কীভাবে কর্মক্ষেত্রের সবকিছু ব্যক্তিগতভাবে নেওয়া থেকে বিরত থাকবেন
চাকরি থেকে আমাদের প্রাপ্তি অনেক সময় বেতন পাওয়ার চেয়েও বেশিকিছু হয়ে ওঠে। কর্মক্ষেত্র থেকে আমরা লক্ষ্য অর্জন, আত্মোন্নয়ন ও একতাবদ্ধতার শিক্ষা পাই। যা আমাদের কর্মজীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনেও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তবে মানুষের ওপর সবসময় কর্মক্ষেত্রের ইতিবাচক প্রভাবই পড়ে, এমনটা না। কখনো কখনো সহকর্মী বা উর্ধ্বতনের কথা বা কাজের প্রভাব কারো কারো জীবন বা ব্যক্তিত্বে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মানুষ অনেক সময় নিজের পেশাদার জীবনের সীমা নির্ধারণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে নিজের আত্মচেতনার সঙ্গে পেশাদারিত্ব এমনভাবে মিশে যায় যে মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবন আর পেশাদার জীবনের প্রভেদ করতে পারেনা। তখনই বাধে নানা বিপত্তি। বিশেষত 'সংবেদনশীল মানুষের' ক্ষেত্রে এটি হরহামেশাই ঘটে।
সবকিছু গভীরভাবে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি ও অনুভব করে; আপনি যদি এমন মানুষ হন, তাহলে আপনার কোনো কাজ নিয়ে অন্যদের মন্তব্য, সিদ্ধান্ত বা আচরণ আপনার আবেগ, আত্মবিশ্বাস ও সক্ষমতার উপর সরাসরি এবং কখনো কখনো অবিশ্বাস্যরকম প্রভাব ফেলতে পারে।
আমার এক ক্লায়েন্টের কথাই ধরুন, তার নাম ব্রেন্ডা। তিনি আমার সাহায্য নিয়ে মূলত একটি প্রশ্নেরই উত্তর অনুসন্ধানের চেষ্টা করছিলেন, তা হলো: কেন আমি কর্মক্ষেত্রের সবকিছু এত ব্যক্তিগতভাবে নিই?
ব্রেন্ডা জানান, গত পাঁচ বছর ধরে তিনি একটি বিখ্যাত বিজনেস স্কুলের ডিনের চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। চাকরি জীবনে তিনি অনেক সফলতা লাভ করেছেন, তবে এর জন্য তাকে চড়া মূল্যও দিতে হয়েছে। কারণ প্রতিটি পরিস্থিতি, মন্তব্য বা কাজের ফলাফল তাকে গভীরভাবে আলোড়িত করত। মনে হতো এগুলো তার যোগ্যতার (বা এর অভাব) মাপকাঠি।
যখন তার অধীনের কোনো বিভাগের কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিত, ব্রেন্ডা প্রায়ই নিজের ইচ্ছাতেই তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করার দায়িত্ব নিতেন। তার এই অতিরিক্ত দায়িত্ব নেওয়ার অভ্যাস এসব সমস্যা সমাধানে সহায়তা হয়ত করতো, কিন্তু অধিকাংশ সময় এগুলো তার নিজের মানসিক শান্তির ব্যাঘাত ঘটাতো।
শুধু তাই নয়, গঠনমূলক সমালোচনা বা এমনকি ছোটখাটো সমস্যাও তাকে প্রচণ্ড আবেগতাড়িত করতো।
সম্প্রতি ব্রেন্ডা এবং ডিন স্কুলের বাজেট কাটছাঁট নিয়ে আলোচনায় বসার কথা ছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন এই সিদ্ধান্তটি বিজনেস স্কুলের সব বিভাগের কর্মীদের ওপর প্রভাব ফেলবে। তাই তিনি একটি ইতিবাচক সমাধান খুঁজে বের করতে এবং তার সহকর্মীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করার চেষ্টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
কিন্তু যখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা উঠল, ব্রেন্ডা ডিনের মধ্যে কেমন যেন নির্লিপ্ত ভাব লক্ষ্য করলেন। এ পরিস্থিতিতে তিনি গভীর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। কারণ তিনি এই কাজটি করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন এবং ডিনের উদাসীনতা তার কাছে তাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যাখ্যান করার মতো মনে হয়েছিল।
ব্রেন্ডার মতো আমাদের কারো জীবনেও কি কর্মক্ষেত্রে কখনো না কখনো এমন পরিস্থিতি আসেনি?
