বর্ষবরণ: সিরুয়া বিষুয়া ও চইত বিশমা
বাংলাদেশের নববর্ষের 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' এখন বিশ্ব ঐতিহ্যর অংশ। ইউনেস্কো এই স্বীকৃতি দিয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় জাতি, লিঙ্গ, ধর্ম, বয়স সব মানুষের সম্মিলন ঘটছে প্রতিবছর। গড়ে ওঠছে বৈচিত্র্যের নানা বিভা এবং বিচ্ছুরণ। এভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে ওঠছে আরো অর্ন্তভুক্তিমূলক এক জনসাংস্কৃতিক আয়োজন।
তবে এখনো পহেলা বৈশাখের সকল আয়োজনে প্রবল বাঙালি জাত্যাভিমান জারি আছে। কোনোভাবেই ভুলে গেলে চলবে না, দেশে বাঙালি ভিন্ন আরো ৫০ জাতিসত্তা আছে। তাদের সবার বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের রীতি, কৃত্য ও আয়োজন আছে। সকল কৃত্য-রীতির বর্ণবিভাগুলো কীভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রায় মিশবে সেটি নিয়ে বহু কাজ করবার আছে।
কিন্তু দেশের নানাপ্রান্তের এইসব আয়োজন কতোটা নিরাপদ ও সুরিক্ষত সেই প্রশ্নগুলো আমাদের বারবার জাগিয়ে রাখা জরুরি। চলতি আলাপে আমরা দেশের কয়েকটি একেবারেই অনুল্লেখিত বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের কৃত্য ও আয়োজন বিষয়ে একটা সাধারণ ধারণা নিব।
সিরুয়া বিষুয়া ও বিপন্ন বেলসিরি
২০১৪ সনের জানুয়ারিতে আমার সাথে সাক্ষাত হয় নক্ষমণি মুসোহরের। ঠুমনিয়া শালবনের কাছে ডাঙ্গিপাড়াতে। ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের সৈয়দপুর ইউনিয়নে এক প্রাচীন শালবন ঠুমনিয়া। জঙ্গল দেবতা বেলসিরির থান আছে এই জঙ্গলে। নক্ষমণির সাথে আমার যখন দেখা হয়, বয়স নব্বই ছুঁয়েছে তার। মা গর্ভি ঋষি ও বাবা জংলু ঋষির জন্মও ঠুমনিয়া জংগলের ধারে জানিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন বেলসিরির কথা।
বাংলাদেশের টিকে থাকা বা ক্ষয়ে যাওয়া সবগুলো শালবন এলাকায় গিয়েছি আমি। নাম আছে কিন্তু বন নেই যেমন রাজশাহীর শালবাগান এলাকা বা একটিমাত্র গাছ টিকে থাকা পঞ্চগড়ের বোদেশ্বরী মন্দির- এমন জায়গাতেও গিয়েছি। কিন্তু ঠুমনিয়া ছাড়া দেশের আর কোথাও বেলসিরি/বেলছিরি থান দেখিনি।
গভীর শালজঙ্গলের ভেতর এক প্রাচীন উঁইঢিবিকে ঘিরে এই বেলসিরি থান। মুসোহর সমাজ মনে করে প্রকৃতি অনির্দিষ্ট (বাঙালি সমাজের যেমন শত সহস্র বিশ্বাস এবং ধর্মীয় রীতি ও চিন্তাজগত আছে, তেমনি প্রতিটি জাতিসত্তা ও সমাজের হয়তো আছে। ঠিক তেমনি দেবতাও অনির্দিষ্ট। বেলসিরিকে অরণ্য রক্ষক বা জঙ্গল দেবতা হিসেবে মান্য করা হয়। মুসোহররা বেলসিরিকে তাদের ভাষায় জঙ্গলের মাথিক (মালিক) বলেন।
