স্কুল মানে শুধু পড়াশোনা শেখা নয়, স্কুল মানে স্বপ্ন দেখা
নতুন করে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পরপরই মানুষ সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে। শুধু যে অভিভাবকরাই উদ্বিগ্ন, তা নয়। শিশুরাও খুব ভাবনায় পড়ে গেছে। শিশুরা ভাবছে তাহলে কি আমরা নতুন বই হাতে পেয়েও স্কুল যেতে পারবো না? আবারো বন্দী হয়ে থাকবো গৃহকোণে? পরিবারের কিশোরী মেয়েটি ভাবছে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে আমারও কি এবার বিয়ে হয়ে যাবে? দরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোর ছেলেটি ভাবছে আমাকে কি আবার কাজে চলে যেতে হবে?
শহরের স্কুলে পড়া নয় বছরের শিশু নয়নতারা ওর নানুকে জিজ্ঞেস করে বসলো, "আচ্ছা নানু আমরা কি এইভাবেই অনলাইনে ক্লাস করে করে এমএ পাশও করে ফেলবো?" নয়নতারার সবচেয়ে বড় দুঃখ ও নতুন ক্লাসের কোনো বন্ধুকে আর শিক্ষককে ঠিকমতো চিনতেই পারলো না গত দুইবছরে। এমনকি লাইনে দাঁড়িয়ে আমার সোনার বাংলা গানটাও গাইতে পারছেনা।
ওমিক্রন চলাকালেও নয়নতারার মতো শিশুদের যেন ক্লাসে ফিরে যাওয়া বন্ধ না হয় সে ব্যাপারে জোরেশোরে মুখ খুলেছে ইউনিসেফ। তারা প্রতিটি দেশের সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে যে সরকার যেন যেকোন মূল্যে দেশের স্কুলগুলো খোলা রাখেন। শিশুদের পড়াশোনা যেন আর বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
স্কুলে না যাওয়া মানে কিন্তু শুধু পড়াশোনা না শেখা নয়। স্কুলে না যাওয়া মানে মন খারাপ হওয়া, অসামাজিক হয়ে পড়া, দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়া, বন্ধু হারিয়ে ফেলা, খেলতে না পারা, টিফিন ব্রেক না পাওয়া, জাতীয় সঙ্গীত গাইতে না পারা, শিক্ষককে চিনতে না পারা, মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া, একা হয়ে পড়া, ঘরবন্দী হওয়া, শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়া, কারখানার কাজে যোগ দেওয়া এবং সবচেয়ে বড় ক্ষতি পড়াশোনা শতভাগ শিখতে না পারা। বিশেষ করে প্রান্তিক শিশু-কিশোররা সব হারিয়ে ফেলেছে স্কুলে যেতে না পেরে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিপর্যয় এড়ানোর জন্য স্কুলগুলো খোলা রাখতেই হবে বা খুলে দিতে হবে, শিক্ষকসহ সব স্টাফের টিকার ব্যবস্থা করতে হবে, শিশুদের জন্য টিকা যখন সুলভ হবে, তখন তাদের টিকাগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, এর আগে নয়। মাস্ক পরা ও হাত ধোয়া হবে বাধ্যতামূলক। শিশুদের স্কুলে রাখার জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
২০২০ সালে করোনা শুরু হওয়ার পর ২০২১ এর সেপ্টেম্বরে এসে ইউনিসেফ বলেছিল বাংলাদেশের ৩ কোটি ৭০ লাখ বা ৩৭ মিলিয়ন শিশুর জীবন ঝুঁকিতে পড়ে গেছে শুধু এই করোনার কারণে। এশিয়াতে এই সংখ্যা ৮০ কেটি বা ৮০০ মিলিয়ন।
আমরা দেখছি অফিস আদালত, বাজার, মেগা শপ, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পর্যটন কেন্দ্র, পরিবহণ, বাণিজ্যমেলা, বিয়েবাড়ি সব খোলা। লাখ লাখ মানুষের সমাগম হচ্ছে সর্বত্র। এমনকি বাচ্চারাও বাবা মায়ের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। তাহলে স্কুল কী দোষ করলো?
অথচ একটা দেশে স্কুল হওয়া উচিৎ সেই প্রতিষ্ঠান, যা সবচেয়ে পরে বন্ধ হবে এবং সবচেয়ে আগে খুলবে। আর তা বলবৎ করার জন্য যা যা দরকার তা সরকারসহ সবাই করতে বাধ্য থাকবে। আমাদের জন্য ২০২২ এমন আরেকটি বছর হওয়া উচিৎ নয়, যা পড়াশোনাকে আবার বন্ধ করে দেবে। বরং ২০২২ হোক সেই বছর, যে বছর শত প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে বাচ্চারাই ¯স্কুলে যাবে। যে বছর কোনো মেয়েশিশুর বিয়ে হবেনা এবং কোনো শিশুকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে কাজে যেতে হবে না।
১৮ মাস পর স্কুল খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেল। যেখানে আমাদের উচিৎ এমন কৌশল ব্যবহার করা যাতে শিশুদের ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়, বিশেষ করে সবচেয়ে সুবিধাবঞ্ছিত শিশুদের, সেইখানে সব খোলা রেখে কেন স্কুল বন্ধ করলাম?
শিক্ষাখাতের ভয়াবহ দুর্দশার কথা মনে করেই বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট যথার্থই বলেছেন, এখন সময় হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য সর্বোচ্চ বিনিয়োগের। সেইসাথে গ্রাম ও শহরের মধ্যে এবং দরিদ্র ও স্বচ্ছল শিশুদের মধ্যে ডিজিটাল ফারাক কমিয়ে আনার।
প্রমাণিত হয়েছে যে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়ানো মানে দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, সমৃদ্ধি এবং উন্নয়ন তরান্বিত হওয়া। তাই এখুনি সরকার, বেসরকারি সংস্থা, বিদেশী সাহায্যদাতা সংস্থা, প্রাইভেট কোম্পানির উচিৎ সবাই একতাবদ্ধ হয়ে নিজেদের প্রয়োজনে শিক্ষার বর্তমান নিম্ন অবস্থা থেকে নিজেদেরকে টেনে তোলা।
স্কুল বন্ধ থাকাতে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি কতোটা হলো বা শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে দুর্বল হয়ে পড়লো, এরচেয়েও বড় আলোচনা হতে পারে এদেশের অসংখ্য শিশু ও কিশোরীর স্বপ্ন ভাঙার গল্প নিয়ে। আমরা হয়তো অনেক চেষ্টা করে অর্থনৈতিক অবস্থার পুনর্গঠনসহ শিক্ষা ব্যবস্থাকে দাঁড় করাতে পারবো। কিন্তু আমরা কি ফিরিয়ে দিতে পারবো ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপে 'হ্যাট্রিক কন্যার' খ্যাতি পাওয়া মেয়েটির অর্জন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়ারের পদক নিয়েছিল যে মেয়েটি, সেই মেয়েটিও আজ ফুটবল বাদ দিয়ে সংসার সামলাচ্ছে। শুধু সে একা নয়, তার বিদ্যালয়ের ৭ জন কিশোরী ফুটবল খেলোয়াড়ও এখন ফুটবল না খেলে সংসার করছে। কারণ করোনাকালে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে।
করোনা মহামারির সময় কিছু ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হতে পারে- এমন শঙ্কা থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুলগুলোতে কয়েক দফা চিঠি পাঠিয়ে এমন বিয়ে রোধের বিশেষ নির্দেশনা দেয় ২০২০ ও ২০২১ সালে। কিন্তু তারপরও যে তথ্য পাওয়া গেছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। শতকরা ৫১ জন মেয়ের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর দেশের বহু স্কুলে নবম/দশম শ্রেণীতে ছাত্রী ছিলই না বলতে গেলে। অধিকাংশেরই বিয়ে হয়ে গেছে।
সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী ঝরে পড়েছে বরগুনা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি এবং লক্ষীপুরে। বিয়ে হয়ে গেছে শতকরা ৫০ ভাগ মেয়েশিশুর, তাদের বয়স ১৬ থেকে ১৭। শতকরা ৪৮ ভাগের বয়স ১৩ থেকে ১৫ এবং শতকরা ২ জনের বয়স ১০ থেকে ১২ বছর। শতকরা ৭৮ ভাগ বিয়ে দিয়েছে বাবা মা এবং শতকরা ৩৫ ভাগ বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছে ম্যারেজ রেজিষ্টার দ্বারা।
এদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার শতকরা ১৭ ভাগ। আর মাধ্যমিক পর্যায়ে শতকরা ৩৭ ভাগ। তবে করোনায় এ সংখ্যা বেড়েছে বলে আশঙ্কা করছে সরকার। শুধুতো বিয়ে নয়, যে শিশুরা কাজে চলে যায় পড়া বাদ দিয়ে, তারাও আর স্কুলে ফিরে আসতে পারেনা।
এদিকে করোনার সময়ে দেশের অনেক কিন্ডারগার্টেন এবং নন-এমপিও স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে বাংলা মাধ্যমের কিন্ডার গার্টেন আছে ৪০ হাজার। এর বেশিরভাগই প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এরমধ্যে করোনার সময়ে আর্থিক দুরবস্থার কারণে ১০ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং গরিব ঘরের সন্তানরাই এইসব কিন্ডারগার্টেনে পড়াশুনা করে। বন্ধ হয়ে যাওয়া এই ১০ হাজার স্কুলের শিক্ষার্থীদের অনেকেই আর স্কুলে ফিরবে কিনা সন্দেহ।
বাল্যবিয়ে রোধে জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা (২০১৮-২০৩০) গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু আবার স্কুল বন্ধ দিলে এই পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। এমনিতেই করোনার জন্য বাল্যবিয়ে বন্ধের লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে দেশ।
সরকারের কর্মপরিকল্পনায় ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু ২০২০-২১ সালে এই হার কতটুকু কমেছে বা বেড়েছে, তার হিসাব পাওয়া যায়নি।
দেশজুড়ে মোট ঝরে পড়া স্কুল ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা কতো তা নিয়ে এখনো সরকারি বা বেসরকারি কোনো জরিপ হয়নি। এটা করা জরুরি। করোনাকাল, স্কুল বন্ধ, ছাত্রছাত্রীদের সার্বিক ক্ষতি এবং বিশেষ করে ঝরে পড়া এগুলো ঠেকানোর জন্য পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে যথার্থ জরিপের মাধ্যমে। এরপর থেকে কোন সমস্যা হলেও শিক্ষা কার্যক্রম যেন চালু থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
স্কুল বন্ধ বা থাকুক, শিক্ষা সব শিশুর মৌলিক অধিকার। দেশব্যাপি দীর্ঘস্থায়ী স্কুল বন্ধ, বাল্যবিয়ের অধিক হার, শিশুশ্রম বৃদ্ধি এবং প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষার স্বল্প প্রবেশাধিকার শিক্ষাখাতের সরকারের যুগব্যাপী অর্জনকে নিমিষেই হটিয়ে দিয়েছে।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন