তবুও পথ দেখায় মানুষ
'আপনারা কেউ ঘর থেকে বের হবেন না। একান্ত প্রয়োজনে বের হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। বারবার সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করুন'-সিলেট নগরীর রিকাবীবাজারে মুখের কাছে হ্যান্ডমাইক নিয়ে এমনটি বলে চলছেন আশরাফুল কবির।
সিলেটের পরিবেশ আন্দোলনের পরিচিতমুখ আশরাফুল কবির গত তিনদিন ধরে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে এমন প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আশরাফুল যখন মাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানাচ্ছিলেন, তখন তার পাশে কয়েকজন তরুণ-তরুণী রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিনামূল্যে মাস্ক আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিলি করে চলছেন। এরা সকলে সিলেটের সংস্কৃতিকর্মী।
নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে তারা শ্রমজীবীদের মধ্যে পরিচ্ছন্নতা উপকরণ বিতরণ করছেন। বস্তিতে ঘুরে ঘুরে বিতরণ করছেন সাবান। সচেতনমূলক লিফলেট-স্টিকারও বিলি করছেন তারা।
শুধু এই ক'জনই নন, সিলেট নগরীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে দেখা যাবে স্বেচ্ছাসেবী তরুণদের। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে, কেউ কেউ আবার কোনো ব্যানার ছাড়াই মানুষের সাহায্যে রাস্তায় নেমে এসেছেন ।
করোনা ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে। তাই মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করার কথা বলা হচ্ছে। তবু অনেকেই মানছে না এমন নির্দেশনা। ছুটি পেয়েই ভিড় করছে বাস-ট্রেনের স্টেশনে। হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বাজারে। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরাও বাড়িয়ে দিয়েছেন নিত্যপণ্যের দাম। সবমিলিয়ে মানুষই হয়ে ওঠেছে মানুষের শত্রু।
এমন সময়েও আশা দেখাচ্ছেন সচেতন কিছু মানুষ। অন্যকে সচেতন করতে সুরক্ষা সামগ্রী পৌঁছে দিতে রাস্তায় নেমে এসেছেন তারা। নিজেদের জন্য ঝুঁকি জেনেও দুর্দিনে বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। গত তিনদিন ধরে প্রতিদিন সিলেট নগরীতে ১৫/১৬টি সংগঠন এই সচেতনতামূলক প্রচারণা ও পরিচ্ছন্নসামগ্রী বিতরণের কাজ করছে।
এদের দেখে আগ্রহী হচ্ছেন আরও অনেকে। প্রতিদিনই বাড়ছে স্বেচ্ছাসেবীদের সংখ্যা। কেউ মাস্ক বিতরণ করছে, কেউ হ্যান্ড স্যানিটাইজার, কেউবা আবার পথচারীদের হাত ধোয়ার জন্য মোড়ে মোড়ে পানির ব্যবস্থা করছেন। এইসব মানুষেরা আছে বলেই বোধহয় নাজিম হিকমত লিখেছিলেন- ''দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে'।
এই স্বেচ্ছাসেবীরা যখন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষের হাতে পৌছে দিচ্ছেন সচেতনতার বার্তা আর পরিচ্ছন্নতার উপকরণ তখন একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দিন কাটছে গবেষণাগারে।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, হলও বন্ধ। তবু কিছু শিক্ষক আর শিক্ষার্থী মিলে সেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তৈরি করছেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার। যা বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে।
মঙ্গলবার নগরীর জিন্দাবাজার এলাকায় চলাচলকারী সকল যানবাহন এবং চালক ও যাত্রীদের শরীরে জীবানুনাশক স্প্রে করছিলো একদল তরুণ। তারা পজিটিভ জেনারেশন অব সোসাইটি (পিজিএস) নামে একটি সংগঠনের সদস্য।
ওই সংগঠনের সমন্বয়কারী চৌধুরী ঝর্ণা জানান, যানবাহনের মাধ্যমেও ভাইরাস ঘরে প্রবেশ করতে পারে। বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট অঞ্চলে, যেখানে বিদেশ ফেরত অনেকে সঠিকভাবে কোয়ারেন্টিনে থাকছেন না, সেখানে এমন ঝুঁকি আরও বেশি রয়েছে। তাই আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি। আগামীতেও আমাদের উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। সেই সঙ্গে নিজেদের তৈরি দুই হাজার মাস্ক হাসপাতালে ও নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের কাছে বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশপাশি দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণেরও পরিকল্পনা আছে আমাদের।
সিলেটের সংস্কৃতিকর্মী হুমায়ুন কবির জুয়েল বলেন, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। আমরা এই দুই বিষয়ে কাজ করছি। নিজেরা চাঁদা দিয়ে সাবান ও মাস্ক কিনেছি। হ্যান্ড সেনিটাইজার প্রস্তুত করেছি।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আমরা সচেতনতামূলক কিছু লিফলেট ও স্টিকার তৈরি করে সেগুলো পথচারী ও যানবাহনের চালক ও যাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করছি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে স্বেচ্ছাশ্রমে হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুতকারী দলের নেতৃত্বে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. গকুল চন্দ্র বিশ্বাস।
তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা স্বউদ্যোগেই এই কাজ করছে। আমাদের বিভাগের পাশাপাশি রসায়ন বিভাগের ছাত্ররাও এতে অংশ নিয়েছে।
কেবল সিলেট শহরে নয়, বিভাগের বিভিন্ন উপজেলা শহরগুলোতেও পরিচ্ছন্নতার উপকরণ আর সচেতনতার বার্তা দিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে অনেকে। যাদের বেশিরভাগই তরুণ।
জৈন্তাপুর উপজেলা ট্রান্সপোর্ট মালিক সমিতির অর্থায়নে সেখানকার কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে তৈরি করেছে এক হাজার পিস হ্যান্ড স্যানিটাইজার। যা বুধবার থেকে উপজেলা শহরে বিতরণ শুরু হয়।
ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নসহ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠনকেও এমন কার্যক্রম চালাতে দেখা গেছে।