একটি বেলসিরি থানে আরও বহু দেবতার স্থল থাকে। ঠুমনিয়া শালবনের বেলসিরি থানে বেলসিরির সাথে মালসুর, বিষরি, মাষনা, উড়ানটিয়া, বনকালী ও কালীর স্থল আছে। কারোর কোনো মানত থাকলে এখানে পূজাকৃত্য হয়। তবে বছরে বৈশাখ মাসে বেলসিরিতে সামাজিকভাবে সিরুয়া বিষুয়া কৃত্য আয়োজন করা হয়।
ফাল্গুন-চৈত্র থেকে শালবনে নতুন পত্র-পুষ্প-পল্লবে সাজে প্রকৃতি। আর প্রকৃতির এই পরিবর্তনকে সামাজিকভাবে উদযাপন করে মুসোহর সমাজ। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং সমষ্টির মঙ্গল কামনায় এবং সুস্থতার আশায় সামাজিকভাবে সিরুয়া বিষুয়া পরবে অংশ নেয় সকল বয়সী নারী-পুরুষ, শিশু-প্রবীণ। সামাজিকভাবে খিচুরি-ভোজের আয়োজন হয় এবং গ্রীষ্মকালের নতুন ফলফলাদি গ্রহণ করা হয়। বিশেষ করে কাঁচা আম। সিরুয়া বিষুয়া পরবের আগে কাঁচা আম ভক্ষণ নিষেধ।
মুসোহর সমাজ কেবল জাতিগতভাবেই নয়, সামাজিকভাবেও অচ্ছ্যুত প্রান্তিক। সমাজ এদের 'নিচু জাত' মনে করে। কিন্তু প্রকৃতি সংরক্ষণ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে দেশ স্বাধীনের প্রতিটি পর্বে মুসোহররা জীবন দিয়ে লড়েছে। এমনকি খুব অল্প দ্রব্য ব্যবহার করে মুসোহরদের বেঁচে থাকার এক বিস্ময়কর সামাজিক অভ্যাস আজ জলবায়ু-বিপন্ন দুনিয়ার জন্য এক শ্রেষ্ঠ উপহার।
কুকরি বনের ধারে চইত বিশমা
দিনাজপুরের বিরলে কুকরি শালবনের ধারে হালজায় মৌজায় এক ছোট্ট গ্রামে থাকে কড়া সমাজ। বিরলের হালজায়-ঝিনাইকুড়ি কড়াদের বড় গ্রাম। এই গ্রামে কড়াদের সংখ্যা একশর কাছাকাছি। এছাড়া বিরলের বৈরাগী পাড়াতে এক পরিবার ও ঘুঘুডাঙ্গায় ৩ পরিবার আছে। ফাল্গুন-চৈত্রে জনরা, ঘাঙরা, মেরূয়া, গহুম (গম) তোলা শেষ হতো এবং কড়া সমাজ প্রস্তুতি নিত বর্ষবিদায় ও বরণের উৎসবের।
বর্তমানে আগের দিনের ফসল সব হারিয়েছে। কড়াদের জমিজমা সব দখল করেছে বাঙালি সমাজ। চারদিকে কৃষিজমি নাই, সব লিচুর বাগান হয়ে গেছে। তারপরও কিছু জমিনে গম আবাদ হয় এবং গম তোলার পর বর্তমানে নিয়ম পালনের মতো করে বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্য পালিত হয়।
চৈত্রসংক্রান্তিতে চইত বিশমা পরব শুরু হয়। গ্রামের কিশোর, যুবক এবং মধ্যবয়স্ক পুরুষেরা মিলে একটি শিকারের দল গঠন করে। দলপ্রধানকে হেট বলে। এরা নিয়মরীতি পালন করে তীরধনুক নিয়ে শিকারে বের হয়। আগের দিনে কুকরি বনের বিস্তার অনেক হলেও এখন বনটি শীর্ণ আর কড়াদের বনে প্রবেশ করতেও দেয়া হয়না। কড়ারা জমিন, গ্রামীণ ঝোপ, কবরস্থান ঘুরে বড় ইঁদুর বা খুব বেশি হলে দুয়েকটা বুনো খরগোশ শিকার করে গ্রামে ফিরে। দলের প্রথম যিনি শিকারের গায়ে তীর লাগাতে পারেন তাকে মাংশের এক ভাগ বেশি দিতে হয়।