মোটের ওপর আমরা আমাদের জীবনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ সময় কর্মক্ষেত্রে ব্যয় করি। তাই এই বিষয়টিকে আত্মপরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করাটা কোনো অদ্ভুত বিষয় নয়।
তবে কর্মক্ষেত্রে আপনার পারফরম্যান্সের সঙ্গে ব্যক্তি হিসেবে নিজের মূল্যায়নকে সমান ভাবাটা সাধারণ হলেও, এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসাও গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি অসম্ভব নয়।
কীভাবে কাজকে খুব বেশি ব্যক্তিগতভাবে নেওয়া থেকে বিরত থাকা যায় এবং বিষয়গুলোকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় তা জেনে নেই আসুন।
প্রতিক্রিয়া না দেখানো এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ
আপনি যখন কোনো পরিস্থিতিকে ব্যক্তিগত বিষয় (উদ্বেগ, হতাশা, পরাজয়) হিসেবে নেন, তখন আপনার মস্তিষ্ক মনে করে আপনি আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। মস্তিষ্ক তখন এই পরিস্থিতিটিকে আপনার দক্ষতা, সামাজিক অবস্থান বা এমনকি একটি দলের সঙ্গে আপনার যুথবদ্ধতার বোধের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করে।
এটি অ্যামিগডালাকে সক্রিয় করে এবং আপনার ভয় চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। এতে আপনি আহত, উদ্বিগ্ন বা এমনকি রাগ হতে পারেন।
এই আবেগগুলো যেহেতু সহজাত ও স্বাভাবিক, তাই এক্ষেত্রে আপনার প্রধান কাজ হবে 'আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা'। অর্থাৎ, আপনার মনের মধ্যে কি তোলপাড় চলছে কিংবা এই বিষয়টি নিয়ে এরপর আপনি কী পদক্ষেপ নেবেন তা অন্যদের বুঝতে না দিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ করা।
নিজেকে ডি-আইডেন্টিফিকেশন চর্চা করতে বা বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে নেওয়া থেকে বিরত রাখতে নিজেকে এভাবে বোঝান, 'আমি সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছি এবং বিষয়টিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে নিচ্ছি না।' অথবা, 'আমি এই চিন্তায় নিজেকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন না করে বিষয়টি নিয়ে হালকাভাবে ভাবতে পারি।'
এভাবে, আপনার অনুভূতিকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং ঘটনার বাইরে নিজেকে রেখে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে আপনি আপনার প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সকে সক্রিয় করতে পারেন।
মস্তিষ্কের এই অংশ আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে, সমস্যা সমাধানে এবং সংবেদনশীল বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের মতো কাজগুলো করে।
সব বিষয়কে ব্যক্তিগতভাবে না নেওয়া
কোনো নেতিবাচক পরিস্থিতিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার আগে একটু সময় নিন এবং নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, 'এই বিষয়টিকে (ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া, এই পরিস্থিতি ইত্যাদি) আমি আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি?'
এই সময়টুকু নেওয়ার মাধ্যমে আপনি নিজেই নিজের চিন্তাগুলো ঝালিয়ে নিতে এবং বিষয়টিকে আরও নিরপেক্ষভাবে যাচাই করার সুযোগ পেতে পারেন।
এছাড়া আপনি কারো আচরণ বা কথার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কমপক্ষে দুই থেকে তিনটি বিকল্প চিন্তা করতে পারেন।
যেমন ধরুন, মিটিংয়ে আপনার কোনো সহকর্মী আপনার কাজ সম্পর্কে অসৌজন্যমূলক কোনো মন্তব্য করলেন। এক্ষেত্রে তিনি আপনার কাজের অবমূল্যায়ন করছেন বা আপনাকে অপমান করছেন এমনটা ভাবার পরিবর্তে, তার এই কথা বলার আরও কিছু সম্ভাব্য কারণ ভাবতে চেষ্টা করুন।
এভাবে ভাবুন, আজ হয়ত ওই সহকর্মীর দিনটা ভালো যাচ্ছে না অথবা হতে পারে তিনি আপনার কাজটি পুরোপুরি না বুঝেই মন্তব্য করে ফেলেছে।
এই ধরনের মনোভাব আপনাকে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে তাৎক্ষণিক বিচার করা থেকে বিরত রাখতে পারে।
তাই আবেগে নিজেকে ভেতরে ভেতরে জর্জরিত না করে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্পষ্টভাবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করুন। এতে আপনি তার প্রতিক্রিয়ার উদ্দেশ্য আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন।
উদাহরণস্বরূপ: আপনি তাকে এভাবে জিজ্ঞেস করতে পারেন, 'গতকাল আপনার কথা শুনে আমি একটু কনফিউজড হয়ে পড়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আপনি কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। আপনি কি বিষয়টি নিয়ে আপনার মতামত পরিষ্কারভাবে আমায় বলতে পারেন?'
অথবা এভাবে বলতে পারেন, 'মিটিংয়ে আপনি এই ব্যাপারে (নির্দিষ্ট বিষয়) যা বলেছেন, আমি বিষয়টিকে এভাবে (আপনার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করুন) ভাবছি। আমি নিশ্চিত হতে চাচ্ছি যে আমি আপনার পয়েন্ট ঠিকভাবে বুঝতে পেরেছি কিনা। কারণ আপনার মতামত আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।'
ভয়কে মোকাবিলা করার সাহস সঞ্চয় করুন
পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, অল্প অল্প করে সাহস সঞ্চয় করুন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য। এই প্রক্রিয়াকে ডিসেনসিটাইজেশন বলা হয়।
আপনি যখন ঝুঁকি নেওয়ার এবং অস্বস্তিকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সাহস করবেন, একমাত্র তখনই অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে টিকে থাকার এবং তা মোকাবিলা করার সক্ষমতা অর্জন করবেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিজেকে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে দিলে তা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সেই বিষয়ের ভয় ও উদ্বেগ কমাতে পারে।
কোনো পরিস্থিতি নিজের উপর বোঝা হয়ে চাপার পরিবর্তে নিজেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চাওয়াটা আপনার মধ্যে শক্তিশালী বোধ সৃষ্টি করবে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়াবে।
আপনার চূড়ান্ত ভয়কে মোকাবিলা করার সক্ষমতা আপনার ব্যক্তিত্বে নতুনত্ব আনতে সহায়ক হবে।
পরিণতির কথা ভেবে সময় নষ্ট করলে ভয়ের মাত্রা বাড়তে থাকে, তাই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সাহস অর্জন করতে হবে।
ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিন
কোনো কাজ যখন পূর্বপরিকল্পনা মতো না হয়, কোনো প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়, বা যখন কোনো ক্লায়েন্ট অসন্তোষ প্রকাশ করে, তখন এই বিষয়গুলোকে নিজের ব্যর্থতা হিসেবে মনে করাটা খুব স্বাভাবিক। অনিবার্যভাবে এগুলো আপনার মনে হতাশা এবং নিজের সক্ষমতার প্রতি সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে।
আমি আপনাকে ব্যর্থতাকে পছন্দ করতে বা স্বাগত জানাতে বলছি না, শুধু বলছি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়াটা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এটি তুলনামূলক পরিণত একটি পদ্ধতি। এর ফলে আপনি নিজের অনুভূতিপ্রবণতাকে (মন খারাপ, রাগ, হতাশা) প্রাধান্য না দিয়ে, কাজের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।
তাই 'কেন আমার সঙ্গেই এটি হচ্ছে'-তা ভেবে চুল ছেঁড়ার বদলে আরও গঠনমূলক উপায়ে সমস্যাটি বিশ্লেষণে মন দিন। যেমন:
কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়? এর ফলে আপনার সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা বাড়বে।
অথবা, ভুলগুলো থেকে আমি কী শিখতে পারি? এটি আপনাকে আপনার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে উৎসাহিত করবে।
কাজটির কোন কোন দিক আমার পক্ষে আছে? এটি আপনাকে যেকোনো পরিস্থিতিতে অভিযোজনযোগ্যতা ও সহনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
অন্যদের কথা হাস্যরস বা সহানুভূতি দিয়ে ভাবুন
অন্যদের খারাপ আচরণের জন্য নিজেকে দোষী ভাবা বন্ধ করুন। এভাবে ভাবতে চেষ্টা করুন, অধিকাংশক্ষেত্রে ব্যক্তির আচরণ বা প্রতিক্রিয়া তার সংবেদনশীলতা বা অপরিণত আচরণের বহিঃপ্রকাশ। তাই তিনি যা বলেছেন বা করেছেন তাতে আপনার কথা বা কাজের প্রভাব খুব সীমিত।
আমার কিছু ক্লায়েন্ট এরকম পরিস্থিতিতে তাদের নেওয়া একটি অদ্ভুত কৌশলের কথা বলেছেন। অন্যরা যখন রাগ করে বাজে মন্তব্য করেন, তারা তখন ওইসব মানুষকে মনে মনে শিশু হিসেবে কল্পনা করেন। যেন একটি শিশু ভয় পেয়ে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছে। এভাবে চিন্তা করাটা তাদের মনে কোনো ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব কমাতে সহায়তা করে।
এই মানসিক কৌশলগুলো আপনাকে নেতিবাচক পরিস্থিতিকে ব্যক্তিগতভাবে নেওয়ার বদলে, সহানুভূতিশীলভাবে ভাবতে সহায়তা করবে।
মনে রাখবেন, কর্মক্ষেত্রের বিষয়গুলো ব্যক্তিগতভাবে নেওয়া দুর্বলতার লক্ষণ নয়। এটি আপনার আবেগময়, প্রতিশ্রুতিশীল ও গভীর দায়িত্ববোধের প্রতিফলন। তাই ব্যথিত না হয়ে সঠিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মাধ্যমে আপনি আরও স্পষ্ট, ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকরভাবে আপনার পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে পারবেন।
সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি