যুদ্ধের সময় কেন স্বর্ণের দাম বাড়ে? স্বর্ণে বিনিয়োগের উপযুক্ত সময় কি এখনই?
যেকোনো ধরনের বৈশ্বিক সংকটে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি সাধারণ একটি ব্যাপার। রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধবিগ্রহ, মহামারি কিংবা জরা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সবসময়ই ডলারের মূল্য কমে যাওয়া এবং স্বর্ণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও এর ব্যতিক্রম নয়। চলমান এই সংকটের আগে, এ বছরের জানুয়ারিতে স্বর্ণের দাম ছিল ১ হাজার ৮৩৭.৪৩ মার্কিন ডলার। অথচ ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের পর চলতি এপ্রিলের ১৫ তারিখ অনুযায়ী, মূল্যবান এই ধাতুর দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৭৪.৯০ মার্কিন ডলারে। অর্থাৎ, মাত্র সাড়ে ৩ মাসের ব্যবধানে আউন্স প্রতি দাম বেড়েছে ১৩৭.৪৭ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ হাজার টাকারও বেশি। উল্লেখ্য, প্রতি আউন্সে স্বর্ণের পরিমাণ ২৮.৩৫ গ্রাম (প্রায়)। সেই হিসেবে ১ আউন্স পরিমাণে প্রায় ৩ ভরি স্বর্ণ ওঠে।
এখন প্রশ্ন হল, বৈশ্বিক মন্দা বা অস্থিতিশীলতার সময় কেনো স্বর্ণের দাম বাড়ে? সহজ উত্তর, স্বর্ণকে 'নিরাপদ বিনিয়োগ' হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বৈশ্বিক মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলার হল লেনদেনের প্রধান মানদণ্ড। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক লেনদেনের বেশিরভাগই হয়ে থাকে মার্কিন ডলারে। এমনকি স্বর্ণের দামও এই মুদ্রাতেই নির্ধারিত হয়। তাই যখন বিশ্বে কোনো সংকট দেখা দেয়, সেই সংকটের প্রভাবে যখন ডলারের মূল্য কমতে থাকে, তখন বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাগজি মুদ্রার বদলে স্বর্ণ কিনে মজুদ করতে থাকে। এর ফলস্বরূপ দাম বেড়ে যায় স্বর্ণের।
ডলারের প্রতি আস্থা কমে যাওয়ার সঙ্গেই সঙ্গেই স্বর্ণের দিকে ঝুঁকে পড়ার এই প্রবণতা নতুন নয়। আধুনিক বাজার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর বিশ্ব যতবার বিভিন্ন সংকট বা মন্দার মুখোমুখি হয়েছে, ততবারই স্বর্ণের দাম বেড়েছে বা কমেছে। ১৯৭০'এর দশকের ইরানের ইসলামী বিপ্লব, ইরাক-ইরান যুদ্ধ কিংবা আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণ- সবগুলো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই দাম বেড়েছিল স্বর্ণের। এসব সংকটের কারণে ১৯৭৭ সালে ২৩ শতাংশ, ১৯৭৮ সালে ৩৭ শতাংশ এবং ১৯৭৯ সালে স্বর্ণের দাম এক লাফে ১২৬ শতাংশ বৃদ্ধিতে গিয়ে ঠেকেছিল।
স্বর্ণের দাম যে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৯০ সালে যখন ইরাকের কুয়েত আক্রমণের মাধ্যমে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সূচনা হয়, তখনও বেড়েছিল স্বর্ণের দাম। আবার বছর খানেক পরেই যখন রাজনৈতিক উত্তেজনা কমতে শুরু করল, তখন ধীরে ধীরে স্বর্ণের দামও আবার ওই যুদ্ধ শুরুর আগের পর্যায়ে নেমে গেলো। একই ঘটনা ঘটেছিল ২০০১ সালের ৯/১১ কাণ্ডে। এরপর ২০০৩ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে, তখনও স্বর্ণের দাম বেড়েছিল। পরবর্তীতে দীর্ঘকাল ধরে চলা এই যুদ্ধে ধীরে ধীরে স্বর্ণের দামে স্থিতিশীলতা আসে।
এমনকি রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অস্থিরতার গুজবেও এর দাম বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে; স্বর্ণের মূল্য এতোটাই স্পর্শকাতর! ২০১৪ সালে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে এমন একটি গুজব ছড়িয়েছিল, তখন স্বর্ণের দাম এক লাফে গিয়ে ঠেকেছিল ১ হাজার ৬৩০ ডলারে। আবার পরের বছর যখন মানুষ বুঝলো এটি ছিল ভিত্তিহীন গুজব, তখন ধীরে ধীরে দাম নেমে আসলো ১ হাজার ৩০০ ডলারেরও নিচে।
শুধু স্বর্ণ নয়, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে দাম ওঠানামা করে আরও একটি আন্তর্জাতিক পণ্যের। আর সেটি হল অপরিশোধিত তেল। ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের সঙ্গেই সঙ্গেই তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে রাশিয়ার ওপর। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়ায় তেলের উৎপাদন ও অন্যান্য দেশে রপ্তানি মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। পরিণামে বেড়েছে অপরিশোধিত তেল তথা মোটের ওপর বৈশ্বিক জ্বালানির দাম। এর আগেও বিভিন্ন সংকটে স্বর্ণের মতোই অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়তে দেখা গেছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তেলের মজুদ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। যখনই এ অঞ্চলে কোনো অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে, তখনই তেলের দাম বেড়েছে। আর স্বর্ণের মতোই এই অপরিশোধিত তেলের দাম নির্ধারণের মানদণ্ড হল মার্কিন ডলার। তাই যেকোনো ধরনের সংকটে ডলারের মানের সঙ্গে তেলের দামও ওঠানামা করে।
