দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট কেন হঠাৎ সামরিক আইন জারি করলেন?
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) রাতে আকস্মিকভাবে সামরিক আইন জারি করে দেশবাসীকে চমকে দেন। এশিয়ার এই গণতান্ত্রিক দেশে প্রায় ৫০ বছরের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা প্রথমবারের মতো ঘটল।
রাতের টেলিভিশন ভাষণে প্রেসিডেন্ট জানান, "রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি" এবং উত্তর কোরিয়ার হুমকির কারণে তিনি এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়, এ সিদ্ধান্ত বাইরের কোনো হুমকির কারণে নয়; বরং তার নিজস্ব রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলার চেষ্টা।
সামরিক আইন জারির পরপরই হাজারো মানুষ সিউলের পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বিক্ষোভে নামেন। এ সময় বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা দ্রুত পার্লামেন্টে জরুরি অধিবেশনে মিলিত হয়ে সামরিক আইন প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাস করেন।
বিরোধীদের এই উদ্যোগে পরাজিত হয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ইউন পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত মেনে নেন এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন।
কী ঘটেছিল?
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের আকস্মিক সামরিক আইন জারির প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে তৈরি হয় চরম উত্তেজনা। বিশ্লেষকদের মতে, ইউন নিজেকে চাপে থাকা এক প্রেসিডেন্ট হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
মঙ্গলবার রাতের ভাষণে তিনি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন, তারা তার সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। এরপর তিনি ঘোষণা দেন, "রাষ্ট্রবিরোধী শক্তিকে দমন করতে" সামরিক আইন জারি করা হয়েছে।
এই আদেশের ফলে সাময়িকভাবে সেনাবাহিনী দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। হেলমেট পরা সেনা ও পুলিশ বাহিনী জাতীয় সংসদ ভবন ঘিরে ফেলে এবং ভবনের ছাদে হেলিকপ্টার অবতরণ করতে দেখা যায়।
স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখানো হয়, মুখোশধারী সশস্ত্র সেনারা সংসদ ভবনে প্রবেশ করছে, যেখানে কর্মীরা আগুন নেভানোর যন্ত্র ব্যবহার করে তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে (স্থানীয় সময়) সেনাবাহিনী একটি নির্দেশনা জারি করে, যেখানে বিক্ষোভ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিষিদ্ধ করা হয়।
কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিবিদরা দ্রুত প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দেন। ইউনের নিজ দল কনজারভেটিভ পিপলস পাওয়ার পার্টির নেতা পর্যন্ত এই পদক্ষেপকে "ভুল সিদ্ধান্ত" হিসেবে বর্ণনা করেন।
অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা লি জে-মিউং তার দলীয় সংসদ সদস্যদের সংসদে উপস্থিত হয়ে সামরিক আইন প্রত্যাখ্যানের জন্য ভোট দিতে আহ্বান জানান। তিনি সাধারণ জনগণকেও বিক্ষোভে অংশ নিতে আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, "ট্যাংক, সাঁজোয়া যান এবং অস্ত্রধারী সেনারা দেশ শাসন করবে। প্রিয় নাগরিকগণ, জাতীয় সংসদে আসুন।"
তার এই ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ সংসদ ভবনের বাইরে জড়ো হন। "সামরিক আইন প্রত্যাহার কর!" এবং "স্বৈরাচার প্রতিহত কর!" স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে এলাকা।
সংসদ ভবনের প্রবেশপথে কিছু বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেলেও পরিস্থিতি বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নেয়নি। আইনপ্রণেতারা সামরিক বাধা অতিক্রম করে, এমনকি বেড়া টপকিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য সংসদ কক্ষে পৌঁছান।
বুধবার রাত ১টার কিছু পর, দক্ষিণ কোরিয়ার সংসদে ৩০০ সদস্যের মধ্যে ১৯০ জন উপস্থিত হয়ে সামরিক আইন প্রত্যাখ্যান করেন। প্রেসিডেন্ট ইউনের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক আইনের তাৎপর্য কতটুকু?
মার্শাল ল বা সামরিক আইন হলো সামরিক কর্তৃপক্ষের অস্থায়ী শাসনব্যবস্থা। সাধারণত বেসামরিক প্রশাসন অকার্যকর হয়ে পড়লে, জরুরি অবস্থায় এই আইন জারি করা হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সর্বশেষ সামরিক আইন করা হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। তখন দেশের দীর্ঘমেয়াদি সামরিক শাসক পার্ক চুং-হি একটি অভ্যুত্থানে নিহত হন। ১৯৮৭ সালে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশটিতে আর কখনো সামরিক আইন প্রয়োগ করা হয়নি।
তবে মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল আকস্মিকভাবে এই পদক্ষেপ নেন। তিনি জাতীয় ভাষণে বলেন, "রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি" থেকে দক্ষিণ কোরিয়াকে রক্ষা করতেই এ সিদ্ধান্ত।
উত্তর কোরিয়ার প্রতি আগের প্রেসিডেন্টদের তুলনায় আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা ইউন রাজনৈতিক বিরোধীদের "উত্তর কোরিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল" বলে আখ্যা দেন। যদিও এর পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেননি তিনি।
সামরিক আইনের অধীনে সামরিক বাহিনী বাড়তি ক্ষমতা পায়, আর নাগরিক অধিকার এবং আইনের শাসনের মানদণ্ড অনেক সময় স্থগিত থাকে।
তবে মঙ্গলবার ঘোষণার পর সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ জারি করলেও বিক্ষোভকারী এবং রাজনীতিবিদরা তা উপেক্ষা করেন।
এর পাশাপাশি, স্বাধীন গণমাধ্যমের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম ইয়োনহাপ সহ অন্যান্য গণমাধ্যম স্বাভাবিকভাবে তাদের সংবাদ পরিবেশন চালিয়ে যায়।
কেন চাপে ছিলেন প্রেসিডেন্ট ইউন?
২০২২ সালের মে মাসে কঠোর রক্ষণশীল হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও ইউন সুক-ইওল এই বছরের এপ্রিল থেকে কার্যত এক 'নিষ্ক্রিয় প্রেসিডেন্ট' হয়ে পড়েন। সাধারণ নির্বাচনে বিরোধী দল বিপুল বিজয় লাভ করার পর থেকেই তার সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে।
বিরোধী দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় ইউন সরকার কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস করতে পারছে না। বরং তাদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিরোধীদের পাস করা বিলগুলো ভেটো দেওয়া।
এ বছরের শুরু থেকে একাধিক দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে তার জনপ্রিয়তায় বড় ধরনের ধস নামে। সাম্প্রতিক জরিপে তার গ্রহণযোগ্যতা মাত্র ১৭ শতাংশের আশেপাশে অবস্থান করছে।
কেলেঙ্কারির মধ্যে রয়েছে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে অভিযোগ, যেখানে ফার্স্ট লেডি একটি ডিওরের ব্যাগ উপহার গ্রহণ করেছেন। আরেকটি অভিযোগে বলা হয়েছে, শেয়ারবাজারে কারসাজিতে প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
গত মাসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইউন এই বিষয়ে ক্ষমা চেয়ে জানান, ফার্স্ট লেডির কার্যক্রম তদারকির জন্য তিনি একটি নতুন অফিস চালু করছেন। তবে বিরোধী দল যে বিস্তৃত তদন্ত দাবি করেছিল, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এ পরিস্থিতিতে বিরোধী দল একটি বড় বাজেট বিল কাটছাঁটের প্রস্তাব দেয়, যাতে প্রেসিডেন্ট ভেটো দিতে পারবেন না। একই সঙ্গে তারা কয়েকজন মন্ত্রী এবং সরকারি অডিট সংস্থার প্রধানসহ শীর্ষ কয়েকজন প্রসিকিউটরকে অভিশংসনের উদ্যোগ নেন। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ফার্স্ট লেডির বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এখন কী হতে চলেছে?
প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের সামরিক আইন জারির ঘটনায় দেশবাসী বিস্মিত হয়ে পড়ে। ছয় ঘণ্টার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় এক ধরনের বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। মানুষ বুঝতে পারছিল না, এ ঘোষণার পর কী ঘটতে চলেছে।
তবে বিরোধী দল দ্রুত সংসদে সমবেত হয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সামরিক আইন প্রত্যাখ্যান করে। রাজধানীতে সেনা ও পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি সত্ত্বেও সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের চেষ্টা বাস্তবায়িত হয়নি।
দক্ষিণ কোরিয়ার আইনে বলা আছে, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে দাবি উঠলে সরকারকে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। একই আইন অনুযায়ী, সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কোনো সংসদ সদস্যকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না।
তবে ইউনের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তার এই আকস্মিক ও বিতর্কিত পদক্ষেপ দেশজুড়ে সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। মঙ্গলবার রাতে সংসদ ভবনের বাইরে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া কিছু মানুষ "ইউন সুক-ইওলকে গ্রেপ্তার করো" বলেও স্লোগান দেন।
নিজেকে আধুনিক ও সমৃদ্ধ গণতন্ত্র হিসেবে গড়ে তোলা দক্ষিণ কোরিয়া এই ঘটনাকে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি দক্ষিণ কোরিয়ার গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির জন্য বড় আঘাত, যা হয়ত ৬ জানুয়ারির যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল ভবনে বিশৃঙ্খলার প্রভাবকেও ছাড়িয়ে যাবে।
সিউলের ইহওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিফ-এরিক ইজলি বলেন, "ইউনের সামরিক আইন জারি করা আইনি সীমালঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত, যা দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি তৈরি করেছে।"
ইজলি বলেন, "এটি একজন চাপে থাকা রাজনীতিবিদের পদক্ষেপ, যিনি কেলেঙ্কারি, প্রাতিষ্ঠানিক বাধা এবং অভিশংসনের আহ্বানের মধ্যে মরিয়া হয়ে এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন। এই পরিস্থিতি এখন আরও জটিল হবে।"
দেশটির সংসদের স্পিকার বুধবার বলেছেন, "আমরা জনগণের সঙ্গে মিলে গণতন্ত্র রক্ষা করব।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়