শান্তি উদ্যোগ নিলেও শিং জিনপিংয়ের কাছ থেকে জেলেনস্কি কেন কাঙ্খিত ফোন পেলেন না?
গত বছরের জানুয়ারি মাসে চীন ও ইউক্রেন দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ৩০ বছর পূর্তি উদযাপন করেছে। সেই সময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর মধ্যে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে উষ্ণ আলাপচারিতা হয়েছিল। আলাপে ইউক্রেন ও চীনের মধ্যকার 'পারস্পরিক রাজনৈতিক বিশ্বাস' বাড়ানো এবং জনগণের মধ্যকার মধ্যকার 'গভীর বন্ধুত্ব' সৃষ্টির কথা বলা হয়েছিল।
এরই প্রায় দুই মাসেরও কম সময়ে শুরু হয়ে যায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। চীনের অন্যতম মিত্র রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মধ্য দিয়েই এই যুদ্ধের সূচনা ঘটে। এরপর থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সাথে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর কোনো আলাপ হয়নি। একইসাথে চীনের সাথে ইউক্রেনের দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে তোলা উষ্ণ সম্পর্কেও যেন ভাটা পড়েছে।
জেলেনস্কির সাথে প্রেসিডেন্ট জিনপিং এর আবার ঠিক কবে আলাপ হবে সেটি প্রায় অনিশ্চিত। বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পশ্চিমা নেতারাও চীনকে আলাপের কথা বললেও পরাশক্তি দেশটির পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে যুদ্ধ শুরুর আগে চীন ও ইউক্রেনের মধ্যকার বাণিজ্য ও সংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই সবকিছুই যেন থমকে গিয়েছে।
ইউক্রেনের পক্ষ থেকে রাশিয়াকে রুখতে চীনের সহযোগিতা কামনা করা হচ্ছে। কিন্তু চীনের পক্ষ থেকে ইউক্রেনের শান্তি উদ্যোগ নিয়ে তেমন কোনো সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। বরং যুদ্ধে চীন উল্টো রাশিয়াকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে ইউক্রেনের জনগণের কাছেও চীন ধীরে ধীরে অজনপ্রিয় হচ্ছে। যদিও চীনের পক্ষ থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার দাবি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইউক্রেনের সাথে সখ্যতা চীনের এ 'দায়িত্বশীল' অবস্থানকে বিতর্কিত করতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব অনেকটা প্রক্সি যুদ্ধের রূপ নিচ্ছে। ইউক্রেনের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন এক্ষেত্রে বড় একটা ফ্যাক্টর।
ইউক্রেন সম্পর্কে আরেকটা বাস্তবতা হচ্ছে, দেশটি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বর্তমানে প্রায় বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। তাই চীনের কাছে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে আগের মতো গুরুত্ব বহন করছে না।
এ সম্পর্কে নানজিং ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ঝু ফেং বলেন, "বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধ করছে। দেশটিতে চীনের বিনিয়োগ বোমার আঘাতে ধূলিসাৎ হচ্ছে। এমতবস্থায় আমরা ঠিক জানিনা ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী?"
যুদ্ধ শুরুর আগে চীন-ইউক্রেন সম্পর্ক অনেকটাই বাণিজ্য কেন্দ্রিক ছিল। ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ইউক্রেন থেকে চীনে রপ্তানির পরিমাণ চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০১৯ সালের মধ্যে চীন একক দেশ হিসেবে ইউক্রেনের বার্লি, ভুট্টা, অস্ত্র ও আকরিক লোহার অন্যতম ক্রেতা ছিল।
২০১৯ সালে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বছরটিকে 'চীনের বছর' বলেও উল্লেখ করেছিলেন। একইসাথে কিয়েভে নতুন সাবওয়ে লাইন নির্মাণের জন্য চীনা কোম্পানিকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। এছাড়াও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে ইউক্রেনের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থাকায় দেশটিকে ব্যবহার করে চীন ইউরোপের মার্কেটে প্রবেশের সুযোগ খুঁজছিল।
তবে শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়েই নয়, বরং সংস্কৃতিক দিক দিয়েও দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছিল। বেইজিং এর সবচেয়ে বড় পার্কে ইউক্রেনের এক কবিকে সম্মান জানিয়ে তার ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছিল।
২০২১ সালে বেইজিং ইন্টারন্যাশনাল ফিল ফেস্টিভালে প্রসিডেন্ট জেলেনস্কির স্ত্রী ওলেনা জেলেনস্কি ভার্চুয়ালি স্বাগত বক্তব্য দিয়েছিলেন। একইসাথে ইউক্রেন থেকে বহু শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য চীনে গিয়েছিল।
তবুও ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে দুই দেশের সম্পর্ক সবসময়ই একটা চাপের মধ্যে ছিল। ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেনের ভূমি ব্যবহার করে ক্রিমিয়া দখল করে, তখনও নিশ্চুপ ছিল চীন। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চীনের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য সবসময়ই চাপ জারি ছিল।
গতবছর যে সময়টাতে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী ইউক্রেনের সীমান্তে জড়ো হচ্ছিলো, ঠিক সেই সময়টাতেই জিনপিং-পুতিন বেইজিং এ বৈঠক করে রাশিয়া-চীনের সম্পর্ককে 'অসীম' বলে উল্লেখ করেছিল।
