বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হলে কী ঘটে?
১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি ভারত তার সংবিধান গ্রহণ করে। সংবিধান গ্রহণ করার পরবর্তী দুই দিনের মাথায় অর্থাৎ পঞ্চাশের ২৮ জানুয়ারি ভারতের ফেডারেল সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হয়। বর্তমানে এই সুপ্রিম কোর্টের ৪৫তম প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করছেন বিচারপতি এমভি রমন। গত ১৬ জানুয়ারি রাজস্থানের পার্লামেন্ট ভবনে কমনওয়েলথ পার্লামেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে একটি অনুষ্ঠান হয়। যেখানে ভারতের আইনমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের একাধিক জ্যৈষ্ঠ বিচারপতি, বার কাউন্সিলের সভাপতি, বারের সভাপতি অ্যাটর্নি জেনারেল প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন। এমন একটি অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন, তা ভারতের গণতন্ত্র সম্পর্কিত রাজনীতিবিদদের যে গর্ব তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর (চীনের জনসংখ্যাকে টপকে যাবে ভারত) দেশ সবচেয়ে বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ, সবচেয়ে বড় লিখিত সংবিধানের দেশ। এমন সব শ্রেষ্ঠত্বের কৃতিত্ব যাদের দখলে সেই ভারতের প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেছেন যে, দেশের আইন প্রণেতারা কিভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রকে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছেন। তিনি তার বক্তব্যে সংসদীয় গণতন্ত্র ও সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার মধ্যে একটি সীমানা রেখা টেনেছেন। যেখানে সংবিধানের চর্চা হওয়ার কথা, আইন প্রণয়নের সঙ্গে সংবিধানের সম্পর্ক থাকার কথা, সেখানে সেসব কিছু হচ্ছে না। বরং এমন কিছু আইন তৈরি হচ্ছে যে আইনের বিরুদ্ধে আবার আদালতে মামলা হচ্ছে। ওই সমস্ত আইনের সঙ্গে অনেক সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হওয়ায় এসব মামলা হচ্ছে। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদরা মনোযোগী হচ্ছেন না কিংবা যথাযথভাবে বিরোধী দলের কথা শোনা হচ্ছে না।
প্রধান বিচারপতি মনে করেন ভারতের বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্রের জায়গায় স্থান নিয়েছে সংসদীয় সরকার। ফলে বিরোধীদলের কথা শোনা হচ্ছে না। কিংবা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে না, এবং এটা যা একটি মারাত্মক অভিযোগ। তিনি সংসদের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রেখেই কথাগুলো বলেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে প্রায় ক্ষেত্রেই আমাদের বিচারক ও বিচারপতিদের সংকটের মোকাবেলা করতে হয় ওই সমস্ত আইনের জন্য।
৭০ বছরের গণতান্ত্রিক চর্চার দেশটিতে তার প্রধান বিচারপতির এসব উক্তি দেশটির সামগ্রিক অবস্থান তুলে ধরছে। ভারতের ইতিহাসে তিনবার প্রধান বিচারপতির পদকে ঘিরে নির্বাহী বিভাগ প্রচলিত নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছিল। ১৯৭৩ এবং ১৯৭৭ সালে দুবার দুজন প্রধান বিচারপতির মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, যারা জ্যেষ্ঠতার বিচারে প্রধান জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন না। ১৯৫০ থেকে ভারতে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতেই প্রদান করা হচ্ছিল।
বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তান এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। পাকিস্তান ও ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদটি জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতেই পূরণ হয়। ফলে ভারত এবং পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক পছন্দের কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার কোন সুযোগ নাই। ফলে সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক নানান প্রশ্নে প্রায়ই সরকারের মুখোমুখি হয় এই দুই দেশে। কখনো কখনো মনে হয়, বিচার বিভাগ হয়তো সরকারের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে।
ভারতের প্রধান বিচারপতি তুলে ধরেছেন, আইন প্রণয়নের সময়ে আইন সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে বিশদ কোনো আলোচনা হচ্ছে না। তার মতে, রাজনীতিবিদদের অনেকেই আইন প্রণেতাদের সাথে বিচার বিভাগের ক্ষমতার লড়াই ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে, কিন্তু তিনি তা সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন আইন প্রণেতাদের প্রতি তার সম্পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস রয়েছে। তবে আইন প্রণয়নের সময় ব্যাপক আলোচনা ও যাচাই-বাচাইয়ের অভাব বিচার বিভাগের উপর চাপ সৃষ্টি করে। আইন প্রণয়নের বিলগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয় না আর এর উপর বিরোধী দলের ভালো অর্থপূর্ণ পরামর্শগুলোকে স্থান দেওয়া হয় না। আইন প্রণয়নে এই দুটি বিষয় যদি প্রাধান্য দেওয়া হতো তাহলে আমাদের জন্য আরো ভালো আইন তৈরি হতো। তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন বিরোধী দলের ভূমিকা এবং সংসদীয় গণতন্ত্রে শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তার কথাও। ভারতের মতন একটি দেশে প্রধান বিচারপতির এই আলোচনার ভিতর থেকে বর্তমান ভারতের গণতান্ত্রিক অবস্থার দুর্বলতা উঠে এসেছে।
উপমহাদেশের একটি দেশ হিসেবে আমাদের অবস্থানটি কোথায় তা ভারতের বিচারপতির এই আলোচনার সাথে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। আমাদের দেশের সামগ্রিক অবস্থা এর চেয়ে ভালো কিছু নয়। আমাদের সংসদে আইন প্রণয়নের জন্য সবচেয়ে কম সময় ব্যয় হয়। প্রায়শই বিভিন্ন আইন সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে আমাদের সামনে আসে যা পুনঃবিবেচনার সুযোগ থেকে যায়।
ভারতের প্রধান বিচারপতির পক্ষে এই প্রশ্নগুলো তোলা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র একটি যোগ্যতার কারণে, তা হচ্ছে তিনি প্রধান বিচারপতি হয়েছেন জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে- নির্বাহী বিভাগের উদারতায় নয় কিংবা নির্বাহী বিভাগের পছন্দের মানুষ হিসেবে নয়। তিনি আইনের বিভিন্ন দুর্বলতার দিক তুলে ধরে ভারতের মামলার সংখ্যাও উল্লেখ করে বলেছেন যে এই মামলাগুলোর বিচার সম্পন্ন হতে পারছে না এই সমস্ত দুর্বলতার কারণেই। তিনি রাষ্ট্রকে একটি পুলিশী রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলেও মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, যেকোন সাধারণ অভিযোগেই মানুষকে গ্রেপ্তার করা, কারাগারে প্রেরণ করা এবং দীর্ঘকাল কারাগারে রাখা ভারতীয় বিচার বিভাগের একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে ।
তিনি আরো বলেন বর্তমানে যেসব আসামি কারাগারে রয়েছে তার আশি শতাংশই বিচারাধীন। বর্তমান ভারতের অবস্থা যদি এই হয়, এর সঙ্গে আমাদের কতটুকু পার্থক্য খুঁজে পাবো? যদিও ভারতের প্রধান বিচারপতির নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের কোন পছন্দের বিষয় ঘটেনি।
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতার পরে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল জহরলাল নেহেরুর আমলের ঘটনা। ১৯৫৬ সালে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতির মৃত্যুর পরে যে নতুন বিচারপতি নিয়োগের উদ্যোগ জহরলাল নেহেরু নিয়েছিলেন তা ছিল বোম্বে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি হিসেবে বসাতে চাওয়া।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের ছয়জন বিচারপতি একযোগে পদত্যাগের ঘোষণা দিলে তিনি তার মত পাল্টে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতেই নিয়োগ প্রদান করেন। এরপরে আরো তিনবার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের উদাহরণ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে আছে। একজনকে ১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মতো জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে দ্বিতীয়জনকে প্রধান বিচারপতি বানানো হয়েছিল। এরপরে আরো দুইবার ইন্দিরা গান্ধীর সময় জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ইতিহাস পাওয়া যায়।
১৯৭৩ ও ১৯৭৭ সনের পরে ভারতে আর কখনো জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হয় হয়নি। সেক্ষেত্রে আমরা অনেকখানি পিছিয়ে আছি। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই এ পর্যন্ত সাতবার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হয়েছে। ২০০১ সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই সরকার দুইবার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে। এর পরে সামরিক শাসনের সময়কালেও (২০০৭) তা লঙ্ঘন করা হয়। বর্তমান সরকারের আমলে মোট চারবার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হয়েছে। ২০১০ প্রথম যে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছিল তিনি দুজনকে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তৃতীয় জৈষ্ঠ্য।
তার সময়কালে বাংলাদেশের সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত বিধানটিকে অসংবিধানিক ঘোষণা করা হয়। তবে চাইলে পরবর্তী আরও দুটি নির্বাচন এই বিধানের আওতায় করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা ছিল সেই রায়ে। এই রায়ের ফলে বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। যা আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বিভাজনের চূড়ান্ত মাত্রা তৈরি করে।
আমাদের প্রধান বিচারপতির পদ জ্যেষ্ঠতা দ্বারা নির্ধারিত নয়। এক্ষেত্রে আমাদের সংবিধানে কোন সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান নাই। তবে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ভিত্তিতেই এই নিয়োগ দিয়ে থাকেন।