‘রিয়াদ ভাই যেখানে রেখেছেন, সেখান থেকে শুরু করতে চাই’
জাতীয় দলে অভিষেক ২০১৬ সালে। সময়টা বেশ আগে হলেও জাতীয় দলে খুব বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি নুরুল হাসান সোহানের। উইকেটরক্ষক এই ব্যাটসম্যান বাংলাদেশের হয়ে ৭ টেস্ট, ৬ ওয়ানডে ও ৩৩টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। ৩৩ টি-টোয়েন্টির ২২টিই শেষ এক বছরে খেলেছেন তিনি। ওয়ানডেতেও তাই, শেষ এক বছরে খেলেছেন ৪ ওয়ানডে। এর আগের সময়টায় কেবল দলে আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকতে হয় সোহানকে। সময়ের ভেলায় তার কাঁধেই এখন টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের বদলে জিম্বাবুয়ে সফরে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক করা হয়েছে সোহানকে।
দলেই যার জায়গা নিশ্চিত নয়, তার হাতে নেতৃত্ব উঠলো কীভাবে? গল্পটার শুরু সর্বশেষ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট দিয়ে। শেখ জামালকে চ্যাম্পিয়ন করানোর পথে সুপার লিগে ব্যাট হাতে 'সুপারম্যান' হয়ে ওঠেন সোহান। লিগে ৮ ম্যাচে একটি সেঞ্চুরি ও ৪টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৯৬.৬০ গড়ে ৪৮৩ রান করেন তিনি। এই পারফরম্যান্সে ডাক পান ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সব ফরম্যাটেই। সফরে টেস্ট সিরিজে ২টি হাফ সেঞ্চুরির পাশাপাশি ওয়ানডেকে কার্যকর ও অপরাজিত ২টি ইনিংস খেলেন এই ব্যাটসম্যান। এই পারফরম্যান্স, ঘরোয়া লিগে নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা ও মাহমুদউল্লাহর বাজে ফর্ম; সব মিলিয়ে নেতৃত্ব পরিবর্তনে সোহানকে বেছে নিয়েছে বিসিবি।
জাতীয় দলের মতো জায়গায় নেতার আসন পেয়ে স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত সোহান। তবে এটাকে শুধু ক্যারিয়ারের অন্যান্য দায়িত্বের মতো করেই দেখছেন তিনি। জিম্বাবুয়েতে তিন ম্যাচের সিরিজে বেশি সময় পাবেন না জেনেও দলকে সুখী পরিবারে রূপ দেওয়ার ইচ্ছার কথা জানালেন ২৮ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। মাহমুদউল্লাহ যেখানে দলটা রেখেছেন, সেখান থেকেই শুরু করতে চান তিনি। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় অধিনায়কত্বের প্রথম মিশনে নিজের লক্ষ্য, দল নিয়ে পরিকল্পনা, তরুণ দল সামলানোর চ্যালেঞ্জসহ আরও অনেক বিষয় নিয়েই কথা বলেছেন সোহান।
টিবিএস: অধিনায়কত্ব পেয়ে কেমন লাগছে?
নুরুল হাসান সোহান: ভালো লাগছে। জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করাটাই গর্বের ব্যাপার। আর অবশ্যই এটা একটা অন্যরকম অনুভূতি। আমার কাছে মনে হয় এটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ, এটা যেন ভালোভাবে পালন করতে পারি।
টিবিএস: অধিনায়কত্ব পেয়ে বিস্মিত হয়েছেন? নাকি আগেই আভাস পেয়েছিলেন?
সোহান: না, জীবনে এখন কোনো কিছু নিয়েই বিস্মিত হওয়ার সুযোগ নেই। ভালো, খারাপ যেটাই হোক, জীবনের কাছে আমার তেমন প্রত্যাশা নেই। আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা এবং নিজের কাজটা ঠিকমতো করা। আমি এসব নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করি না। কারণ দল যখন আমার কাছে যেটা চাইবে, আমি সব সময়ই সেটা করতে প্রস্তুত। অধিনায়কত্ব পেয়ে বড় কিছু অর্জন করে ফেলেছি, এমন নয়। একটা দায়িত্ব পেয়েছি, সেটা যেন ঠিকমতো পালন করতে পারি।
টিবিএস: অধিনায়ক হয়েই প্রথম কোন কাজটি করতে চান দলের জন্য?
