আফ্রিকান তেল-গ্যাস থেকে ইউরোপের পুরো ইউ-টার্ন
রাশিয়ার গ্যাজপ্রমের ওপর তীব্রভাবে নির্ভরশীল ইউরোপ। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়ান তেল ও গ্যাসের ওপর নিজেদের নির্ভরতা কমানোর জন্য বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করেছে এ মহাদেশটি।
ইউরোপের জন্য প্রয়োজনীয় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) কিছু অংশ এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ইউরোপের চাহিদা মেটানোর জন্য আফ্রিকা একটি সম্ভাবনাময় বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় আফ্রিকার দেশগুলো।
সম্প্রতি নাইজার ডেল্টার একজন স্থানীয় উন্নয়নকর্মী ব্লুমবার্গকে বলেছেন, 'বনি ও ইউরোপে আমাদের গ্যাস যায়, কিন্তু এতে আমরা কোনোভাবে লাভবান হইনা। আমাদের কাছে কিছুই আসে না।'
ইউরোপের গ্যাসের এমন চাহিদার সময়ে মিলিয়ন-মিলিয়ন টন এলএনজি বিদেশে রপ্তানি করছে নাইজেরিয়া। অথচ দেশটির স্থানীয় মানুষজন তাদের ঘর উষ্ণ রাখার জন্য অবৈধভাবে উৎপাদন করা জ্বালানি ব্যবহার করছে। আফ্রিকার অনেক দেশের বর্তমান অবস্থা নাইজেরিয়ার মতো।
মোজাম্বিক বিশ্বের এলএনজি সরবরাহকারীদের মধ্যে অন্যতম একটি দেশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় নেতাদের কাছে এ দেশটির গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। কিন্তু মোজাম্বিকের নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। দেশটিতে প্রায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর উগ্রবাদী হামলা হয়। এসবের কারণে দেশটির গ্যাস রিজার্ভের উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়েছে।
তবে এত কিছু ছাড়িয়ে যে সমস্যটা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠছে, তা হলো আফ্রিকান জৈবজ্বালানি নিয়ে ইউরোপের দ্বিমুখী নীতি।
বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমানোর যুক্তিতে আফ্রিকার দেশগুলোকে তাদের গ্যাস ফিল্ডের উন্নয়ন ও পাইপলাইন তৈরি করার জন্য পশ্চিমা ব্যাংক ও সরকারগুলো তহবিল প্রদানে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে। এর ফলে বারবার হোঁচট খেয়েছে এসব দেশের জৈবজ্বালানির উন্নয়ন কার্যক্রম।
কিন্তু এখন হঠাৎ করে পরিস্থিতি মোড় নিয়েছে। এইতো গেল বছরের নভেম্বরে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন কপ২৬-এ জি-৭ দেশগুলো বিদেশে তেল ও গ্যাসের ওপর বিনিয়োগ প্রত্যাহারের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু এখন আবার এ দেশগুলোই বাইরের বিভিন্ন দেশে জৈবজ্বালানিতে বিনিয়োগের জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছে।
ইউরোপ এতদিন আফ্রিকার দেশগুলোকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে জোর দেওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছিল। সে ইউরোপই এখন আফ্রিকার গ্যাস চেয়ে বেড়াচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সিও (আইইএ) এখন এ আলাপে জড়িয়ে পড়েছে। গত মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আইইএ জানিয়েছে, আফ্রিকান গ্যাস উৎপাদকদের নিজেদের সম্পদ বাণিজ্যিকীকরণের জন্য পর্যাপ্ত সময় নেই। এ দেশগুলোকে বিষয়টি নিয়ে আরও দ্রুত এগোতে হবে, কারণ সীমিত কার্বন পরিস্থিতিতে যাওয়ার আগ পর্যন্তই কেবল বিশ্বের জৈবজ্বালানির প্রয়োজন হবে।
