পাকিস্তানের সংকট জর্জরিত অর্থনীতি কি অবশেষে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে?
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বুধবার (১২ জুন) দেশটির নতুন অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ১৮ লাখ ৪৭ হাজার কোটি রুপির বাজেট ঘোষণা করেছেন।
যেখানে প্রায় ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ লাখ ১২ হাজার কোটি রুপি বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে প্রতিরক্ষা খাতে। ঋণ পরিশোধে বরাদ্দ করা হয়েছে সর্বোচ্চ অর্থ।
আগামী ২০ থেকে ২৪ জুন আলোচনা শেষে ২৮ জুন দেশটির পার্লামেন্টে পাস করা হবে বাজেট।
বিদায়ী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৩৮ শতাংশ। নতুন অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি।
অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেই ২৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে সরকারি চাকুরিজীবীদের বেতন।
রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে প্রায় দুই বছর ধরে দেশটি মন্দার সঙ্গে লড়ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সরকার সম্প্রতি ঋণ চুক্তির জন্য আইএমএফের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে। এছাড়া পাকিস্তানে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ করার সুযোগ নিয়ে আলোচনা করতে নওয়াজ শরিফ সম্প্রতি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং চীন সফর করেছেন।
তাহলে কি পাকিস্তানের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে? সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের সুফল কি সাধারণ মানুষের উপকারে আসছে? এবারের বাজেটে কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা?
পাকিস্তানের অর্থনীতি কি সত্যিই ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখাচ্ছে?
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আইএমএফ-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সর্বশেষ পরিসংখ্যান, কিছুটা ইতিবাচক পূর্বাভাসই দিয়েছে।
পাকিস্তানের পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মে মাসে পাকিস্তানের মুদ্রাস্ফীতি ৩৮ শতাংশে পৌঁছেছিল। চলতি বছরের মে মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১১.৮ শতাংশে। গত বছরের মে মাসে দেশটিতে এক কেজি গমের দাম ছিল ১৩০ রুপির (০.৪৭ ডলার) বেশি, এ বছর তা কমে ১০২ রুপি (০.৩৭ ডলার) হয়েছে।
জ্বালানির দামও কমেছে। ২০২৩ সালের মে মাসে প্রতি লিটার জ্বালানি তেল ২৮৮ রুপি (১.০৩ ডলার) (০.২৬ গ্যালন) থেকে কমে বর্তমানে প্রতি লিটারে ২৬৮ রুপি (০.৯৬ ডলার) হয়েছে।
দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২.৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল, যা দিয়ে মাত্র তিন সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব ছিল। বর্তমানে এর পরিমাণ ৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা প্রায় গত ছয় বছরের গড় পরিমাণের সমান।
একইভাবে, গত দুই বছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির দাম ৬০ শতাংশেরও বেশি কমে গিয়েছিল। বর্তমানে এক ডলারের মান ২৮০ রুপিতে মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে।
পুঁজি বাজারেও কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে। গত মাসে দেশটির পুঁজি বাজার সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার পয়েন্টে পৌঁছেছিল।
আইএমএফ, গত মে মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে ৩ বিলিয়ন ডলারের ৯ মাসের স্ট্যান্ড-বাই চুক্তি করেছে।
সম্প্রতি দেশটির সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির কথা আইএমএফও স্বীকার করেছে।
আইএমএফ জানিয়েছে, 'পাকিস্তানে মাঝারি প্রবৃদ্ধি হয়েছে; বাইরের চাপ কমে গেছে এবং এখনও অনেক বেশি হলেও ক্রমে দেশটির মুদ্রাস্ফীতি কমতে শুরু করেছে।'
দেশটির অর্থনীতিবিদরা একমত যে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
তবে তারা সতর্কতা অবলম্বন করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এই উন্নতি আমদানি হ্রাসসহ বেশকিছু নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে হয়েছে। তবে বিদ্যুতের দাম এখনও চড়া।
ইসলামাবাদভিত্তিক অর্থনীতিবিদ সাফিয়া আফতাব আল জাজিরাকে বলেন, 'স্থিতিশীলতা রয়েছে, তবে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রবৃদ্ধি নেই। আমদানির উপর নির্ভরশীলতা বেশি হওয়ায় খুব ধীরে প্রবৃদ্ধি অর্জন হচ্ছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে না এবং দ্রব্যমূল্য এখনও আকাশছোঁয়া।'
তবে করাচিভিত্তিক অর্থনীতিবিদ আম্মার হাবিব খান অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে বেশ আশাবাদী।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, 'অর্থনীতি একটি সামগ্রিক সমন্বিত প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এবং সংস্কার অব্যাহত থাকলে ট্রিকল-ডাউন এফেক্ট শুরু হবে। যদি এটি অব্যাহত থাকে তবে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাবে এবং ব্যবসায় আরও কর্মসংস্থান তৈরির জন্য পুনরায় বিনিয়োগ শুরু হবে।'
অর্থনৈতিক সূচকগুলোর উন্নতির সুফল কী জনসাধারণ পাচ্ছেন?
ইসলামাবাদের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট পলিসি ইনস্টিটিউটের (এসডিপিআই) জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ সাজিদ আমিন জাভেদ বলেন, এ ধরনের 'সাময়িক স্থিতিশীলতা' অতীতেও অর্জিত হয়েছে, কিন্তু তা কখনো বজায় রাখা যায়নি।
জাভেদ আল জাজিরাকে বলেন, 'অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এটি বিলীন হয়ে যায়।'
তিনি বলেন, আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে স্থিতিশীলতা অর্জনের চেষ্টার মূল্য সবসময়ই পাকিস্তানের জনগণকে দিতে হয়েছে।
জাভেদ বলেন, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য আমদানি হ্রাস করা এবং জ্বালানির দাম বৃদ্ধিসহ প্রভৃতি পদক্ষেপ উল্টো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রচেষ্টাকে শ্লথ করে দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টারের অর্থনীতিবিদ হিনা শেখও এই স্থিতিশীলতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে সন্দিহান।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।'
লাহোরভিত্তিক এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'রুপির বিনিময় হারও মুদ্রাস্ফীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি রুপির মান কমে যায় তাহলে পাকিস্তানকে ঋণ পরিশোধের জন্য অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হতে পারে।'
পাকিস্তানের সরকারি ঋণ দেশটির জন্য আরেকটি বিশাল বোঝা। এই বছর বৈদেশিক ঋণ ১৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা গত বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি।
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের চলতি বছরের শুরুর দিকের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ১২ মাসে পাকিস্তানকে প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
পাকিস্তানের এখন কী করা উচিত?
বিশেষজ্ঞরা চাকরিজীবী ও স্বল্পআয়ের মানুষের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করার পরিবর্তে, বিভিন্ন খাতে কর সম্প্রসারণের উপর জোর দিয়েছেন।
এই বাজেটে সরকারের প্রধান খাত রাজস্ব। দেশটিতে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। যদিও ২৪ কোটি পাকিস্তানির মধ্যে কর দেয় দেশটির মাত্র ৫ কোটি মানুষ বা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের আশেপাশে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টারের গত বছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও ভারতের চেন্নাই শহরের চেয়ে নগর সম্পত্তি থেকে পাকিস্তানের সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশ পাঞ্জাব কম কর আদায় করে।
খান বলেন, 'করের সীমা প্রসারিত করা দরকার। ব্যবসায়ীদের ঋণ সহায়তা প্রয়োজন, যাতে তারা অর্থনীতিতে পুনরায় বিনিয়োগ করতে পারে।'