কিন্তু এসব নিয়ম এখন আর নেই। এখন দশ বারো জনের একটি দল সারাদিন ঘুরে কয়কটি ইঁদুর শিকার করতে পারেন। সন্ধ্যায় গ্রামে ফিরে সবাই মিলে সেই ইঁদুর মাংশ দিয়ে 'মুসা-খিচরি' রান্না করে সামাজিক ভোজে অংশ নেন।
এছাড়া চইত বিশমার দিনে যখন মেয়ে ও নারীরা আশেপাশের ঝোপ-জংগল ও জমির আইল কি বিল থেকে ২১ জাতের বুনো শাক সংগ্রহ করেন। এর ভেতর তিতারি (তিতা গিমা) অবশ্যই থাকতে হয়। তিতারি, কচু, কেথুয়া, ঢুলপি, কাটাখুঁড়িয়া, পিপারপাক, নিম পাতা, চকরা, খাপড়া, পেইলা, ঢেকিয়া, কেওয়াঘড়ি ও শুণশুনিয়া শাক গুলি সাধারণত থাকে। এই ২১ পদের শাক একত্রে রান্না করা হয় এবং সকালে এই শাক ভাতের সাথে খাওয়া হয়।
কড়ারা বিশ্বাস করে একটি বছর থেকে আরেকটি বছরে যাওয়ার আগে প্রকৃতি থেকে নানা স্বাদের সঞ্জীবনী সুধা গ্রহণ করতে হয়। (আবারো হয়তো সাধারণভাবে কড়ারা বিশ্বাস করে লিখে একই উপনিবেশিক ভুল ও বাহাদুরি করছি, কিন্তু এতটুকু লেখার জন্য কড়া গ্রামে অনেকের সাথেই দলগত আলাপ হয়েছে। জানি তারপরও বিশ্বাস ও চিন্তাকে সাধারণীকরণ করা ঠিক নয়)। এসব বুনো শাকলতা সারাবছরের জন্য শরীরে বল তৈরি করে এবং স্বাস্থ্য ভাল রাখে।
চইত বিশমার দিনে গ্রামের সবার মঙ্গল কামনা এবং ফসল, শিকার এবং একটি বছর নিরাপদে পাড়ি দেওয়ার জন্য কালী মারাক থানে পূজা দেয়া হয়। এই থানে গাও রাউখাল, কালী, হলুমান, বাংসিং, কারাম, ধারাম, পারবতীর থান থাকে। চউত বিশমার দিনে বাড়ির ভেতরে 'ঘাড়কে পিড়া (ঘরের থান)' লেপে মুছে এখানেও নৈবেদ্য দেয়া হয়।
বিদায় ও বরণের সন্ধি
বৈশাখে ভাটিপরব, জৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে কর্মাদি, শ্রাবণে করন্ডি, ভাদ্রে কারাম, আশ্বিনে দাসাই, কার্তিকে জালাবর্ত, অগ্রহায়ণে ওয়ান্না, পৌষে পুষরা, মাঘে বাঘাই শিরণী, ফাল্গুনে ঘাটাবান্ধা আর চৈত্রে চইতপরব বা চৈত্রসংক্রান্তি। একেক ঋতুতে প্রকৃতি নানা প্রাণের ভেতর দিয়ে তার সমাপণী ও শুরুর নির্দেশনা জানায়।