তবে আফ্রিকান গ্যাস সম্পদের বৃহৎপর্যায়ের উন্নয়নের সঙ্গে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্যসমূহের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল না বলেই জানিয়েছেন আইইএ-এর মহাসচিব ফাতিহ বিরোল। গত জুনে রয়টার্সকে তিনি বলেছিলেন, 'আমাদের জলবায়ু বিষয়ক লক্ষ্যমাত্রাগুলোর যদি শীর্ষ ৫০০-এর একটি তালিকা তৈরি করি, সে তালিকায় আফ্রিকা তার গ্যাস নিয়ে কী করে তা আসবে না।'
তিনি আরও বলেন, আফ্রিকার গ্যাস রিজার্ভ থাকা দেশগুলো যদি নিজেদের সব রিজার্ভ উত্তোলন করে ফেলে, তার পরিমাণ ২০৩০ সাল নাগাদ বার্ষিক ৯০ বিলিয়ন ঘনমিটারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এ পরিমাণ গ্যাসের তিন ভাগের দুই ভাগ নিজেরা ব্যবহার করে বাকি অংশ রপ্তানি করতে পারে এ দেশগুলো।
অর্থাৎ সে হিসাবে বার্ষিক ৩০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস রপ্তানি করতে পারবে আফ্রিকা। আর এ পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের ইউরোপে বার্ষিক সমন্বিত সরবরাহের সমান। প্রসঙ্গত, গত বছর ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানি ১৫৮ বিলিয়ন ঘনমিটারে পৌঁছেছিল।
তবে এমনটা করতে হলে জ্বালানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ও অন্যান্য তহবিল প্রদানকারী গোষ্ঠীকে তাদের কার্বন নিঃসরণের প্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হটতে হবে। হয়তো 'এ পদক্ষেপ অল্প কয়দিনের জন্য' এ অজুহাতে তেমনটাই করবে তারা। নিজেদের কয়লা কারখানাগুলো পুনরায় চালু করার সময় এমনটাই বলেছিল জার্মান সরকার।
কিন্তু গ্যাস উৎপাদনের দীর্ঘকালীন টেকসইতা নিয়ে খোদ আফ্রিকাতেই পরিবেশগত উদ্বেগ রয়েছে।
'বিশ্ব যখন জৈবজ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্থানান্তরিত হচ্ছে, তখন এ সুবিধা ঠিক কতদিন বজায় থাকবে, সেটা আগে থেকে ধারণা করা কঠিন,' সম্প্রতি এনপিআরকে বলেছেন নিউইয়র্কভিত্তিক পরিবেশবিষয়ক এনজিও ন্যাচারাল রিসোর্সেস গভর্নেন্স ইনস্টিটিউটের আফ্রিকা সহপরিচালক সাইলাস ওলাং। তিনি বলেন, 'তারা বেশিরভাগ দেশকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে।'
বর্তমান পরিস্থিতি বেশ জটিল। একদিকে আফ্রিকার তেল ও গ্যাসমালিক কিছু দেশের নেতারা ভাবছেন, চলমান পরিস্থিতিতে নিজেদের রিজার্ভ ব্যবহার করে তাদের অর্থনৈতিক সুবিধা নেওয়া উচিত। পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনীতি উন্নত হওয়ার পেছনে তাদের জ্বালানি রিজার্ভের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
কেবল এক বছর আগেও এ বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান পোষণ করতো পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু এখন আফ্রিকান নেতাদের এমন ইচ্ছাকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানানো পশ্চিমাদের স্বার্থের জন্যই প্রয়োজন।
কিন্তু অন্যদিকে আফ্রিকারও পরিবেশ নিয়ে চিন্তা আছে, সেখানেও পরিবেশবাদীরা রয়েছেন। তারা উদ্বেগ পোষণ করছেন, আফ্রিকার গ্যাসসমৃদ্ধ দেশগুলো 'স্ট্র্যান্ডেড অ্যাসেটের' ফাঁদে পা দিচ্ছে। অর্থনীতিকে কার্বনমুক্ত করার উদ্যোগের কারণে যেসব জৈবজ্বালানি থেকে আর কোনো আর্থিক উপযোগ পাওয়া সম্ভব হয় না সেগুলোকে 'স্ট্র্যান্ডেড অ্যাসেট' বলা হয়।
অবশ্যই ইউরোপ ও আমেরিকা আফ্রিকান তেল-গ্যাস নিয়ে এ মুহূর্তে যে ইউ-টার্ন গ্রহণ করেছে, তা 'স্ট্র্যান্ডেড অ্যাসেট' বিতর্কের বিপরীতেই অবস্থান করছে। একইসঙ্গে এটাও বোঝা যাচ্ছে, আফ্রিকার গ্যাসসমৃদ্ধ দেশগুলোর তাদের সম্পদ থেকে আর্থিক উপযোগ পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও রয়েছে। তবে সেটা কেবল তখনই ঘটবে, যদি এ ইউ-টার্ন নেওয়া দেশগুলো এসব সম্পদের জন্য অর্থ পরিশোধ করতে ইচ্ছুক হয়।
অয়েল প্রাইস ডটকম থেকে অনূদিত।