দ. কোরিয়ায় বিমান দুর্ঘটনা: রানওয়ের শেষ মাথায় দেয়াল ছিল কেন?
গত রোববার (২৯ ডিসেম্বর) ১৮১ আরোহী নিয়ে বিধ্বস্ত হয় দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু এয়ারলাইন্স। বিমানটি থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে ফিরছিল। দুর্ঘটনায় ১৭৯ জন মারা গেছেন। দুজন ক্রুকে ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর প্রকাশিত ফুটেজে দেখা গেছে, মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে গিয়ে প্রায় ২৫০ মিটার দূরে অবস্থিত একটি দেয়ালের সঙ্গে সংঘর্ষের পরই আগুন ধরে যায় বিমানটিতে।
রানওয়ের শেষে থাকা এই 'অস্বাভাবিক' কংক্রিটের দেয়াল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ডেভিড লিয়ারমাউন্টের মতে, যদি ওই দেয়ালটি না থাকত, তবে বিমানটি সম্ভবত নিরাপদে থেমে যেতে পারত এবং বেশিরভাগ যাত্রী বেঁচে যেত।
বিমানটি একটি পাখির সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার পর প্রথমবার অবতরণের চেষ্টা বাতিল করেন পাইলট, তিনি রানওয়ের বিপরীত দিক থেকে অবতরণের অনুমতি চান।
এরপর ২ হাজার ৮০০ মিটার দীর্ঘ রানওয়ের কিছুটা দূরে বিমানটি নেমে চাকা বা ল্যান্ডিং গিয়ার ব্যবহার ছাড়াই অবতরণ করে।
লিয়ারমাউন্ট জানান, ফ্ল্যাপ বা গিয়ারবিহীন অবতরণ হিসেবে এটি যতটা সম্ভব সঠিক ছিল—ডানাগুলো সমান ছিল, বিমানের নোজ বা নাক বেশি ওপরে ছিল না যাতে টেইল ভাঙার ঝুঁকি এড়ানো যায়। রানওয়ে বরাবর স্লাইড করার সময় বিমানের বড় কোনো ক্ষতি হয়নি'।
তিনি আরও বলেন, এতগুলো মানুষের মৃত্যুর কারণ অবতরণ নয়, বরং রানওয়ে শেষে থাকা শক্ত কংক্রিটের দেওয়ালের সঙ্গে বিমানের সংঘর্ষ।
একই মন্তব্য লুফথানসার মিউনিখভিত্তিক পাইলট ক্রিশ্চিয়ান বেকার্টরেও। তিনি কংক্রিটের এই কাঠামোকে 'অস্বাভাবিক' আখ্যা দিয়ে রয়টার্সকে বলেছেন, সাধারণত, কোনো বিমানবন্দরে রানওয়ের শেষে এভাবে একটি দেয়াল থাকে না।
দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়োনহাপ নিউজ এজেন্সির প্রতিবেদন অনুসারে, কংক্রিটের এই কাঠামোতে লোকালাইজার নামের একটি নেভিগেশন সিস্টেম রয়েছে—এটি মূলত বিমান অবতরণে সহায়তা করতে দিক নির্দেশনা প্রদান করে।
সঠিকভাবে কাজ করার জন্য এটিকে এভাবে মাটির স্তূপের ওপর ৪ মিটার উঁচুতে স্থাপন করা হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশটির বিভিন্ন বিমানবন্দর এবং কিছু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এমন কংক্রিটের কাঠামো ব্যবহার করা হয়। তবে তারা পরীক্ষা করে দেখবে, এটিকে আরও হালকা উপাদানে তৈরি করা যায় কিনা, যাতে এটি সংঘর্ষে সহজেই ভেঙে পড়ে।
৪৮ বছরের অভিজ্ঞ পাইলট ক্রিস কিংসউড, যিনি একই মডেলের বিমান চালিয়েছেন, বিবিসিকে বলেন, রানওয়ের নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে থাকা বাধাগুলো ভঙ্গুর হওয়া উচিত, যাতে বিমান ধাক্কা দিলে তা ভেঙে যায়।
তিনি আরও বলেন, 'এটি অস্বাভাবিক যে কাঠামোটি এত শক্ত। যতটুকু বুঝতে পারি, বিমানটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছিল এবং রানওয়ের অনেক ভেতরে অবতরণ করেছিল। ফলে এটি রানওয়ে পেরিয়ে অনেক দূর চলে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাধার স্থান নির্ধারণ অবশ্যই তদন্তের বিষয়।'
কিংসউড বলেন, বিমানের কাঠামো মজবুত নয়। এগুলো এমনভাবে নকশা করা হয় যাতে হালকা থাকে এবং সহজেই উড়তে পারে। কিন্তু যদি দ্রুতগতিতে চাকা ছাড়া মাটিতে ঘেঁষে চলে, তাহলে যেকোনো শক্ত কাঠামো ফিউসেলাজ ভেঙে দিতে পারে যা বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
'বিমানের জ্বালানি তার দুই ডানায় থাকে, তাই ডানা ভেঙ্গে গেলে আগুন লাগার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই এটাও বলা যায় না যে, ওই দেয়াল না থাকলে পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন হতো', বলেন কিংসউড।
তিনি আরও বলেন, 'বিমানবন্দরটি শিল্প মান অনুসারে সমস্ত মানদণ্ড পূরণ করেনি এমনটা প্রমাণিত হলেও আমি অবাকই হবো '।
'আমার মনে হয়, যদি আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরিদর্শন করি, তাহলে এমন অনেক বাধা দেখা যাবে যা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে', যোগ করেন তিনি।
যেহেতু বিমানটি রানওয়ের বিপরীত দিক থেকে অবতরণ করছিল, তাই রানওয়ের মাথায় যে এরকম একটা দেয়াল রয়েছে তা পাইলটরা জানতেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এভিয়েশন বিশ্লেষক স্যালি গেথিন।
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'আমরা জানতে চাই, পাইলটরা কি জানতেন রানওয়ের শেষে এই শক্ত দেয়ালটি ছিল?'
তিনি আরও বলেন, 'দ্বিতীয়বার অবরতরণের সময় এটিসি (আকাশযান নিয়ন্ত্রক দল) রানওয়ের উলটো পাশ ব্যবহারের জন্য নির্দেশ দিয়েছিল কিনা, তা ব্ল্যাক বক্সের তদন্তের পরই বলা যাবে'।
'এখনও অনেক প্রশ্ন সবার মনে'।