ডেঙ্গু প্রতিরোধে টিকার ভূমিকা: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাস কয়েক দশক ধরে উপস্থিত থাকলেও এর প্রকোপ বৃদ্ধি পায় মূলত ২০১৯ সাল থেকে এবং এ বছর সেটি ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। ২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত এই চার বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১ লাখ ৯২ হাজার ২৭৭ জন এবং ৫৪১ জন। এ বছর প্রথম ৯ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ২ লাখ ৬ হাজা ২৮৮ জন এবং ১ হাজার ৬ জন! ডেঙ্গু প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আগামী বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি এর চাইতেও খারাপ হতে পারে।
যেকোনো সংক্রামক রোগ সাধারণত দুইভাবে প্রতিরোধ করা যায়—যে জীবাণুর মাধ্যমে রোগটি সৃষ্টি হয় সেটির উৎস ধ্বংস করে এবং সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে টিকা প্রয়োগ করে। ডেঙ্গু ভাইরাস যেহেতু শুধু এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে, সেহেতু ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে এডিস মশা নিধন এবং ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা প্রয়োগ, দুটোই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ এবং ডেঙ্গুর টিকা প্রয়োগ একে অপরের বিকল্প নয়, সম্পূরক। শুধু মশা নিয়ন্ত্রণ করে অথবা গণহারে টিকা প্রদান করে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। সুনির্দিষ্ট কিছু কারণে মশা নিয়ন্ত্রণ যেকোনো দেশের জন্য কঠিন একটি কাজ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, বনাঞ্চল ধ্বংস করে অপরিকল্পিত নগরায়ন, আকাশপথে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার সুবিধা, কীটনাশকের বিরুদ্ধে এডিস মশার দ্রুত প্রতিরোধী হয়ে ওঠার প্রবণতা, লার্ভার মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাসের এক প্রজন্মের মশার শরীর থেকে পরবর্তী প্রজন্মের মশার দেহে স্থানান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি কারণে বিশ্বের অনেক দেশ মশা নিয়ন্ত্রণে সাময়িকভাবে সফল হলেও দীর্ঘমেয়াদি সুফল পেতে ব্যর্থ হচ্ছে। মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত রাসায়নিক কীটনাশক প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং অন্যান্য প্রাণীর জন্য ক্ষতিকারক। সুতরাং, যথেষ্ট পরিমাণ মজুত থাকা সত্ত্বেও একই এলাকায় বারবার কীটনাশক প্রয়োগ করা যায় না। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগের বিকল্প হিসেবে প্রাকৃতিক উপায়ে, যেমন পরিবেশে মশা ভক্ষণকারী মাছ কিংবা মশার লার্ভা ধ্বংসকারী ব্যাকটেরিয়া ছেড়ে দিয়ে, মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। যদিও এই পদ্ধতিগুলো এখনও বড় পরিসরে সাফল্যের মুখ দেখেনি।
আমাদের কাছে মশা স্রেফ একটি ক্ষতিকারক পতঙ্গ মনে হলেও এটি প্রাকৃতিক খাদ্যচক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মশা অসংখ্য উদ্ভিদের পরাগায়ন ঘটায়, অন্য অনেক প্রাণী মশাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। কোনো দেশ যদি এডিস মশাকে কোনোভাবে নির্মূল করতে সক্ষমও হয়, তাহলে তা প্রকৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। শুধু মশা নিধনের মাধ্যমে যে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তার বাস্তব উদাহরণ হলো সিঙ্গাপুর। মশা নিধনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকার দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নেওয়ার ফলে গত ৫০ বছর ধরে সিঙ্গাপুরে এডিস মশার হোম ইনডেক্স একের নিচে। অর্থাৎ প্রতি ১০০ বাড়িঘরের মধ্যে ১টির কম বাড়িঘরে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। তারপরও বিগত ১৫-২০ বছর যাবত সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ২০২০ সালে দেশটির ইতিহাসে সর্বাধিক পরিমাণ ডেঙ্গু সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এর পিছনে মূল কারণ একটি নির্দিষ্ট এলাকায় দীর্ঘ সময় ডেঙ্গু ভাইরাস মানুষের সংস্পর্শে না আসার কারণে সেই এলাকার অধিবাসীদের দেহে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সৃষ্ট অ্যান্টিবডির পরিমাণ কমে যাওয়া। ফলে বর্তমানে সিঙ্গাপুরের কোনো এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হলে তা দ্রুত ছড়িয়ে গিয়ে স্বল্প সময়ে অধিকসংখ্যক মানুষের দেহে সংক্রমণ সৃষ্টি করছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এডিস মশা নিধনের পাশাপাশি ডেঙ্গুর টিকা প্রয়োগ করে মানুষের দেহে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করাই এই রোগ প্রতিরোধ করার সর্বোত্তম উপায়।
যেকোনো টিকা আবিষ্কার করা থেকে শুরু করে সেটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করার প্রক্রিয়াটি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। ডেঙ্গুর টিকার ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। সুতরাং একটি কার্যকর ডেঙ্গুর টিকার এই চারটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধেই দীর্ঘ মেয়াদে যথেষ্ট পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি করার ক্ষমতা থাকতে হবে। ডেঙ্গু ভাইরাসের লক্ষণ প্রকাশের হার খুব কম। ডেঙ্গু ভাইরাসে একশোজন মানুষ আক্রান্ত হলে তাদের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ জনের ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সুতরাং, ডেঙ্গুর টিকা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেটি পূর্বে ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত এবং আক্রান্ত নয়, দুই ধরনের মানুষের দেহেই কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ব্যতীত প্রয়োগ করা যায়। ডেঙ্গু ভাইরাস শুধু মানুষের দেহে রোগ সৃষ্টি করে। সুতরাং, অন্য প্রাণীর দেহে প্রয়োগ করে এই টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ ধারণা লাভ করা সম্ভব হয় না। এতগুলো প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে গবেষকরা কয়েক দশক ধরে ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই মুহূর্তে বিশ্বে দুটো ডেঙ্গুর টিকা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে এবং আরও কয়েকটি টিকা বিভিন্ন পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে।
ডেনভেক্সিয়া
ফ্রান্সের প্রখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি সানোফির তৈরি এই টিকাটি বিশ্বে অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রথম ডেঙ্গুর টিকা। ২০১৫ সালে মেক্সিকোতে এটি প্রথম অনুমোদন লাভ করে। ২০১৯ সালে এটি যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএর অনুমোদন পায়। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রি-কোয়ালিফাইড টিকা। বর্তমানে এটি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, মেক্সিকো, এলসালভেদর, সিঙ্গাপুর, কোস্টারিকা, ফিলিপাইন, কলম্বিয়া, অস্ট্রেলিয়া, এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে অনুমোদনপ্রাপ্ত।
এই টিকার মোট তিনটি ডোজ—প্রথম ডোজের ৬ মাস পর দ্বিতীয় এবং ১ বছর পর তৃতীয় ডোজ নিতে হয়। প্রতি ডোজের মূল্য আনুমানিক ৯৯ মার্কিন ডলার।
এই টিকার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন এটি কেবল ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সি শিশুদের দেওয়া যাবে এবং টিকা দেওয়ার আগে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে টিকাগ্রহীতার আগে একবার ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছিল কি না। পূর্বে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরই কেবল এই টিকা দেওয়া যাবে। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপের মধ্যে ডেন-২ সেরোটাইপের বিরুদ্ধে এই টিকার কার্যকারিতা অন্য সেরোটাইপগুলোর চাইতে কম।
কিউডেঙ্গা
জাপানের প্রখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি তাকেদার তৈরি এই টিকাটি বিশ্বে অনুমোদনপ্রাপ্ত দ্বিতীয় ডেঙ্গুর টিকা। ২০২২ সালে ইন্দোনেশিয়ায় এটি প্রথমবারের মতো অনুমোদন পায়। বর্তমানে এটি ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, লিখটেনস্টাইন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে অনুমোদনপ্রাপ্ত।
এই টিকার মোট দুইটি ডোজ—প্রথম ডোজের ৩ মাস পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়। প্রতি ডোজের মূল্য আনুমানিক ৪০ মার্কিন ডলার। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্ট্যাটিস্টিক এডভাইজরি গ্রুপ অভ এক্সপার্টস অন ইমিউনাইজেশন ডেঙ্গুপ্রবণ অঞ্চলে ৬ থেকে ১৬ বছরের শিশুদের এই টিকা প্রদানের পরামর্শ দিয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ডেন-২ সেরোটাইপের বিরুদ্ধে এই টিকার কার্যকারিতা অন্য সেরোটাইপগুলোর চাইতে বেশি।
টিভি-০০৩ এবং টিভি-০০৫
আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অভ হেলথ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় প্রায় ২০ বছর ধরে এই টিকাটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে এই টিকার দ্বিতীয় ধাপের একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছিল। সম্প্রতি ল্যানসেট জার্নালে সেই ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে যা সার্বিকভাবে বাজারের বাকি দুটো ডেঙ্গু টিকার চাইতে কার্যকর হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই টিকা ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধেই অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এবং ৩ বছর পর্যন্ত ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হননি। এটি সব বয়সিদের (১–৫০) ক্ষেত্রে মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কোনো জটিলতা সৃষ্টি করেনি। কেউ পূর্বে ডেঙ্গু আক্রান্ত হোক বা না হোক, সবাইকে এই টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। এটির মাত্র একটি ডোজ। আবিষ্কারক সংস্থা এই টিকা বিশ্বের ডেঙ্গুপ্রবণ কয়েকটি দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করার অনুমতি দিয়েছে, যাদের মধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অন্যতম। সুতরাং, আগের দুটো টিকার তুলনায় এর দাম নিশ্চিতভাবে কম হবে। ভারত, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়ায় এই টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালও সন্তোষজনক ফলাফল দিয়েছে।
গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে সামনের বছরগুলোতে বাংলাদেশে ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের মশা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ডেঙ্গুর টিকাদানকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার কর্তৃক ডেঙ্গুর টিকা আমদানির অনুমোদন প্রদান, দেশের অভ্যন্তরে ডেঙ্গুর টিকার বিভিন্ন পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করা, ভবিষ্যতে স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গুর টিকা উৎপাদন করা—এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করলে আমরা আগামীতে কার্যকর উপায়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে সক্ষম হব বলে আশা করা যায়।
- লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভাইরোলজি; শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, ঢাকা