সোহান: রিয়াদ ভাই দলটাকে একটা জায়গায় রেখে গেছেন। উনি একটা প্রক্রিয়ায় থেকে সবাইকে নিয়ে দল গড়েছেন, তো আমার নতুন করে গড়ার কিছু নেই। আমার প্রধান লক্ষ্য থাকবে দল হিসেবে খেলা। আমি যখন ঘরোয়াতে অধিনায়কত্ব করি, আমার ফোকাসই থাকে দল হিসেবে খেলা, পুরো দলকে একটা পরিবারে তৈরি করা। অবশ্যই সবাই দলের জন্যই খেলে, সবার একটা ভূমিকা থাকে। তবে আমি যখন অধিনায়ক হিসেবে খেলি, দল গড়া ও দল হিসেবে খেলার চেষ্টা করি। জিম্বাবুয়েতে টানা তিন ম্যাচ, কম সময়। আমার লক্ষ্যই থাকবে আমরা যেন দল হিসেবে খেলতে পারি।
টিবিএস: অধিনায়কত্ব পাওয়ার পথটা কীভাবে তৈরি হলো? বিসিবি থেকে আগেই যোগাযোগ করা হয়েছিল? কিংবা আপনার কোনো মতামত নেওয়া হয়েছে কিনা?
সোহান: আমি কিছুই জানি না এটা নিয়ে। অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর আপনারা সাংবাদিকরা কয়েকজন ফোন করেছেন। বিসিবি থেকে যোগাযোগ করে অধিনায়ক হওয়ার ব্যাপারটি জানিয়েছে আজ (শুক্রবার)। এর বাইরে আমি তেমন কিছু জানি না। জানার কোনো আগ্রহও আমার ছিল না। এটা নিয়ে বাড়তি কোনো আগ্রহ এখনও নেই। দলের মধ্যে এটা নিয়ে আমাদের কোনো আলোচনা ছিল না। আমরা খেলা নিয়েই কথা বলেছি, এসব ছিল না। আবারও বলছি, একটা দায়িত্ব পেয়েছি; নিজের শতভাগ দিয়ে যেন সেটা পালন করতে পারি।
টিবিএস: প্রথমবার সুযোগ পেলেন জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার, এখনই যদি বলা হয় নিজেকে স্থায়ী অধিনায়ক হিসেবে যোগ্য মনে করেন কিনা, কী বলবেন?
সোহান: না, আমার কোনো প্রত্যাশা নেই এবং খুব বেশি দূরে চিন্তা করছি না। তিনটা ম্যাচের জন্য আমার কাছে দায়িত্ব এসেছে। আর অধিনায়ক থাকা না থাকা, আমার কাছে খুব বেশি ম্যাটার করে না। আমি সব সময় চাই দলের হয়ে খেলার জন্য। দলের জন্য যেটা ভালো হবে, সেটাই করতে চাই। এর বাইরে কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। যেটা আগেও বলেছি, জীবনের কাছে এখন আমার প্রত্যাশা খুব কম। কম বলতে এমন কোনো চাওয়া নেই। খেলোয়াড় হিসেবে শতভাগ দিতে পারলে সেটা হবে আমার প্রত্যাশা পূরণ।
টিবিএস: তিন ম্যাচের সিরিজ, মাঝে তেমন সময় নেই। এরপরও অধিনায়ক হিসেবে নিশ্চয়ই পরিকল্পনা থাকবে আপনার। এই অল্প সময়ে পরিকল্পনা করে দলে কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব?
সোহান: এনসিএল, বিসিএল, প্রিমিয়ার লিগ বা বিপিএলে অধিনায়কত্ব করেছি আমি। আমার কাছে সব সময়ই যেটা গুরুত্বপূর্ণ থাকে, তা হলো দল হয়ে খেলা। স্কিল উন্নত করার সুযোগ খুব বেশি থাকে না এখানে। আর আমার কাছে মনে হয় আমরা সবাই স্কিলড (দক্ষ)। দক্ষ হয়েই এখানে আসে। মানসিক স্বাস্থ্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ্য থাকবে, দলের যেন টিম বন্ডিং থাকে, যেটা আছে ইতোমধ্যে। এর মধ্যে থেকেই সেরাটা খেলতে চাই আমরা। ঘরোয়ার চেয়ে এখানে আরও বেশি পেশাদার সবাই। সবাই সবার ভূমিকা জানলে আর দল হিসেবে খেললে ভালো কিছু হবে।
টিবিএস: তিন ম্যাচে এমন কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব, যেটা দিয়ে মাহমুদউল্লাহর থেকে আপনাকে অধিনায়ক হিসেবে আলাদা করা যাবে?
সোহান: আমার প্রথম শ্রেণি শুরু হয়েছে যখন, তখন রিয়াদ ভাই অধিনায়ক ছিলেন। উনি অনেক অভিজ্ঞ। তিন ম্যাচে অনেক কিছু করে ফেলা সম্ভব, এমন নয় ব্যাপারটা। রিয়াদ ভাই একটা জায়গায় রেখেছেন দলটা, ওখান থেকে আমি শুরু করতে চাই।
টিবিএস: দলকে ঠিক পথে রাখতে অধিনায়কের মূল কাজ কী?
সোহান: প্রধান কাজ দল হিসেবে খেলা, দল হিসেবে গড়ে তোলা। আমার কাছে মনে হয় এটা খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার, দল হিসেবে খেলতে পারার পরিবেশ তৈরি করাটাই অধিনায়কের প্রধান কাজ। ম্যান ম্যানেজমেন্ট, দল গড়া; এসব তো অধিনায়কত্বের বেসিক অংশই। তবে দল হিসেবে খেলার মানসিকতা তৈরি করাটাই প্রধান কাজ।
টিবিএস: ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের আগেও দলে আপনার জায়গা পোক্ত ছিল না। দলে যখন জায়গা যখন নিশ্চিত নয়, তখন কি অধিনায়কত্ব বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়ায়?
সোহান: সত্যি বলতে এভাবে ভাবি না। আগেও কয়েকবার বলেছি জীবনের কাছে তেমন প্রত্যাশা নেই। প্রত্যাশা হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম যেন করতে পারি, প্রক্রিয়া যেন মেনে চলতে পারি। ২০১৮ সালে যখন জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ি, তখন খুবই খারাপ লেগেছিল। কিন্তু এখন আমার কাছে এই ব্যাপারটা খুবই সহজ এবং সাধারণ যে, যেদিন আমার যে কাজটা থাকবে; শতভাগ দিয়ে সেটা করার চেষ্টা করব। আমি যেন নিজেকে নিজে প্রশ্ন না করতে পারি, আমার কোনো ঘাটতি আছে বা আমি কঠোর পরিশ্রম করিনি। আমি আমার পরিশ্রম ও সততা দিয়ে কাজটা করার চেষ্টা করি। বড় করে দেখলে অধিনায়ত্ব চাপ মনে হতো। আমি সেভাবে দেখছি না। আমি নিজে পারফর্ম করব এবং দল গড়ার চেষ্টা করব। দলের সবার সঙ্গে আমার অনেক ভালো সম্পর্ক। আমি সবার সঙ্গে মিশতে পারি। বড় কিছু পেয়েছি, এভাবে ভাবছি না। আমি এভাবে মাথায় নিতে চাই না।
টিবিএস: পুরো নতুন এবং তরুণ একটি দল, এই দল নিয়ে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩-০ সম্ভব? কতোটা আশাবাদী?
সোহান: স্বাভাবিক ভাষায় বললে অবশ্যই লক্ষ্য থাকবে ভালো কিছু করার। সবারই প্রত্যাশা থাকে ভালো করার। এর আগে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সবকিছুর সমন্বয় দরকার। সেটা যতো দ্রুত তৈরি করে মাঠে নামতে পারব, ততোই ভালো হবে।
টিবিএস: অধিনায়ক হিসেবে মাহমুদউল্লাহর কোন ব্যাপারটা নিজের মধ্যে রাখতে চাইবেন?
সোহান: রিয়াদ ভাই, সাকিব ভাই, মুশফিক ভাই, তামিম ভাই বা মাশরাফি ভাই; যার কথাই বলেন না কেন, সবাই মিলে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে একটা জায়গায় নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি তাদের নিবেদনের ব্যাপারটি আপনি কয়েক শব্দে বলতে পারবেন না। এখানে বিশেষ করে কোনো কথা বলার নেই। সবাই তাদের শতভাগ দিয়ে গেছেন। কারও সাথে কারও তুলনা চলে না। একেক জনের ধরন একেক রকম, জীবন দর্শন একেক রকম। আমি এক রকম, তো সবাইকে যেভাবে দেখেছি; একটা সমন্বয় তৈরি করে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করব।
টিবিএস: তরুণ ক্রিকেটার বেশি থাকলে সেই দল সামলানো তুলনামূলক কঠিন। এটা চ্যালেঞ্জ মনে হচ্ছে কিনা?
সোহান: না, এটা চ্যালেঞ্জ মনে হচ্ছে না। প্রতিটা ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ থাকে, এটাকে আলাদাভাবে দেখছি না। কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা ক্রিকেটার আছে আমাদের দলে। তো আমি ওভাবে দেখছি না। এ ছাড়া চ্যালেঞ্জ আমি উপভোগ করি, বাকিটা দেখা যাক।