তাইওয়ানে পেলোসি, কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে চীন?
তাইওয়ানে পৌঁছেছেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস)-এর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। তাইপেতে তার এই সফর বেইজিং এর সাথে আমেরিকার উত্তেজনার পারদকে বিপজ্জনক সীমায় নিয়ে যাবে।
তাইওয়ানে নামার পরপরই একাধিক টুইট করেছেন পেলোসি। টুইটে তিনি লিখেন, তিনি ও তার প্রতিনিধিদলের তাইওয়ান ভ্রমণ তাইওয়ানের চমৎকার গণতন্ত্রের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় সমর্থনকে সম্মান জানায়।
তাইওয়ানের স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৪৪ মিনিটে পেলোসিসহ তার সঙ্গে আসা কংগ্রেসের প্রতিনিধি দলটি তাইপের সোংসান বিমানবন্দরে মার্কিন বিমানবাহিনীর একটি বোয়িং সি-৪০সি বিমানে করে পৌঁছায়। এই ফ্লাইটের নামকরণ করা হয়েছে স্পার-১৯। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে তাইওয়ান নিউজ।
এর আগে মঙ্গলবার (২ আগস্ট) মালয়েশিয়া ত্যাগ করেন পেলোসি। তখন ধারণা করা হয়েছিল তিনি তাইওয়ানের পথে রওনা দিয়েছেন।
পেলোসি'র তাইওয়ান ভ্রমণের সম্ভাবনা নিয়ে ইতোমধ্যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। চীন স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপ তাইওয়ানকে নিজেদের অঞ্চল বলে দাবি করে।
মঙ্গলবার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়েছেন পেলোসি। সংক্ষিপ্ত ওই যাত্রাবিরতির পর তার বিমান মালয়েশিয়া থেকে ছেড়ে যায়।
তাইওয়ানে অবতরণের আগ পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছিল না পেলোসি আদৌ সেখানে যাচ্ছেন কিনা। তবে তাইওয়ানের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল, মঙ্গলবার রাতেই তাইওয়ানে অবতরণ করবেন তিনি।
বিতর্কের তুঙ্গে থাকা বিষয়টি নিয়ে তাইওয়ানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্ট করে কোনো মন্তব্য করেনি। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী সু সেং-চ্যাং খোলাখুলি কিছু না বললেও জানিয়েছেন, 'যেকোনো বিদেশি অতিথি ও বন্ধুসুলভ আইনপ্রণেতা'কে 'খুব ভালোভাবে স্বাগতম' জানাবে তাইওয়ান।
এদিকে চীন জানিয়েছে ন্যান্সি পেলোসি যদি তাইওয়ান ভ্রমণ করেন, তাহলে চীনের সেনাবাহিনী তা কখনো 'বসে বসে দেখবে না'।
সোমবার হোয়াইট হাউজ থেকে জানানো হয়েছিল, চীনের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ানোর কোনো উদ্দেশ্য নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কার্বি বলেছেন, তাইওয়ান সফরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেলোসি'র একার। তিনি আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন, অতীতে কংগ্রেস সদস্যরা নিয়মিত তাইওয়ান ভ্রমণ করেছে।
কার্বি বলেন, মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করছেন এ ভ্রমণকে অজুহাত বানিয়ে চীন তাইওয়ানের ওপর শক্তি প্রদর্শন করতে পারে। দেশটি প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে তাইওয়ানের আশেপাশে মিসাইল পরীক্ষা করা, দ্বীপটির আকাশসীমা লঙ্ঘন করা, তাইওয়ান প্রণালীতে বড় ধরনের নৌ-মহড়া দেওয়া ইত্যাদি কাজ করতে পারে।
যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে চীন
রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণের পর ওয়াশিংটন চীনের তাইওয়ান বিষয়ক পরিকল্পনার দিকে বাড়তি মনোযোগ দিয়েছে। ইউরোপের এ যুদ্ধের ডামাডোলে চীন তাইওয়ান দখল করে নিতে পারে- এরকম সম্ভাবনার কথাও শোনা গেছে কয়েকবার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত একাধিকবার পুনর্ব্যক্ত করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পেলোসি'র তাইওয়ান ভ্রমণ বাস্তবায়ন হলে চীনের জবাব কী হতে পারে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদেরও স্পষ্ট ধারণা নেই।
এমআইটি'র সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক টেইলর ফ্রাভেলও মার্কিন কর্মকর্তাদের মতোই ভাবছেন। তিনি মনে করেন, চীনের জবাবে অবশ্যই সামরিক শক্তি যুক্ত থাকবে।
'এসবের লক্ষ্য হচ্ছে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে না গিয়ে সমাধানের দিকে পৌঁছানো। তবে যেহেতু চীন সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করবে, সেক্ষেত্রে হিসাবে ভুলচুক হওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে,' বলেন ফ্রাভেল।
'নিয়মিত' নিয়োজনের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে তাইওয়ানের পূর্বাঞ্চলে সাগরে চারটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি বিমানবাহী রণতরীও রয়েছে।
তাইওয়ানের ন্যাশনাল সান ইয়াত-সেন ইউনিভার্সিটি'র রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কুয়ো ইয়ুজেন বলেন, 'আমার মনে হয় না এখন পর্যন্ত চীন বড় ধরনের সামরিক অপারেশনে কোনো ইঙ্গিত দিয়েছে। চীন যদি বাড়াবাড়ি পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বা জাপান থেকে তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া আসবে। আর তার ফলে চীনের যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, সেটা তাদের এ সংঘাত থেকে পাওয়া অর্জনকে ছাড়িয়ে যাবে।'
এ বছরের শেষের দিকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বড় ধরনের কংগ্রেস রয়েছে। অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও করোনাভাইরাস লকডাউন- এসব সমস্যাও মোকাবিলা করতে হচ্ছে চীনকে। তাই শি জিনপিং ও তার মিত্ররা এ সময় আর নতুন করে বিবাদে জড়াতে চাইবেন না বলেও মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
এদিকে পেলোসির তাইওয়ান ভ্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্জন কতটুকু, তাও অস্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের এ সিনিয়র রাজনীতিবিদের আগমনে হয়তো স্বায়ত্তশাসিত এ অঞ্চলটির গণতন্ত্রের প্রতি দেশটির সমর্থন পুনরায় ব্যক্ত হবে, তাইওয়ান হয়তো নিজেদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা লাভের ব্যাপারেও নতুন করে আশা পাবে। তবে এ অঞ্চলের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সচরাচর কোনো সরাসরি মন্তব্য করে না।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির তাইওয়ান স্টাডিজ প্রোগ্রামের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওয়েন-তি সুং বলেন, 'মার্কিন আইনপ্রণয়ন ব্যবস্থার প্রধান হিসেবে পেলোসি হয়তো একধরনের প্রতীকী সমর্থন দিয়ে তাইওয়ানের প্রতি মার্কিন সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রেও যথেষ্ট অস্বীকৃতির সম্ভাবনা ধরে রাখা সম্ভব, যার মাধ্যমে বেইজিংয়ের রেড লাইন অতিক্রম করা হবে না। কারণ পেলোসির সিদ্ধান্ত মার্কিন পলিসির প্রতিনিধিত্ব করে না।'
পিটার বাইনার্ট নামক একজন বামধারার সমালোচক লিখেছেন, পেলোসি যদি তাইওয়ান যাওয়া প্রসঙ্গ প্রথমদিকে না তুলতেন, তাহলে এরপর আর কেউ চাইতো না তিনি তাইওয়ান গিয়ে এশিয়ায় মার্কিন বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও দৃঢ় করুন।'
গত সপ্তাহে শি জিনপিং-এর সঙ্গে এক টেলিফোন আলাপে বাইডেন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক ও তাইওয়ান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কিন্তু বাইডেন সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে বারবার তাইওয়ানকে রক্ষা করার বিবৃতি দিয়েছেন, বেইজিং হয়তো তাতে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কে বিষয়ে বাইডেন মুখে বললেও বাস্তবে ততটা আন্তরিক নন।
তাইওয়ানের সন্নিকটে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন যুক্তরাষ্ট্রের
মঙ্গলবার তাইওয়ানের পূর্বাঞ্চলের সমুদ্রে চারটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। 'নিয়মিত' মোতায়েনের অংশ হিসেবে এগুলো সেখানো পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ। এসব জাহাজের মধ্যে একটি বিমানবাহী রণতরীও (এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার) আছে।
রয়টার্সকে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ক্যারিয়ার ইউএসএস রোনাল্ড রিগ্যান দক্ষিণ চীন সাগর থেকে ফিলিপাইন সাগরে এসে পৌঁছেছে।
রিগ্যানের সঙ্গী হিসেবে আছে গাইডেড মিসাইল বহনকারী ক্রুজার ইউএসএস অ্যান্টিট্যাম ও ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস হিগিনস। অন্য জাহাজটি হলো অ্যাম্ফিবিয়াস অ্যাসল্ট শিপ ইউএসএস ট্রিপলি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌবাহিনীর ওই কর্মকর্তা জানান, যেকোনো পরিস্থিতিতে প্রত্যুত্তর দেওয়ার সক্ষমতা থাকলেও এ যুদ্ধজাহাজগুলোকে নিয়মিত মোতায়েনের অংশ হিসেবে ওই অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে। তবে জাহাজগুলোর নির্দিষ্ট স্থান নিয়ে কোনো তথ্য জানাননি তিনি।
৩৫ তাইওয়ানিজ কোম্পানি থেকে আমদানি স্থগিত করলো চীন
বিস্কুট ও প্যাস্ট্রির ৩৫টি তাইওয়ানিজ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান থেকে আমদানি স্থগিত করেছে চীন। সোমবার থেকে এ স্থগিতাদেশ কার্যকর হওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
এ ঘটনাকে পেলোসির ভ্রমণপূর্বক চীনের সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সূত্র: এপি নিউজ, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, এনডিটিভি