ্গীত। এই সঙ্গীত আল মাহমুদের কবিতায় যতটা আছে, তা অন্যদের কবিতায় ততোটা নেই। আর অনুবাদ করতে গেলে, শুধু ভাষা ঠিক করলেই হবে না, সংগীতও ঠিক রাখতে হবে। যে কারণে সৈয়দ শামসুল হকের অনুবাদ পুরোপুরি অনুবাদ হয়েছে। কারণ তার কবিতার কাঠামোর সঙ্গে পশ্চিমা কাঠামো অনেকটাই মিলে যায়। কবিতার সংগীতটাও একইরকম। ফলে অনুবাদেও ভাব প্রকাশ পায়। যা আল মাহমুদের কবিতায় সম্ভব হবে না। যে কারণে, আমার মনে হয়েছে পরবর্তীতে কবির চৌধুরীর করা অনুবাদটি মানসম্মত হলেও, মানোত্তীর্ণ হয়নি।
আল মাহমুদ ভাইকে নিয়ে অনেকসময় রাজনীতির আলাপ হয়। কারণ তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এই সম্পৃক্ততা তার কবিতায় কখনো প্রভাব ফেলেনি। একইসাথে তিনি কখনো নিজেও ভোলেননি এবং অন্যকেও ভুলতে দেননি- তার পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ পরিচয়কে। কলকাতায় থেকেও তিনি নিজের শেকড়কে ভুলে যাননি কখনো।
- লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক