ঈদের আগে আইসিডিতে রপ্তানি পণ্যের চাপ, পরিবহন ভাড়া বেড়েছে চারগুণ
চট্টগ্রামের বেসরকারি আইসিডিগুলোতে তৈরী পোশাক সহ রপ্তানি পণ্যের চাপ বেড়ে গেছে। ঈদের টানা ছুটির আগেই গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে রপ্তানিপণ্য ডিপোতে পাঠানোর কারণে পণ্য কন্টেইনার বোঝাই করতে হিমশিম খাচ্ছে ডিপো মালিকরা। এতে পণ্য আনলোডিংয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত পরিবহন শ্রমিকদের।
ফলে দিন দিন বেসরকারি ডিপোগুলোর বাইরে রপ্তানিপণ্য বোঝাই কাভার্ড ভ্যানের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে ডিপোতে পণ্য নিয়ে আসার ৮ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে কাভার্ড ভ্যানে পণ্য আনলোডিং শেষ হয়। বর্তমানে একটি কাভার্ড ভ্যান ডিপোতে আসার পর পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করছে।
এর ফলে বেড়ে গেছে কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের ডিপোমুখী একটি কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া ছিলো ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। কাভার্ড ভ্যান সংকটের কারণে ভাড়া বেড়েছে ৫০ হাজার টাকা থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজীকরণ করতে প্রথমে ডিপোতে এনে কন্টেইনার বোঝাই করতে হয়। এরপর জাহাজের শিডিউল সাপেক্ষে ডিপো থেকে বন্দরের হুক পয়েন্টে (যে স্থান থেকে কন্টেইনার জাহাজে তোলা হয়) নিয়ে যাওয়া হয়।
চট্টগ্রামে মোট ১৯টি বেসরকারি আইসিডি রয়েছে। এগুলোর কন্টেইনার ধারণ সক্ষমতা ৭৬ হাজার ২৫৫ টিইইউস (টুয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট)। তবে গত ৪ জুন বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর এই ডিপোর কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এই ডিপোতে কন্টেইনার রাখার সক্ষমতা ৬ হাজার ৫০০ টিইইউস।
বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান-ট্রাক-প্রাইমমুভার পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব চৌধুরী জাফর আহমেদ টিবিএসকে বলেন, ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চট্টগ্রামের ডিপোগুলোতে রপ্তানি পণ্য নিয়ে আসা কাভার্ড ভ্যানগুলো পণ্য আনলোড করতে পারছেনা। একেকটি কাভার্ড ভ্যান পাঁচ থেকে দশ দিন পর্যন্ত আটকে আছে। এর ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী একটি কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া ১৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৫০-৬০ হাজার টাকা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন চট্টগ্রামে আইসিডি, খাতুনগঞ্জ, বন্দর সহ বিভিন্ন পয়েন্টে পণ্য নিয়ে চট্টগ্রামের প্রায় ১০ হাজার কাভার্ড ভ্যান আসা-যাওয়া করে। এর মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার কাভার্ড ভ্যান আটকা পড়েছে আইসিডিগুলোতে।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকার এসএপিএল কন্টেইনার ডিপোতে গার্মেন্টস পণ্য নিয়ে আসা কাভার্ড ভ্যান চালক মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, আশুলিয়া থেকে পণ্য নিয়ে আমি গত রবিবার (৩ জুলাই) সকালে ডিপো গেইটে পৌঁছি। কখন পণ্য আনলোড করা হবে এর কোন তথ্য দিচ্ছে না ডিপোর কর্মকর্তারা। ডিপোর আশেপাশে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে। ঈদের আগে পণ্য আনলোড করতে না পারলে পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপনও করতে পারবোনা।
ঢাকার শ্যামলী থেকে পণ্য নিয়ে আসা কাভার্ড ভ্যান চালক মীর হোসেন জানান, গত ২ জুলাই শনিবার দুপুরে আমি পণ্য নিয়ে ডিপো গেইটে পৌঁছাই। ডিপোর কর্মকর্তারা বলেছেন, ভেতরে পণ্যের জট লেগে গেছে। তাই পণ্য আনলোডিংয়ে সময় লাগছে।
এদিকে কাভার্ড ভ্যান সংকটের কারণে ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় গার্মেন্টস মালিকরা আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। বিষয়টি উল্লেখ করে গত ৩ জুলাই বিজিএমইএ'র ফাস্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতিকে একটি চিঠি দিয়েছেন।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সাধারণত ঈদ মৌসুমে পোশাক শিল্পের রপ্তানি চালান জাহাজীকরণের শিডিউল বেশি থাকে। একইভাবে আসন্ন ঈদ-উল-আযহার আগেও প্রাইভেট আইসিডি সমূহে পোশাক শিল্পের চালান হ্যান্ডেলিংয়ে প্রচুর চাপ রয়েছে। কিন্তু প্রাইভেট আইসিডি সমূহের অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণে পণ্যবাহী কাভার্ড ভ্যান ট্রাকসমূহকে ৪ থেকে ৮ দিন অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, আসন্ন ঈদের পূর্বে শ্রমিকদের যথাসময়ে বেতন ভাতা পরিশোধে বিলম্বের কারণে শ্রমিক অসন্তোষ সহ এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। ঈদ-উল-আযহার পূর্বে যথাসময়ে রপ্তানি পণ্য চালান জাহাজীকরণে রপ্তানি পণ্যবাহী কাভার্ড ভ্যান/ ট্রাকে ভাড়া যৌক্তিক ও সহনীয় পর্যায়ে রাখার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ট্রাক / কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাথে প্রয়োজনীয় জরুরী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে।
চট্টগ্রাম চেম্বার ছাড়াও একই ইস্যুতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক, নগর পুলিশ কমিশনার, বিকডার (বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন) কাছেও চিঠি দিয়েছে বিজিএমইএ।
বিজিএমই'র সহ সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, আইসিডিতে পণ্য নিয়ে কাভার্ড ভ্যান আটকে থাকার সুযোগে মালিকরা অতিরিক্ত হারে ভাড়া আদায় করছে। যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ও অসহনীয়। এতে করে রপ্তানিকারকগণ প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং যথাসময়ে পণ্য চালান জাহাজীকরণে বিলম্বের কারণে রপ্তানি আদেশ বাতিল সহ এয়ার শিপমেন্টের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
এদিকে আইসিডিতে রপ্তানিপণ্যের চাপ বাড়ার দুটি কারণ উল্লেখ করেছে বেসরকারী আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডা।
বিকডা সূত্র জানিয়েছে, ঈদের টানা ছুটির কারণে গার্মেন্টস মালিকরা জাহাজের নির্ধারিত শিডিউলের অনেক আগেই রপ্তানি পণ্য আইসিডিতে পাঠিয়ে দেয়। একসাথে অনেক পণ্য আনলোড এবং কন্টেইনার বোঝাই করতে গিয়ে কাভার্ডভ্যানগুলোকে দিনের পর দিন বাইরে অপেক্ষায় থাকতে হয়। এছাড়া বিএম ডিপোর কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে অন্য বড় ডিপোগুলোতে আমদানি ও রপ্তানি কন্টেইনারের চাপ বেড়েছে।
বিকডার সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল আমিন শিকদার টিবিএসকে বলেন, ১৯টি আইসিডিতে রপ্তানি কন্টেইনারের ধারণক্ষমতা ১০ হাজার টিইইউস। স্বাভাবিক সময়ে রপ্তানিমুখী কন্টেইনার থাকে ৬ হাজার। ৫ জুলাই পর্যন্ত আইসিডিগুলোতে রপ্তানিমুখী কন্টেইনারের সংখ্যা ১১ হাজার ৫০০ টিইইউস। এছাড়া ৫ জুলাই পর্যন্ত আইসিডিগুলোতে আমদানি কন্টেইনার ৮ হাজার ১০০ টিইইউস এবং খালি কন্টেইনার রয়েছে ৩৪ হাজার টিইইউস।
তিনি আরো বলেন, স্বাভাবিক সময়ে একটি কাভার্ড ভ্যান ডিপোতে আসার ৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য আনলোডিং সম্পন্ন করতো। অতিরিক্ত পণ্য আসার কারণে ৩ থেকে ৬ দিন পর্যন্ত ডিপোর সামনে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।