বিশ্বের প্রথম জেট স্যুট রেসে অংশ নিলেন বাস্তবের সব ‘সুপারহিরো’
ভবিষ্যতের স্থাপত্য থেকে শুরু করে অগ্রগামী অবকাঠামোর জন্য দুবাই যেমন পরিচিত তেমনি অদ্ভুত, বিস্ময়কর এবং উদ্ভট উদ্ভাবনের জন্যও এর পরিচিতি রয়েছে। বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) দুবাই শহর সম্পূর্ণ সাই-ফাই হয়ে যায় যখন ৮ জন পাইলট মার্ভেলের সুপারহিরো 'আয়রন ম্যান' এর মতো স্যুট-বুট পরিহিত অবস্থায় আকাশে উড়ে বেড়িয়েছেন।
কোন এলিয়েন অথবা সুপারভিলেনের সাথে লড়াই না করলেও আকাশচারী এই ক্রীড়াবিদরা দুবাই স্পোর্টস কাউন্সিল এবং গ্র্যাভিটি ইন্ডাস্ট্রিজের আয়োজিত একটি জেট স্যুট রেসে অংশ নিয়েছিলেন। গ্র্যাভিটি ইন্ডাস্ট্রিজই এই জেট স্যুটের প্রস্তুতকারক।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গ্র্যাভিটি ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান টেস্ট পাইলট রিচার্ড ব্রাউনিং বলেছেন, "অধিকাংশ রেসের থেকে এটি আলাদা কারণ আপনি থার্ড ডাইমেনশনে রেস করছেন। পাইলট যখন খুশি উঠছে, আবার নামছে। এটি একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা।"
আটজন পাইলট পানিতে অবস্থিত ১২টি বড় 'ইনফ্ল্যাটেবল' বাধা পেড়িয়ে এক কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিয়েছেন। প্রতিযোগিতায় চারটি হিট পার করে চূড়ান্ত রাউন্ডে যেতে হয়েছে। প্রতিটি প্রতিযোগিতা প্রায় ৯০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল।
ব্রাউনিং বলেছেন, "প্রতিযোগিতায় কাউকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে, আবার কেউ হেরেছে, কেউ পানিতে নেমে গিয়েছিল, হই-হুল্লোর সব কিছু মিলিয়ে বিষয়টা দুর্দান্ত ছিল।"
তিনি আশা করেন, এই প্রতিযোগিতা পরবর্তী প্রজন্মের বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীদের বড় স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করবে। তিনি বলেন, "বেশিরভাগ প্রযুক্তি হাস্যকর এবং অসম্ভব মনে হয় যতক্ষণ না এটি কারো কাজে আসে।"
'বুগাতির শক্তি' যখন একটি ব্যাকপ্যাকে
গ্র্যাভিটির এই প্রযুক্তিতে পাঁচটি ইঞ্জিনকে এক করা হয়েছে। এতে রয়েছে: পিছনে একটি বড় ইঞ্জিন, দুই বাহুতে এক জোড়া 'মাইক্রো জেট ইঞ্জিন' সহ একটি থ্রিডি-প্রিন্টেড পলিমার, অ্যালুমিনিয়াম এবং টাইটানিয়াম দিয়ে বানানো স্যুট (যা একজন ব্যক্তিকে বাতাসে তুলতে পারে)। ব্রাউনিং ৩০ কিলোগ্রাম ব্যাকপ্যাকের ভেতরে থাকা ১ হাজার ৭০০ হর্সপাওয়ারের জেট স্যুটকে 'একটি বুগাতি ভেরন' স্পোর্টস কারের শক্তির সাথে তুলনা করেছেন।
পাইলটরা তাদের বাহুর দিক পরিবর্তন করে তাদের ফ্লাইটের দিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে যেমন উপরে যাওয়ার জন্য তাদের বাহু নিচের দিকে নির্দেশ করতে হয় এবং নিচে যাওয়ার জন্য তাদের বাহু পাশে নিতে হয়। জেট স্যুটটিতে জ্বালানি হিসেবে এভিয়েশন ফুয়েল বা ডিজেল ব্যবহার করা যায় এবং এটি প্রতি ঘণ্টায় ১৩৬ কিলোমিটার গতি (ব্রাউনিং এর নিজস্ব রেকর্ড) তুলতে পারে।
