দক্ষিণ কোরিয়ার নারীরা সন্তান নিচ্ছেন না কেন?
বিশ্বের সর্বনিম্ন জন্মহার দক্ষিণ কোরিয়ার। বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে দেশটির জন্মহার আরো ৮ শতাংশ কমে গিয়ে ০.৭২ এ পৌঁছেছে।
এই পরিসংখ্যান একজন নারী তার জীবদ্দশায় কতগুলো সন্তান প্রত্যাশা করে সেটির সংখ্যা নির্দেশ করে। জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে এটি ২.১ হওয়া জরুরি।
এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা অর্ধেকে এসে দাঁড়াবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী উন্নত দেশগুলোতে জন্মের হার কম দেখা গেলেও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অবস্থা আর কোন দেশে নেই। এর প্রভাবে দেশটিতে ৫০ বছরের মধ্যে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে, দেশটির সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া লোকের সংখ্যা ৫৮ শতাংশ হ্রাস পাবে এবং অর্ধেকের বেশী জনসংখ্যা ৬৫ বছর বা তার অধিক হয়ে যাবে।
এটি দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি, পেনশন এবং নিরাপত্তার জন্য এতটাই ক্ষতিকর যে রাজনীতিবিদরা এটিকে 'জাতীয় জরুরি অবস্থা' হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
প্রায় ২০ বছর ধরে দেশটির বিভিন্ন সরকার এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রায় ৩৭৯.৮ ট্রিলিয়ন কোরিয়ান উয়ন (২৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) খরচ করেছে।
যে দম্পতিদের সন্তান রয়েছে তাদের নগদ অর্থ প্রদান করা হয়, মাসিক ভর্তুকিযুক্ত আবাসন এবং বিনামূল্যে ট্যাক্সিসেবা দেওয়া হয়। শুধু যারা বিবাহিত তাদের জন্যও হাসপাতালের বিল এবং আইভিএফ চিকিৎসা এই আওতায় রয়েছে।
এই ধরনের আর্থিক প্রণোদনা কাজ না করার ফলে রাজনীতিবিদরা আরো 'সৃজনশীল' সমাধান নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে আয়া নিয়োগ করা ও তাদের ন্যূনতম মজুরি প্রদান করা এবং ৩০ বছর বয়সের আগে যদি তিনটি সন্তান থাকে তাহলে পুরুষদের সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া।
২০২২ সালে, দক্ষিণ কোরিয়ায় শুধু ২ শতাংশ সন্তানের জন্ম হয়েছে বিয়ে ছাড়াই।
পুরুষ এবং নারী উভয়ই দেশটিতে তাদের সন্তানের জন্মের প্রথম আট বছরে এক বছরের ছুটি পেয়ে থাকে। কিন্তু ২০২২ সালে ৭০ শতাংশ মায়ের তুলনায় মাত্র ৭ শতাংশ বাবা এই ছুটি নিয়েছে।
কোরিয়ান নারীদের 'অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা' (ওইসিডি) দেশগুলোর মধ্যে উচ্চ শিক্ষার হার সবচেয়ে বেশী। তারপরেও দেশটিতে অনেক বেশী লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে যা দেশটির বৈষম্যমুলক বেতন কাঠামো এবং অন্যান্য কাজে নারীদের কম অংশগ্রহণ থেকে বোঝা যায়।
গবেষকরা বলছেন, এটি দক্ষিণ কোরিয়ান নারীদের পরিবার অথবা ক্যারিয়ারের মধ্যে যে কোন একটি বেছে নিতে বাধ্য করছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক স্টেলা শিন পাঁচ বছরের বাচ্চাদের ইংরেজি শেখান। কিন্তু ৩৯ বছর বয়সে স্টেলার নিজের কোন সন্তান নেই। তার ভাষ্যমতে, এই সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নিয়েছেন।
তিনি ছয় বছর ধরে বিবাহিত। তিনি এবং তার স্বামী উভয়েই একটি সন্তান নিতে আগ্রহ দেখালেও কাজের চাপ এবং নিজেদের সময় দিতে গিয়ে তাদের সন্তান নেওয়ার সময় চলে যায়। এখন তিনি স্বীকার করেন, কর্মজীবন এবং ব্যক্তিজীবনের নানা ব্যস্ততা সন্তান নেওয়া আরো 'অসম্ভব' করে তোলে।
তিনি বলেছেন, "মায়েদের প্রথম দুই বছর তাদের সন্তানের পুরো সময় দেখাশোনা করার জন্য কাজ ছেড়ে দিতে হয় যেটি আমাকে খুব বিষণ্ন করে তুলবে। আমি আমার ক্যারিয়ার এবং নিজের যত্ন নিতে ভালোবাসি।"
দক্ষিণ কোরিয়ার অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা রাজধানী সিউলে বা তার আশেপাশে বসবাস করে। সিউলের জন্মহার ০.৫৫-এ নেমে এসেছে যা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাইভেট শিক্ষার খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশী। চার বছর বয়স থেকে গণিত এবং ইংরেজি থেকে শুরু করে সঙ্গীত এবং তায়কোয়ান্দোর মত প্রাইভেট টিউশনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়ে। একটি পরিবারকে সেই খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
অতিরিক্ত প্রতিযোগিতামূলক দেশটিতে সন্তানকে এই প্রাইভেট টিউশনের অংশ বানাতে না পারলে সেটি ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়। সন্তান লালনপালন বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ এখন দক্ষিণ কোরিয়া।
২০২২ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধু ২ শতাংশ অভিভাবক প্রাইভেট টিউশনের জন্য অর্থ প্রদান করেননি এবং ৯৪ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন প্রাইভেট টিউশন একটি আর্থিক বোঝা।
স্টেলা জানিয়েছেন, বাবা মা প্রতি মাসে প্রত্যেক সন্তানের জন্য ৮৯০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ব্যয় করেন এবং অনেক পরিবার সেটি বহন করতে পারে না।
তিনি বলেন, "কিন্তু এই ক্লাসগুলোতে অংশ না নিলে শিশুরা পিছিয়ে পড়ে। যখন আমি বাচ্চাদের আশেপাশে থাকি আমিও সন্তান নেওয়ার আগ্রহ দেখাই কিন্তু আমি আসলে এটার বাস্তবতা জানি।"
বিগত ৫০ বছরে দেশটিতে নারীরা উচ্চ শিক্ষা এবং কাজের প্রতি অনেক বেশী আগ্রহী হয়েছে, তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাড়লেও স্ত্রী এবং মায়ের ভূমিকা প্রায় একই গতিতে দেশটিতে বিকশিত হয়নি।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সমকামী বিবাহ অবৈধ এবং অবিবাহিত মহিলাদের সাধারণত গর্ভধারণের জন্য শুক্রাণু ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয় না।
কিন্তু রাজনীতিবিদরা ধীরে ধীরে এই সংকটের গভীরতা ও জটিলতাকে মেনে নিচ্ছেন।
এই মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল স্বীকার করেছেন, এই সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা 'কাজ করেনি' এবং দক্ষিণ কোরিয়া 'অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রতিযোগিতামূলক ছিল'।
তিনি বলেছেন, তার সরকার এখন কম জন্মহারকে 'কাঠামোগত সমস্যা' হিসাবে বিবেচনা করবে কিন্তু এটি কীভাবে নীতিতে রূপান্তরিত হবে তা ঠিক করা এখনো বাকি।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়