স্যামসাং ‘যুবরাজ’কে ক্ষমা করলো দ. কোরিয়া, কেন দেশটিতে স্যামসাংয়ের এত ক্ষমতা?
প্রযুক্তি জায়ান্ট স্যামসাং ইলেকট্রনিকস-এর ভাইস চেয়ারম্যান ও উত্তরাধিকারী জে ওয়াই লি ওরফে লি জে ইয়ংকে ক্ষমা করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক-ইয়োল।
শুক্রবার (১২ আগস্ট) এ ক্ষমা ঘোষণা করেন তিনি। দেশটির বিচার মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, করোনাপরবর্তী 'দেশের অর্থনৈতিক সংকট' মোকাবিলায় ওয়াই লি'র সহায়তার প্রয়োজন বলেই তাকে এ বিশেষ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে।
যদিও এ ক্ষমা ঘোষণা মোটা দাগে প্রতীকী। কারণ ২০১৭ সালে ঘুষ ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে লি ১৮ মাস জেল খাটার পর অনেক আগেই প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলেন।
তবে বর্তমান ক্ষমার অর্থ হলো লি এখন আগের চেয়ে আরও স্বাধীনভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করতে পারবেন। স্যামসাংয়ের ব্যবসায় নতুন মোড় আনার জন্য তার পথ সুগম হলো।
লি'র অপরাধ
২০১৭ সালে দোষী সাব্যস্ত হন লি। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হাইকে ঘুষ দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন পার্ক। এর জন্য দুবার জেলে জেতে হয় লিকে।
তার ঘুষের অপরাধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা তার নাম দিয়েছিলেন 'ক্রাউন প্রিন্স অভ স্যামসাং'। স্যামসাং-এ তার নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর জন্য একটি একীভূতকরণ (মার্জ) প্রক্রিয়ার দরকার ছিল। কিন্তু কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারেরা সে প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন।
তখন একীভূতকরণের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য প্রেসিডেন্ট পার্ক ও তার সহযোগীকে ৮০ লাখ ডলার ঘুষ দেন লি। এ দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে এলে কয়েক লাখ দক্ষিণ কোরিয়ান প্রতিবাদ শুরু করেন।
বিক্ষোভকারীরা ২০১৬/২০১৭ সালের শীতকালে প্রতি সপ্তাহান্তে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ জানাতেন। তাদের দাবি ছিল পার্ক সরকারের পদত্যাগ এবং রাজনীতি ও ব্যবসায়র মধ্যকার এ ধরনের সম্পর্কের সমাপ্তি।
অবশেষে ২০১৭ সালে অভিশংসিত হন পার্ক। তাকে ২৫ বছরের জন্য কারাগারে যেতে হয়।
তার এক বছর পর ২০১৮ সালে স্যামসাংয়ের তহবিল তছরুপসহ অন্যান্য অপরাধে কারাভোগের আদেশ হয় লি'র। প্রেসিডেন্ট পার্কের এক বন্ধুর মেয়েকে কোম্পানির তহবিল থেকে আট লাখ ডলার দিয়ে একটি ঘোড়া কিনে দিয়েছিলেন লি।
কেন তাকে ক্ষমা করল সরকার?
পার্কের ক্ষমতাচ্যুতির পরে নতুন প্রেসিডেন্ট হন মুন জে-ইন। তিনি চেয়েছিলেন সব সংকটের শেষ দেখতে। কিন্তু ব্যর্থ হন মুন। পরে নিজে ক্ষমতা ছাড়ার আগে পার্ককে ক্ষমা ঘোষণা করেন তিনি।
পার্ক ক্ষমা পাওয়ার আট মাস পরে নতুন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ক্ষমা পেলেন জে ওয়াই লি। আর দেশটিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা মানুষগুলোর জন্য এ ঘোষণা তীব্র চপেটাঘাত হিসেবেই পরিণত হলো।
এক সংবাদ সম্মেলনে দক্ষিণ কোরিয়ার বিচারমন্ত্রী হান দোং হুন বলেছেন, 'জাতীয় অর্থনৈতিক সংকট দ্রুত মোকাবিলা করার নিমিত্তে, আমরা যারপরনাই বিবেচনার মাধ্যমে প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ ও চাকরি সৃষ্টিকারী অর্থনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য নির্বাচন করেছি।'
দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট একজন ব্যবসায়পন্থী মানুষ। স্যামসাং বসের সঙ্গে প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমা আরও পেয়েছেন লোটে গ্রুপের চেয়ারম্যান শিন দোং বিন। ঘুষ দেওয়ার অপরাধে তাকেও আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ক্ষমা পাওয়ার পর তিনি দেশের সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, বৈশ্বিক এ সংকট কাটাতে তিনি ও তার প্রতিষ্ঠান অবদান রাখবে।
'অক্টোপাসের জাল'
জনপ্রিয় বিশ্বাস, দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যবসায়ী নেতারা আইনের ঊর্ধ্বে। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। লি'র এ ক্ষমা ঘোষণায় তা যেন আবার প্রমাণিত হলো।
দেশটিতে বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতির একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে। এখানকার শীর্ষ ১০ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান দেশটির জিডিপি'র ৮০ শতাংশ। এই প্রতিষ্ঠানগুলো 'চেইবল' নামে পরিচিত। এই ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যগুলো বিভিন্ন পরিবার নিয়ন্ত্রণ করে। এরকম কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হলো এলজি, হুন্দাই, লোটে, এসকে ইত্যাদি।
তবে দেশটিতে সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হলো স্যামসাং। বাইরের দেশে ফোন আর ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি করলেও দক্ষিণ কোরিয়ায় স্যামসাংয়ের হাসপাতাল, হোটেল, ইন্স্যুরেন্স, বিলবোর্ড, শিপইয়ার্ড, থিম পার্ক ইত্যাদির ব্যবসায় রয়েছে।
আর স্যামসাংয়ের মতো দেশটির এ চেইবলগুলো নিজেদের সর্বগ্রাসী ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য 'অক্টোপাস' ফার্ম নামেও পরিচিত। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের ভেতরে প্রচুর প্রভাব খাটাতে পারে প্রতিষ্ঠানগুলো।
কোরিয়ান যুদ্ধের পর এসব কোম্পানিগুলোকে সস্তা বিদ্যুৎ, কর অবকাশের মতো বাড়তি সুবিধা দিয়েছিল সরকার। ফলে বর্তমানে এ মনোপলি পর্যায়ে পৌঁছেছে দক্ষিণ কোরিয়া।
১৯৯০'র দশকে জে ওয়াই লি'র বাবা, স্যামসাংয়ের তৎকালীন চেয়ারম্যান লি কুন-হিও ঘুষ ও জালিয়াতির জন্য অভিযুক্ত হন। কিন্তু তাকে কখনো জেলে যেতে হয়নি।
অপরাধের পরও প্রভূত ক্ষমতা
২০১৭ সালে ওয়াই লি'র পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হলে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ ভেবেছিল এবার বুঝি অবস্থার পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।
কিন্তু আদালতে লি'র মামলা বছরের পর বছর চলতে লাগল। আপিল আদালত তাকে মুক্তি দিলেন, উচ্চ আদালত আবার বিচারের আদেশ দিলেন। সে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে আবার জেলে গেলেন লি।
কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে কারাভোগ শুরুর কয়েকমাস পর প্রেসিডেন্ট মুনের সরকার জাতীয় স্বার্থে তাকে প্যারোলে মুক্তি দেন।
এরপর থেকেই জনসমক্ষে দেখা যেতে শুরু করে লিকে। গত মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন এক বাণিজ্য সফরে দক্ষিণ কোরিয়া সফর করার সময় তার সঙ্গেও দেখা করেন লি।
ইউরোপে ব্যবসায়িক সফরেও গিয়েছিলেন লি। গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসকে ১৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে চিপ কারখানা বানানোর স্থান হিসেবে নির্বাচন করেছে স্যামসাং।
কোম্পানির বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো লি-ই নেন বলে জানা গেছে। ক্ষমা ঘোষণার পর এখন তার ওপর আর কোনো 'নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা' রইলো না। অর্থাৎ পুরোদমে স্যামসাংকে পরিচালনা করতে পারবেন তিনি। এজন্য ধারণা করা হচ্ছে, শীঘ্রই এসব বড় বিনিয়োগ বিষয়ে ঘোষণা দেবে স্যামসাং।
এছাড়া স্যামসাংয়ের শীর্ষ কয়েকজন নির্বাহী এ বছরের শুরুতে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সামনে নতুন প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করবে কোম্পানিটি।
টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়ুঙ্কইয়াং লি বলেন, 'দক্ষিণ কোরিয়ায় একটা বিশ্বাস প্রচলিত- স্যমাসাংয়ের মঙ্গল মানে কোরিয়ার মঙ্গল। কোরিয়ানরা এত দশক ধরে এ মিথের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে যে এখন সাধারণ কোরিয়ান নাগরিকের জন্য এ মিথ ভেঙে বের হওয়া বেশ কষ্টসাধ্য।'
'এ মুহূর্তে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মাঝে মানুষ দক্ষিণ কোরিয়ার সামনে এগিয়ে যাওয়ার চিহ্ন দেখতে চাইছে। আর লি'র মুক্তি তারই একটা চিহ্ন তাদের কাছে,' বলেন এ অধ্যাপক।
সূত্র: বিবিসি, ও রয়টার্স