জনসমাবেশ সমাধান নয়; রাজনৈতিক দলগুলিকে দেশের জনগণের সংকটের দিকে মনোযোগ দিতে হবে
অনুন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক সংস্কার হয়ে দাঁড়িয়েছে- রাজনৈতিক দলগুলোর কেবলমাত্র লোক সমাবেশ ঘটানো। তাতে সমাজের কতটা ক্ষতি, কতটা কষ্ট- তা তাদের দেখার এবং বোঝার বিষয় নয়। বিগত কয়েক সপ্তাহ যাবত দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল (যদিও সংসদে তারা প্রধান বিরোধী দল নয়)। তাদের সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু, তারপরেও সেই সমাবেশকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, তাদের অনুসারীরা ব্যাপক লোকসমাবেশ যেন না হয়- সেই দিকে মনোযোগী হয়ে উঠেছে। এর ফলে (পরিবহন ধর্মঘট ও অন্যান্য বাধায়) ওই শহরগুলো একরকম অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ সর্বশেষ রংপুরের জনগণ ইতোমধ্যে এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছে।
আগের দিন ও সমাবেশের দিন গণপরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। যদিও সরকারি দল কিংবা সরকারের মুখপাত্ররা সবসময় বলছেন, সরকার গণপরিবহন বন্ধ করে নাই। মানুষ সরকারের এই কথা বিশ্বাস করেনি। দেশের জনগণ খুব ভালোভাবেই জানে, কাদের ইশারায় পরিবহন বন্ধ থেকেছে। মালিক- শ্রমিকদের কথিত এই ধর্মঘটে এবার রংপুরে বিআরটিসি'র বাসও বন্ধ ছিল।
দেশের পরিবহন খাতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নাম রয়েছে যারা পরিবহন ব্যবসায়ীদের নেতা। তাদের মধ্যে আবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিরাও রয়েছেন। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে সামনের দিনগুলো কতটা সংকটময় হবে বা সাধারণ মানুষের জীবন ব্যবস্থার সঙ্গে যে উৎপাদন ব্যবস্থা জড়িত– সেসবের কি অবস্থা দাঁড়াবে তা নিয়ে কেউ ভাবছে না।
নির্বাচন হতে এখনো এক বছর বাকি; এর মধ্যেই প্রধান রাজনৈতিক দল দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে যারা মূলত দেশ শাসনের দায়িত্ব পেয়েছে— তারা জনসমাবেশ ঘটাতে বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। সরকারি দল চেষ্টা করছে জনসমাবেশ ঠেকাতে। এতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে, ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেও ২০১৮ নির্বাচনে সরকারের কূটকৌশলের কাছে হেরে প্রধান বিরোধীরা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও জনসমর্থন যে কমেনি বরং বেড়েছে সেটা প্রমাণের জন্য বিভাগীয় জনসমাবেশ করছে।
বিগত দুটি নির্বাচনের সময় হতেই তারা জোরের সাথে বলে আসছে, এই সংবিধানের অধীনে নির্বাচনের যে ব্যবস্থা বর্তমানে আছে, সেটির পরিবর্তন করে নির্বাচনকালীন সময়ে একটি ভিন্ন ধরনের সরকার ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে।
২০১৪ সনে নির্বাচনের সময় যে আন্দোলন তারা সূচনা করেছিল; যার ফলে দেশে প্রায় কয়েক মাস যাবত একটি অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা চলেছিল, তারা কিন্তু সে রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ফলে সেই নির্বাচন ছিল প্রকৃত অর্থে একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তারপরের নির্বাচনেও আরেকটি ভিন্ন ধারা সূচিত হয়েছিল (কথিত আছে, দিনের ভোট রাতে হয়েছিল)। ফলে সেই নির্বাচনও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি।
নির্বাচন সংক্রান্ত এমনই একটি উত্তরাধিকারের ভেতর দিয়েই আগামী নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনের পূর্বেই সেই অতীত ধারার মতন মাঠ-ময়দান গরম করা, রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার যে প্রচেষ্টা; তাই শুরু করেছে বর্তমানের ক্ষমতার বাইরে থাকা এই রাজনৈতিক দলটি।
বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটির অতীত কর্মকাণ্ড-ও ছিল অনুরূপ। ১৯৯৬ সালে যখন তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পরে ক্ষমতায় এসেছিল- তখন তারা রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য থেকেই ক্ষমতায় উঠে এসেছিল। আবার ২০০৬ সালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছিল। ২০০৬ এর সেই রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে দেশে পর্দার অন্তরালের সামরিক শাসন জারি হয়েছিল। ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলো আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো হারিয়ে ফেলেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনকালীন সময় কিংবা পরবর্তীর ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়কার বিশ্বের সাথে আজকের বিশ্ব ব্যবস্থার অনেক অমিল। একপক্ষীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করার যে সংস্কৃতি সেই সময়ে থেকে গড়ে উঠেছে, তা আজ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
বিশ্বের অর্থনৈতিক সংকট মারাত্মক দিকে এগোচ্ছে। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক দূরাবস্থা দেখা হচ্ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক দুর্বল চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। জনসাধারণের কাছে এতদিন যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা একটি ভুল তথ্য দ্বারা নির্ধারণ করা। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোন ধারণার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার পরিসংখ্যান প্রকাশ করত তা অস্পষ্ট।
বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা বহু আগেই ধরা পড়েছিল, যখন আমাদের রিজার্ভ থেকে টাকা চুরি হয়েছিল। দীর্ঘদিন যাবত আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়নি চীনের ঋণ প্রবাহের ফলে। বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটে আমাদের আবার আইএমএফ এর দ্বারস্থ হতে হলো। ফলে আইএমএফ নির্ধারিত সব কিছুই আমাদের মানতে হচ্ছে। যখন দেশের মিলকারখানায় চাহিদা মতন গ্যাস কিংবা বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে না, তেমনই একটি সময় দেশের সুদ ব্যবস্থার পরিবর্তন আনা কেবলমাত্র ব্যাংকিং স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার উদ্দেশ্যেই হচ্ছে। অর্থাৎ, আইএমএফ তার ঋণের নিশ্চয়তার জন্যই একাজটি করছে।
দেশের জনগণ এক নীরব সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। লোকসমাবেশ ঘটিয়ে নিজেদের জনসমর্থন কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকা নিশ্চিত করা যায় না।
আসন্ন অর্থনৈতিক সংকটের দিকে লক্ষ রেখে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমঝোতার রাস্তায় হাঁটা এই মুহূর্তে প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই ব্রিটিশ রাজনীতির সমস্ত অংক পাল্টে গিয়ে প্রথম একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তিকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আদি-ব্রিটিশরা (শ্বেতাঙ্গরা) কেউই সেই সাহস দেখাচ্ছেন না। ফলে মাত্র ১৪ লাখ অভিবাসী পরিবারের মধ্যে থেকে তাকে নির্বাচিত করা হয়েছে।
পৃথিবীর অনেক দেশই এই অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ এইরকম একটি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে প্রবেশ করার পরেও রাজনৈতিক দল দুটি যেভাবে পরস্পরকে বধ করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে তাতে দেশের সাধারণ জনগণ এক কঠিন সমস্যায় পতিত হবে আগামী দিনগুলোতে।
এরইমধ্যে সরকার প্রধানের কাছ থেকে বেশ কিছু বার্তা এসেছে। খাদ্য সংকটের কথা। এসেছে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে উদ্বিগ্নতার কথা। এসবই একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা লক্ষণ। এখন দরকার দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে একটা সমঝোতায় উপনীত হওয়া। যদিও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। জনগণের ভাগ্য বদলের দায়িত্ব যাদের, তারা জনগণকে আরো সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক