কঠিন সময়ে নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নিল জাপান
জাপানের ক্ষমতাসীন দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) শিগেরু ইশিবাকে তাদের নতুন নেতা হিসেবে নির্বাচিত করেছে। ফলে তিনিই হবেন জাপানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
এলডিপির নেতৃত্বের জন্য নয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তবে বেশিরভাগ জনমত জরিপে এগিয়ে ছিলেন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ৬৭ বছর বয়সি ইশিবাই।
এর আগে গত মাসে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি আর এলডিপি নেতৃত্বের জন্য নির্বাচনে লড়বেন না। এর পরই এলডিপি নতুন নেতা বাছাইয়ের ব্যবস্থা করে।
যেহেতু সংসদে এলডিপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, তাই এ দলের নতুন প্রধানই জাপানের প্রধানমন্ত্রী হবেন।
উল্লেখ্য, যুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে এলডিপিই জাপানের ক্ষমতায় রয়েছে।
এলডিপি এক অস্থির সময় পার করছে। অন্তর্কোন্দল ও কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত হয়ে দলটির অবস্থান অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
পঞ্চমবারের চেষ্টায় দলের প্রধান হলেন শিগেরু ইশিবা। দলের মধ্যে নিজস্ব ভোটাভুটিতে প্রধান নির্বাচিত করা হয়েছে। শেষপর্যন্ত ইশিবার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সানায়ে তাকাইচি। তাকাইচি জিতে গেলে তিনি হতেন জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে ইশিবা নারী সম্রাটের অনুমোদন দেওয়ার পক্ষপাতী, যা অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। অনেক এলডিপি সদস্যই এই মতের বিরোধী।
ইশিবা প্রধানমন্ত্রী কিশিদার প্রকাশ্য সমালোচক। এমনটা সচরাচর জাপানের রাজনীতিতে বিরল। তিনি রাখঢাক না করেই কিশিদার সমালোচনার জন্য পরিচিত। এতে জনসাধারণের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় করলেও দলের সদস্যরা বিরক্ত।
অন্যদিকে তাকাইচি এলডিপি নেতৃত্বের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা দুই নারীর একজন এবং প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে রক্ষণশীল ছিলেন।
তাকাইচি প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তিনি নারীর ঐতিহ্যগত ভূমিকা বজায় রাখার পক্ষে। বিয়ের পরেও নারীদের নিজস্ব নাম ব্যবহার করার এবং নারী সম্রাটদের অনুমোদন দেয়—এমন আইনের বিরোধী তিনি।
গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি, স্থবির অর্থনীতি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে এলডিপি। তাই নতুন নেতা সামনে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে পাওয়ার চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
এই কেলেঙ্কারিগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল এলডিপির মধ্যে বিতর্কিত ইউনিফিকেশন চার্চের প্রভাব এবং সন্দেহ যে দলের উপদলগুলি বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক তহবিলের ভুল হিসাব দিয়েছে। এই তহবিল কেলেঙ্কারির কারণে এলডিপির ছয়টি উপদলের মধ্যে পাঁচটি বিলুপ্ত হয়েছে, যা দীর্ঘদিন ধরে দলের ভিত্তি হিসেবে ছিল এবং এলডিপি নেতৃত্ব নির্বাচনে প্রার্থী জয়ী হতে সমর্থন প্রদান করত।
এই প্রার্থীদের মধ্যে ছিলেন সানে তাকাইচি, তাকাইউকি কোবায়াশি, ইয়োশিমাসা হায়াশি, শিনজিরো কোইজুমি, ইয়োকো কামিকাওয়া, কাতসুনোবু কাতো, তারো কোনো, শিগেরু ইশিবা এবং তোশিমিতসু মোতেগি। এলডিপির নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আসলে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা। রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং সংগ্রামী পরিবারগুলি দলের সমর্থন হ্রাস করেছে, যা সামনের সাধারণ নির্বাচনে দলের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
জাপানের মানুষ সবচেয়ে উদ্বিগ্ন দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা নিয়ে। করোনা মহামারির পর ইয়েনের দাম পড়ে যাওয়া, স্থবির অর্থনীতি ও প্রায় অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত বেড়ে চলা খাদ্যমূল্যের কারণে চাপে রয়েছে জাপানের সাধারণ পরিবারগুলো।
অর্গানাইজেশন ফ ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) তথ্য অনুযায়ী, জাপানে গত ৩০ বছরে মজুরি প্রায় বাড়েনি বললেই চলে। এর সঙ্গে ৩০ বছরের মূল্যস্ফীতির যোগ হয়ে জাপানের পরিবারগুলোর জন্য সময় আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। দিন দিন সরকারি সহায়তার আহ্বান জোরালো হচ্ছে।
এই বৈরী পরিস্থিতি এলডিপির অবস্থানকে দুর্বল করে দিচ্ছে। ভোটাররা দলটির উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।
ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মিকো নাকাবায়াশি বিবিসিকে বলেন, 'মানুষ এখনকার মূল্যস্ফীতি নিয়ে হতাশ।' …জাপানি মুদ্রার মান কমে গেছে, মূল্যস্ফীতির সাথে সাথে অনেক আমদানিপণ্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে।'
এলডিপির জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জাপানের বার্ধক্য ও ক্রমেই কমতে থাকা জনসংখ্যা, যা সামাজিক ও চিকিৎসা সেবা ওপর চাপ তৈরি করছে। এটি দেশের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মশক্তির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাপান কীভাবে তার শ্রমবাজার পরিচালনা করবে এবং অভিবাসন নিয়ে মনোভাব বদলানো উচিত কি না, তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে এলডিপি সরকারকে।
২০২৫ সালের অক্টোবর নাগাদ জাপানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই এলডিপির জন্য এসব চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে সাধারণ নির্বাচনকে এগিয়ে আনার দাবিও রয়েছে।
প্রথম রাউন্ডে ইশিবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বাকি সাত প্রার্থী ছিলেন: ৪৩ বছর বয়সি শিনজিরো কোইজুমি; পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অপর নারী প্রার্থী ৭১ বছর বয়সি ইয়োকো কামিকাওয়া; ৬১ বছর বয়সি ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন মন্ত্রী তারো কোনো; ৬৩ বছর বয়সি প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইয়োশিমাসা হায়াশি; ৬৮ বছর বয়সি এলডিপির সেক্রেটারি জেনারেল তোশিমিতসু মোতেগি; ৪৯ বছর বয়সি সাবেক অর্থনৈতিক নিরাপত্তামন্ত্রী তাকাইউকি কোবায়াশি; এবং ৬৮ বছর বয়সি সাবেক প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব কাতসুনোবু কাতো।
এই নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া নয়জন প্রার্থীর মধ্যে চারজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তিনজন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।