২৫ বছরে গুগল: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আবার নতুন চমক দেখাতে পারবে এটি?
১৯৯৫ সালের গ্রীষ্মে সের্গেই ব্রিন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। ওই বছরই ক্যাম্পাসে ব্রিন আর ল্যারি পেজের প্রথম দেখা হয়। পেজ তখন স্ট্যানফোর্ডে ভর্তি হওয়ার চিন্তা করছিলেন।
১৯৯৬ সালের মাথায় ব্রিন আর পেজ একসঙ্গে ব্যাকরাব নামক একটি প্রকল্পে কাজ করা শুরু করেন। ইন্টারনেটের ওয়েবসাইটগুলোকে ব্যাকলিংকের ওপর ভিত্তি করে র্যাঙ্ক করার জন্য তারা পেজর্যাঙ্ক নামক একটি অ্যালগরিদম তৈরি করেন। পেজ আর ব্রিনের এ আইডিয়াটিই গুগলকে সার্চ ইঞ্জিন দুনিয়ার শীর্ষস্থান এনে দিয়েছে।
কোনো ওয়েবপেইজের লেখায় যখন অন্য ওয়েবসাইটের ঠিকানা জুড়ে দেওয়া (হাইপারলিংক করা) হয়, তখন দ্বিতীয় ওয়েবসাইটটি একটি ব্যাকলিংক পায়। যে ওয়েবসাইটের ব্যাকলিংক যত বেশি, সেটি তত ভালো, বিশ্বাসযোগ্য, আর কাজের ওয়েবসাইট — এমন আইডিয়ার ওপর ভিত্তি করে পেজর্যাঙ্ক অ্যালগরিদমটি তৈরি করেছিলেন পেজ ও ব্রিন।
১৯৯৬ সালের আগস্টে ব্যাকরাব-এর নাম গুগল করা হয়। পরের বছর গুগল ডটকম-এর নিবন্ধন করেন ল্যারি পেজ ও সের্গেই ক্রিন। গুগল প্রথম তহবিল পায় ১৯৯৮ সালে।
১৯৯৯ সালের শুরুতে পেজ-ব্রিন জুটি গুগলকে বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কেউ কিনতে আগ্রহী না হওয়ায় তারা শেষ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আল্টোতে একটি অফিস তৈরি করে প্রকৌশলী নিয়োগ দিতে শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে গুগল প্রযুক্তি দুনিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে। জন্মের এক বছরের মাথায় সার্চ-ইঞ্জিন যুদ্ধে সবার ওপরে উঠে আসে গুগল।
বলা বাহুল্য, প্রায় আড়াই দশক আগে প্রযুক্তি দুনিয়ার প্রেক্ষাপট এখন নাটকীয়ভাবে বদলে গিয়েছে। গুগল বর্তমানে আলফাবেট নামক আলাদা কোম্পানির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। প্রযুক্তি দুনিয়ায় গুগলের ছাপ আর আধিপত্য দুটোই অবিশ্বাস্যভাবে বেশি।
তবে ২৫ বছরের এ যাত্রায় গুগল যতগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার সবগুলোতেই সাফল্য দেখেছে? অথবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) এ নতুন বিপ্লবে গুগলের অবস্থান কোথায়?
গুগল এখন পর্যন্ত প্রায় ২৮৮টি পণ্য চালুর পর বাদ দিয়েছে। এ তালিকায় আছে গেমিং প্ল্যাটফর্ম স্টাডিয়া থেকে শুরু করে বাজেট ভিআর হেডসেট গুগল কার্ডবোর্ড।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির এত দ্রুত বিবর্তন ঘটছে যে, সাধারণ ব্যবহারকারীর পাশপাশি অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানও এ দ্রুতির সঙ্গে তাল সামলাতে পারছে না। আর প্রযুক্তি জায়ান্ট গুগলও বোধহয় এ দলে পড়েছে। নিদেনপক্ষে বর্তমান দৃশ্যপট সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।
গুগল এআই দৌড়ে পিছিয়ে গেছে, এ কথা অনেকেই বলছেন। এমনকি গুগলের অভ্যন্তরের লোকজনও এমন ধারণাই পোষণ করেন।
গুগলের একজন প্রকৌশলীর একটি মেমো অনলাইনে ফাঁস হয়ে যায়। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, গুগলের কাছে এআই নিয়ে কোনো 'গোপন সস' আপাতত নেই এবং এআই দৌড়ে জেতার কোনো অবস্থানেও নেই এটি।
২০২২ সাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির জন্য একটি স্মরণীয় বছর হয়ে থাকবে। গত বছরের নভেম্বরে ওপেনএআই সর্বপ্রথম চ্যাটজিপিটি উন্মুক্ত করে।
এরপর ওপেনএআই-এ কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে মাইক্রোসফট। প্রতিষ্ঠানটি এখন বিং সার্চ ইঞ্জিন ও অফিস ৩৬৫-এর মতো নিজেদের বিভিন্ন পণ্যে চ্যাটজিপিটি যুক্ত করার প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে।
চ্যাটজিপিটিকে বলা হচ্ছে 'গুগল কিলার'। কারণ গুগলে কেবল বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকেই তথ্য অনুসন্ধান করা যায়। অন্যদিকে ব্যবহারকারীর অনুসন্ধানের সরাসরি উত্তর দিতে পারে চ্যাটজিপিটি।
চ্যাটজিপিটি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিংয়ের জন্য ট্রান্সফর্মার নামক যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেটি আদতে গুগল আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু গুগল যখন চ্যাচজিপিটির প্রতিদ্বন্দ্বী বার্ড উন্মুক্ত করল, তখন খুব বেশি সাড়া ফেলতে পারেনি।
বার্ডকে খুব সাবধানতার সঙ্গে ব্যবহারকারীদের সামনে এনেছিল গুগল। গুগলের একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী এক সাংবাদিকের কাছে বার্ডকে 'এক্সপেরিমেন্ট' হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
বার্ড নিয়ে গুগলের এমন সতর্কতার সঙ্গে অতীতের একটি ঘটনার সংযোগ খুঁজতে চাইতে পারেন অনেকে।
যেকোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন চ্যাটবটের ভিত্তি হলো লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল বা এলএলএম। গুগলের মৌলিক একটি এলএলএম হচ্ছে ল্যামডা।
ল্যামডা নিয়ে কাজ করা গুগলের একজন প্রকৌশলী এক পর্যায়ে মনে করতে শুরু করেছিলেন, এআই ল্যামডা মানুষের মতো সংবেদী হয়ে উঠেছে। তিনি ল্যামডার সঙ্গে বিভিন্ন কথোপকথন অনলাইনে প্রকাশ করে নিজের দাবি — ল্যামডা খাঁটি আবেগ ও চিন্তা প্রকাশ করছে — প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।
অবশ্য এলএলএমগুলোকে প্রশিক্ষণই দেওয়া হয় এমন কাজের উদ্দেশ্যে। যাতে এগুলো মানুষের মতো লিখে উত্তর দিতে পারে।
গুগল সবসময় প্রত্যাখ্যান করেছে যে ল্যামডা তার অভীষ্ট কাজের চেয়ে আদতে বেশি কিছু করছে। শেষ পর্যন্ত ওই প্রকৌশলীকে ছাঁটাই করে প্রতিষ্ঠানটি।
কিন্তু এ ঘটনা সারাবিশ্বে খবর হয়েছিল। এতে এআই নিয়ে সংশয়বাদীদের মধ্যে দুশ্চিন্তা আরও গাঢ় হয়েছিল। গুগল সম্ভবত কখনোই এসবের অংশ হতে চায়নি।
অবশ্য গুগল এআই-যাত্রায় একেবারেই হাল ছেড়ে দেয়নি। গত মে মাসে এটি এআই-শক্তিচালিত ২৫টি নতুন পণ্যের ঘোষণা দিয়েছিল। নিজেদের ওয়েবসাইটে এটি নিজেকে 'এআই প্রযুক্তির উন্নয়নের অগ্রপথিক' হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
ক্রিয়েটিভ স্ট্র্যাটেজিস নামক একটি ফার্মের বিশ্লেষক ক্যারোলাইনা মিলানেসিও মনে করেন, এআইয়ের মঞ্চ থেকে গুগলকে এত দ্রুত খারিজ করে দেওয়ার কোনো মানে নেই।
'গুগল এআই-এর দৌড় শুরু করতে পারেনি — এমন ধারণা আমি একেবারেই মানি না। গুগলের জন্য ভোক্তা ও উদ্যোগ উভয় দিক থেকেই এআইকে বিকশিত করার সুযোগ রয়েছে,' তিনি বলেন।
হারগ্রিভস ল্যান্সডো নামক একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের অর্থ ও বাজার বিভাগের প্রধান সুসানা স্ট্রিটার মনে করেন, গুগলের ক্লাউড পরিষেবা ব্যবসাতেই এর 'গোপন এআই অস্ত্র' থাকতে পারে।
ক্লাইড সেবায় গুগলের বড় আধিপত্য রয়েছে। বিশ্বের ছোট-বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গুগল থেকে এ সেবা ক্রয় করে। তাই গুগল যদি নিজেদের ক্লাউড সার্ভিসে জেনারেটিভ এআই সেবাকে অংশীভূত করতে পারে, তাহলে তা-ই হতে পারে প্রতিষ্ঠানটির তুরুপের তাস।