এছাড়া, স্বর্ণ একটি পণ্য হলেও অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সংকটের সময় এটি মূল্য পরিশোধের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল থাকলে প্রায়শই অপরিশোধিত তেলের মূল্য স্বর্ণের মাধ্যমে পরিশোধের দাবি করে থাকে রপ্তানিকারক দেশ। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো যখন বুঝতে পারে সামনে ডলারের মূল্য পতনের সম্ভাবনা রয়েছে, তখন তারা স্বর্ণের মাধ্যমে তেলের মূল্য পেতে চায়। তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেহেতু নিত্যপণ্যের দামও বাড়ে, তাই অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা থেকেই বড় ব্যবসায়ী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ভল্টে স্বর্ণের মজুদ বাড়াতে থাকে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে স্বর্ণের বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ হবে? এক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হল, সংকটের মেয়াদকাল। যদি দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চলতে চলতে থাকে তাহলে সামরিক খরচ বাড়াতে অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপানোর প্রয়োজন পড়বে। আর অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপানো মানেই বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে, নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে, সেই তুলনায় যোগান কমবে, বেশি টাকা ব্যয় করেও নিত্য প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খাবে মানুষ; মোটকথা অর্থের মূল্য কমে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে কাগজি মুদ্রার তুলনায় স্বর্ণে বিনিয়োগ নিঃসন্দেহে ভালো সিদ্ধান্ত। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, মুদ্রা ও অর্থ বাজারের পরিস্থিতি নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যায় না। বিশেষজ্ঞদের অনুমাননির্ভর তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এক্ষেত্রে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি স্বর্ণে মূল্য পতনের মাধ্যমে লোকসানের আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের প্রভাবে ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে শুরু করেছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে অপরিশোধিত তেল ও স্বর্ণের দাম। অস্ট্রেলিয়া এবং চীনের পরেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া। তাই এই দেশের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব যে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর একটু বেশিই পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজনেস নিউজ চ্যানেল সিএনবিসির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮০ সালের পর থেকে এই প্রথম বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি সর্বোচ্চ হয়েছে ইউক্রেন সংকটের প্রভাবে। সেইসঙ্গে মার্কিন জনগণের খরচ করার প্রবণতাও আগের চেয়ে কমেছে গেলো ফেব্রুয়ারিতে। অর্থাৎ, যুদ্ধের প্রভাব ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হতে শুরু বিশ্বে।
সংকটের শুরুতে পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মান পড়তে থাকলেও তা আবারও আগের জায়গায় ফিরতে শুরু করেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ডলারের পরিবর্তে অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশকে রুবলে জ্বালানির মূল্য পরিশোধের কথা জানিয়েছে। এর পাশাপাশি সুইফট থেকে রাশিয়াকে বাদ দিলেও ভারতসহ অন্যান্য দেশ রাশিয়ার সঙ্গে স্বাভাবিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখতে লেনদেনের বিকল্প খুঁজছে। তাই অনেক বিশ্লেষকেরই অনুমান, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন চলতে পারে আরও দীর্ঘ সময় ধরে। এদিকে আবার মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সম্প্রতি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুদের হার বাড়ানোর ইঙ্গিতও দিয়েছে। সুতরাং, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বর্ণে বিনিয়োগ হতে পারে বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত। তবে ঝুঁকির বিষয়টিও ভুলে গেলে চলবে না। আর্থিক বিশ্লেষকদের মতে, মোট সম্পদের ছোট একটি অংশ হিসেবে স্বর্ণের মজুদ রাখা যেতে পারে। যদি কোনো কারণে অন্যান্য সম্পদ তার মূল্য হারাতে বসে, সেক্ষেত্রে স্বর্ণ আর্থিক পতন থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করবে। তবে যেহেতু মুদ্রাবাজার প্রায়শই ওঠানামা করে, তাই সম্পদের পরিমাণ ও বাজার পরিস্থিতির তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই কেবল এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।