প্রকৃতির নয়া শস্য ফসল গ্রহণ ও ব্যবহারের জন্য অনুমতি প্রার্থনা ও আর্শীবাদের তরে নানা সমাজ আয়োজন করে নানা কৃত্য। ফাল্গুন-চৈত্রে ভাঁট, ভাটজরা বা বিজু ফুল, শাল, মহুয়া, মিষ্টিকুমড়া, বিলিম্বি, ভেন্না, আমরুল, নাগেশ্বর, পলাশ, কাঁঠালিচাপা, দোলনচাঁপা, কনকচাঁপা ফুটে। মাঠেঘাটে তিতাশাকের বিস্তার হয়। তিতা, টক, মিঠা, নোনতা, ঝাল নানা স্বাদের পত্র-পুষ্প-ফল দেখা দেয় প্রকৃতিতে। বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্য ও পরব গুলি ঋতুর এই নয়াস্বাদ গ্রহণের অনুমতি প্রার্থনা করে এবং এসব গ্রহণের ভেতর দিয়ে আগামী দিনের জন্য নিজের শরীরকে প্রস্তুত করে।
নাটোরের চলনবিল অঞ্চলের বাগদী সমাজ চৈত্রসংক্রান্তির দিন নীলকন্ঠ পূজা করে। বৈশাখের প্রথম দিনে গোয়ালঘরে আয়োজন করে 'দুধ-উদলানো' কৃত্য। গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে সেই দুধ গোয়ালঘরের মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়। বছরের প্রথম দিনে এভাবেই ভূমিজননীকে দুধ দিয়ে নতুনবার্তা বয়ে আনবার আহবান জানায় বাগদী সমাজ। যাতে বছর জুড়ে গোয়ালভরা সুস্থ দুধেল গরু থাকে, সংসারের আয় রোজগার ভাল হয়, সংসারের মঙ্গল হয়।
রবিদাসদের ভেতর হাজরা-কৃত্যের মাধ্যমে বর্ষবিদায় পালিত হয়। এদিন যবের ছাতু ও কাঁচা আম একত্রে মিশিয়ে আম-ছাতুয়া খাওয়া হয়। মৌসুমি ফল আমকে বর্ষবিদায়ের এ রীতির ভেতর দিয়েই সমাজ গ্রহণ করে। বছরের প্রথম দিন ঘরের দেওকুড়ি নামের পবিত্রস্থলে কর্মের পূজা করা হয়। রবিদাসদের ভেতর যে যে কর্মপেশায় জড়িত তারা সেই কর্মের সাথে জড়িত আনুষঙ্গিক উপকরণগুলো দেওকুড়িতে রাখে। হাতুড়ি, কোদাল, শাবল, কাঁচি, ছুরি, বাটাল যার কর্মে যা লাগে সব। এ সময় ঢোল, খাজরি, ঝাঁজ বাজানো হয়।
রবিদাসদের ভেতর এসময় বাইশাখী পূজাও পালিত হয়। আদিবাসী বেদিয়া-মাহাতোরাও চৈত্রসংক্রান্তির দিন বথুয়া, কাঁটাখুঁড়ে, গিমাসহ নানান জাতের তিতাশাক খায়। বর্ষবিদায় ও বরণের কৃত্য হিসেবে মুন্ডারা গ্রামপূজা হিসেবে পালন করে মুড়ই কৃত্য। প্রতিটি মাসের শেষ এবং আরেকটি নতুন মাসের শুরুর যে সন্ধিক্ষণ এটি এই বাংলা অঞ্চলের নিম্নবর্গের সমাজে খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। আর একে ঘিরেই বিকশিত হয়েছে জনসংস্কৃতির নানা আয়োজন। গীতরঙ্গের নানা ব্যঞ্জনা।
বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সন্ধিক্ষণের সব কৃত্য ও আয়োজন তাই অনেকখানি সন্ধি বা মিতালি করেই যেন বিন্যস্ত ও বিরাজিত হয়েছে। সন্ধিক্ষণের সাথে বৈরিতা নয়, করতে হবে সৃজনশীল সন্ধি। আর সন্ধি করবার জন্য ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার জাগিয়ে রাখতে হবে।
- লেখক: গবেষক ও লেখক।
- ই-মেইল: [email protected]