কিন্তু ব্রাউনিং এটি ব্যবহারে ঝুঁকির কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, "আমরা পানির উপর এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছি কারণ কোন গোলমাল হলে আপনি পানিতে পরে যাবেন। এতে কিছু নাটকীয়তাও যোগ হয়। এটি মেরামত করাও কিছুটা ব্যয়বহুল।"
এই প্রতিযোগিতায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন আহমেদ আল শেহি। তিনিই একমাত্র প্রতিযোগী যিনি গ্র্যাভিটি টিমের পাইলট ছিলেন না। তার নিয়মিত স্কাই ডাইভিং করার অভিজ্ঞতা আছে এবং এইসব ঝুঁকিপূর্ণ খেলাধুলার প্রতি বিশেষ আগ্রহ আছে। আল শেহি প্রথম জেট স্যুট পড়ে উড়েছিলেন রেস শুরু হওয়ার ঠিক তিন সপ্তাহ আগে। যুক্তরাজ্যে তিনি একটি ১২ দিনের প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেছেন যেখানে অংশগ্রহণকারীরা একটি সুরক্ষা সিস্টেমের অংশ হিসেবে প্রস্তুতি শেষ করে ফ্রি ফ্লাইটে অংশ নিয়েছিল।
নিছক বিনোদন নয়
প্রযুক্তিটি দিয়ে কী করা সম্ভব তা দেখানোর জন্যই এই প্রতিযোগিতার আয়োজন। বিনোদন এই জেট স্যুটের অন্যতম সম্ভাবনাময় দিক। প্রাক্তন রয়্যাল মেরিন সংরক্ষক ব্রাউনিং ইতোমধ্যেই অনুসন্ধান, উদ্ধার, চিকিৎসা এবং সামরিক প্রতিরক্ষা সহ অন্যান্য কাজে জেটপ্যাকের ব্যবহার শুরু করতে কাজ করছেন।
২০২০ সালে গ্রেট নর্থ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস (জিএনএএএস)) গ্র্যাভিটি ইন্ডাস্ট্রির জেট স্যুটগুলো যুক্তরাজ্যের লেক ডিস্ট্রিক্টের পাহাড়ি অঞ্চলে পরীক্ষা করেছিল। সেখানে ২৫ মিনিটের হাঁটা পথ জেট স্যুটে করে পাড়ি দিতে সময় লেগেছে ৯০ সেকেন্ড। গ্র্যাভিটি ২০২১ সালে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি এবং রয়্যাল মেরিনদের সাথে যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ উপকূলে তিন দিন সময় নিয়ে কমান্ডো জেট স্যুটের পরীক্ষা চালায়। মূলত সৈন্যদের দ্রুত জাহাজে উঠতে সাহায্য করার কাজে জেট স্যুট ব্যবহার করা হয়েছিল যেটি সাধারণত হেলিকপ্টারের মাধ্যমে করা হয়।
অন্যান্য অনেক সংস্থা এই ধরনের চলাচলের মাধ্যম নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক জেটপ্যাক এভিয়েশন বিশ্বের প্রথম জেটপ্যাক তৈরি করেছে বলে দাবি করেছে যেগুলো টেলিভিশন এবং সিনেমাতে ব্যবহার করা হয়েছে। ভারতীয় স্টার্টআপ অ্যাবসলুট কম্পোজিটস দেশটির সেনাবাহিনী কীভাবে জেটপ্যাক ব্যবহার করতে পারবে সেটি নিয়ে কাজ করছে।
গ্র্যাভিটি পরের বছর দুবাইতে অন্তত ১২ জন প্রতিযোগী নিয়ে একটি চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজনের পরিকল্পনা করছে। ব্রাউনিং আশা করেন, বিশ্বজূড়ে মানুষের কল্পনাকে আরো জাগিয়ে তুলবে এই প্রযুক্তি।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়