লাজুক পুরুষ সঙ্গীর সাথে অ্যালবাট্রসের বিচ্ছেদের ঘটনা সবচেয়ে বেশি: গবেষণা
পাখিদের মধ্যে একগামিতার 'পোস্টার বার্ড' হিসেবে ধরা হয় ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রসকে। শ্বেতশুভ্র, সুন্দর এই পাখিটি মৌসুমের পর মৌসুম, সমুদ্রে একের পর এক দীর্ঘ যাত্রা একই সঙ্গীর সাথে পার করে দেয়; প্রজননও ঘটায় একই সঙ্গীর সাথে। ডানার প্রসারতার দিক থেকে অ্যালবাট্রসদের সব প্রজাতির মধ্যে তো বটেই, বিশ্বের অন্য সব পাখিদের মধ্যেও সবচেয়ে বড় ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রস। তবে মাইলের পর মাইলে দূর-দূরান্তে একটানা উড়ে যাওয়ার ক্ষমতার জন্য প্রজাতিটির এই নামকরণ করা হয়েছে।
কিন্তু এই অ্যালবাট্রসদের মধ্যে সবচেয়ে বিরল যে বৈশিষ্ট্যটি দেখা যায় তা হলো- বিচ্ছেদ। পক্ষীবিদদের ভাষ্যে, যখন কোনো পাখি তার সঙ্গীকে ছেড়ে চলে যায় এবং নতুন কারো সঙ্গে ঘর বাধে, কিন্তু সেই সঙ্গী/সঙ্গীনি একাই রয়ে যায় দলের মধ্যে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে বিচ্ছেদের হারে পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রসদের মধ্যেই এই হার সবচেয়ে কম।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে অ্যালবাট্রসদের মধ্যে একেবারেই বিচ্ছেদ ঘটে না। এমআইটির বিজ্ঞানীরা এবং উডস হোল ওশীনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশন এর এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রসদের মধ্যে বিচ্ছেদের প্রধান ফ্যাক্টর হলো- ব্যক্তিত্ব।
বায়োলজি লেটারস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অ্যালবাট্রস জুটির মধ্যে বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে পুরুষ অ্যালবাট্রসের 'সাহসিকতা'। পুরুষ সঙ্গীটি যত বেশি সাহসী ও আগ্রাসী আচরণ করবে, তার সঙ্গীনি তাকে তত বেশি পছন্দ করবে। কিন্তু পুরুষ অ্যালবাট্রস যত বেশি লাজুক স্বভাবের হবে, তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের ঝুঁকি ততই বেড়ে যাবে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, বন্য প্রাণীদের মধ্যে বিচ্ছেদের সঙ্গে প্রাণীদের ব্যক্তিত্বের সংযোগ নিয়ে তারাই প্রথম গবেষণা করেছেন।
গবেষণার সিনিয়র লেখক স্টেফানি জেনুবিয়ার বলেন, "আমরা ভেবেছিলাম পুরুষ সঙ্গীটি বেশি সাহসী ও আগ্রাসী হলে বিচ্ছেদের হার বেশি হবে, কারণ তারা সঙ্গীকে ত্যাগ করে নতুন কাউকে বেছে নেওয়ার দিকে বেশি আগ্রহী হবে ভবিষ্যতে আরও ভালো প্রজননের আশায়। কিন্তু এখানে দেখতে পাচ্ছি সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার। লাজুক পুরুষ সঙ্গীদের ক্ষেত্রেই বিচ্ছেদ বেশি হয় কারণ অন্য সাহসী পুরুষ অ্যালবাট্রস তখন তাকে হটিয়ে জায়গা করে নিতে চায়। আমাদের ধারণা, আরও অনেক প্রাণী প্রজাতির মধ্যেই বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে 'ব্যক্তিত্ব' একটি বড় ভূমিকা রাখে, তবে অন্য উপায়ে।"
গবেষণার প্রধান লেখক, এমআইটির গ্র্যাজুয়েট রুইজিয়াও সান জানান, ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রসদের মধ্যে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে নতুন এই প্রমাণ বের করতে পারায় এটি এই প্রজাতিটির স্থিতিস্থাপকতা অনুমান করতে সাহায্য করবে।
তিনি আরও বলেন, "ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রস ঝুকির মুখে থাকা একটি প্রজাতি। এদের মধ্যে বিচ্ছেদ ও ব্যক্তিত্বের সংযোগের বিষয়টি বুঝতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এটি গবেষকদের ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রসদের সংখ্যার গতিশীলতা বুঝতে ও এদের সংরক্ষণের উপায় বের করতে সাহায্য করবে।"
বিচ্ছেদের পুনরাবৃত্তি
নতুন এ গবেষণাটিতে ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রসদের একটি গোষ্ঠী, যেগুলো প্রজননের জন্য পজেশন আইল্যান্ড ও দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে আসা-যাওয়া করে নিয়মিত, সেগুলোকে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। পঞ্চাশের দশকে শুরু হওয়া একটি দীর্ঘমেয়ারি গবেষণার অংশ হিসেবে এদের উপর নজর রাখা হয়েছে। এ গবেষণার আওতায় পাখিগুলোর প্রতিটি প্রজনন মৌসুম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং প্রতি বছর তাদের সঙ্গীদের সাথে জুটি বাঁধার ও বিচ্ছেদের রেকর্ড রাখা হচ্ছে।
এই বিশেষ গোষ্ঠীটির মধ্যে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, যেসব অ্যালবাট্রসের একবার বিচ্ছেদ ঘটে, তাদের মধ্যে এ প্রবণতাটি বারবার দেখা দেয়।
স্টেফানি জেনুবিয়ার বলেন, "আমরা শুধু জানতে চাচ্ছিলাম বারবার কেন তাদের বিচ্ছেদ ঘটছে। মানুষের মধ্যেও আপনি এই প্রবণতা দেখতে পাবেন। ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রসদের ডেমোগ্রাফিক ও ব্যক্তিত্বের ডেটা আমাদের কাছে আছে।"
ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রসদের ব্যক্তিত্ব বিষয়ক ডেটা এসেছে ২০০৮ সালে শুরু হওয়া একটি গবেষণা থেকে যা এখনো চলছে। ঐ গবেষণার সহ-লেখক প্যাট্রিকও পজেশন আইল্যান্ডের ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রসদের ব্যক্তিত্ব পরিমাপ করতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রাণীর আচরণ নিয়ে করা গবেষণায় কোনো একক প্রাণীর প্রদর্শিত সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণকে তার ব্যক্তিত্ব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। জীববিজ্ঞানীরা প্রধানত প্রাণীদের ব্যক্তিত্বকে হয় লাজুক বা সাহসী, কিংবা কম-বেশি আগ্রাসী হিসেবে পার্থক্য করেন।
প্যাট্রিকের গবেষণার সূত্র ধরেই অ্যালবাট্রসদের সাহসিকতার পরিমাপ করা হয়েছে। এটি তারা করেছেন একজন মানুষ পাখিদের বাসার ধারেকাছে (৫ মিটারের দূরত্বে) এগোতে গেলে পাখিদের প্রতিক্রিয়া কী হয়, তার উপর ভিত্তি করে। পাখিটি যদি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখায় তাহলে তার স্কোর শূন্য, অর্থাৎ ওই পাখিটি সবচেয়ে লাজুক। পাখিটি যদি মাথা তোলে বা দাঁড়ায়, তাহলে তার স্কোর সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ, পাখিটি সাহসী।
এভাবেই বছরের পর বছর ধরে পাখিদের ব্যক্তিত্বের নানা বিষয় পরিমাপ করেছেন প্যাট্রিক। তার এ গবেষণা দেখেই সান ও জেনুবিয়ারের মনে প্রশ্ন জাগে, মানুষের বিচ্ছেদের সাথেও কী তাদের ব্যক্তিত্বের সংযোগ রয়েছে?
লাজুক পাখি
গবেষণায় জনতাত্ত্বিক ও ব্যক্তিত্ব-সংক্রান্ত ডেটা ব্যবহার করে গবেষকরা দেখার চেষ্টা করেছেন সাহসী ও লাজুকের মাঝামাঝি কিছু আছে কিনা। তারা দেখতে পেয়েছেন, নারী অ্যালবাট্রসের ব্যক্তিত্ব অ্যালবাট্রস জুটির বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে খুব একটা ভূমিকা রাখে না। কিন্তু পুরুষ সঙ্গীর আচরণ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। লাজুক স্বভাবের পাখিদেরই বিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি বলে প্রমাণ পেয়েছেন তারা।
কিন্তু এমনটা কেন ঘটে? এর কারণ, ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রসদের মধ্যে পুরুষ অ্যালবাট্রসের সংখ্যা নারী অ্যালবাট্রসের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে পুরুষ অ্যালবাট্রসদের মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। তারা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে একটি নারী অ্যালবাট্রসের সাথে জুটি বাঁধতে চায়। ফলে জুটিদের মধ্যে 'তৃতীয় ব্যক্তি'র আগমন ঘটে।
এসময় লাজুক স্বভাবের পুরুষ সঙ্গীটি লড়াই করে নিজের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারে না, ফলে সে তার সঙ্গীনিকে হারায়। কিন্তু পুরুষ সঙ্গীটি সাহসী হলে সে তার সঙ্গীনিকে পাহারা দিতে পারে এবং নিজেদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে।
সূত্র: এমআইটি নিউজ