যুদ্ধ শুরুর পর বেইজিং এর অবস্থান আরও পরিষ্কার হতে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশটি ক্রেমলিনের সাথে তাল মিলিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য ন্যাটোকে দোষারোপ করেছে। এছাড়াও যুদ্ধ চলাকালীন বেশ কয়েকবার প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও পুতিন পরস্পরের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখা করেছেন কিংবা কথা বলেছেন।
এমনকি চীনা সরকার কর্তৃক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেটে ইউক্রেনে রাশিয়ার ড্রোন হামলার ভিডিও দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে ইউক্রেনের বন্ধুত্বের সমালোচনামূলক কন্টেন্টও প্রচার করা হচ্ছে।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নানা সময়েই ইউক্রেনের পক্ষ থেকে চীনের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে। কেননা ইউক্রেন অনেকাংশে মনে করে যে, সম্ভবত চীনই একমাত্র দেশ যেটি রাশিয়ার ওপর প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে।
যদিও ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলো চীনকে রাশিয়াপন্থী অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ করেছেন। তবে জেলেনস্কি অবশ্য চীন ইস্যুতে একটু সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।
যুদ্ধে নিজেদের অবস্থান পরিস্কারের জন্য সম্প্রতি চীন যে পেপার প্রকাশ করেছে সেটি নিয়ে কিছুটা আশাবাদী ইউক্রেন। এ সম্পর্কে জেলেনস্কি বলেন, "আমি সত্যিই এটা বিশ্বাস করতে চাই যে, চীন রাশিয়াকে অস্ত্র সহায়তা দেবে না।" যদিও পশ্চিমা দেশগুলো জেলেনস্কির এ আশাবাদী অবস্থানের সাথে একমত প্রকাশ করেনি।
অন্যদিকে ইউক্রেনের সরকার ও জনগণের মাঝে চীনের ভূমিকা নিয়ে নেতিবাচক অবস্থান তৈরি হচ্ছে বলে মনে করে কিয়েভ ভিত্তিক নিউ জিওপলিটিক্স রিসার্চ নেটওয়ার্কের এশিয়া সেকশনের প্রধান ইউরি পইতা।
একইসাথে গত বছরের অক্টোবরে ইউক্রেনের একটি রিসার্চ গ্রুপের করা পোল অনুযায়ী, দেশটিতে চীনের বিপক্ষে জনমত দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত মাসে শি জিনপিং ও পুতিনের মধ্যকার উষ্ণ সাক্ষাৎ যেন ইউক্রেনের জন্য আরও হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ সম্পর্কে ইউরি পইতা বলেন, "একটা দীর্ঘ সময় ধরে ইউক্রেন চীনকে নিয়ে বড় ধরণের বিভ্রমের মাঝে ছিল। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি বর্তমানে, বিশেষ করে পুতিন-জিনপিং বৈঠকের পর ইউক্রেনের এ ভ্রম কাটতে শুরু করেছে।"
তবে দ্য ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের এশিয়া প্রোগ্রামের ডিরেক্টর জানকা ওয়েরটেল মনে করেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের মাঝে চীন বাণিজ্য ও কৌশলগত সুবিধা নিতে পারে। তিনি বলেন, "যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউক্রেনের পুনর্গঠনের সহায়তা করায় বিষয়টি চীনের কাছে আকর্ষণীয় উপায় হতে পারে। চীন সরকার এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পর্ক যথাসাধ্য উদার রাখার চেষ্টা করবে। "
যদিও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউক্রেনের সাথে যোগাযোগ রাখছে, তবে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ঠিক কবে নাগাদ আলোচনায় বসতে পারে তা নিয়ে তেমন কোনো তথ্য জানা যায়নি।
চীন-ইউক্রেনের আলাপের বিষয়ে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রধান উরসিলা ভন ডের লেয়েন বলেন, "প্রেসিডেন্ট জিনপিং আমাকে গত সপ্তাহে জানিয়েছেন যে, 'যথাযথ সময় ও সুযোগ' বুঝে জেলেনস্কির সাথে আলাপ করা হবে।"
যদিও চীনা কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করে যে, জেলেনস্কি ও জিনপিং এর মধ্যকার আলাপ হলেও যুদ্ধের তেমন কোনও আমূল পরিবর্তন হবে না। কেননা রাশিয়া-ইউক্রেন দুই পক্ষই এখন আর যুদ্ধবিরতিতে রাজি নয়।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্র বরং যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। কেননা এতে করে রাশিয়া দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
চীনের রেনমিন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর ওয়াং ইউই বলেন, "জেলেনস্কি হয়তো মনে করছেন যে, তার সাথে জিনপিং এর কথা হলে চীন দেশ হিসেবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের নিন্দা জানাবে। একইসাথে দেশটি থেকে রাশিয়াকে সেনা প্রত্যাহার করতে বলবে। কিন্তু সেটা আর এখন বাস্তবসম্মত নয়।"
দুই দেশের মধ্যকার এ অনিশ্চিত সম্পর্ক চীনে বসবাসকৃত ইউক্রেনীয় নাগরিকদেরও ভাবিয়ে তুলছে। সাংহাইয়ে বসবাস করা ৩২ বছর বয়সী ব্যবসায়ী এন্টন মাতুসেভিচ এমনই একজন ইউক্রেনীয়।
মাতুসেভিচ খুব ভালো করেই জানেন যে, চীনের বহু মানুষ যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন দিচ্ছেন। তবুও তিনি চীনে ফান্ড গঠন ও সংস্কৃতিক কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে ইউক্রেনের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।
এ সম্পর্কে এক চীনা নারীকে বিয়ে করা মাতুসেভিচ বলেন, "আমরা মানুষের মতামতকে পরিবর্তন করতে হয়তো পারবেন না। কিন্তু ভবিষ্যতের সম্পর্কের কথা চিন্তা করে আমরা পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে পারি।" একইসাথে চীন যদি যুদ্ধে রাশিয়াকে অস্ত্র সহায়তা দেয়, তবে দেশটি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন মাতুসেভিচ।
সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস