২ থেকে ৩ ঘণ্টার জন্য যে অফিস আপনার!
সদ্য স্নাতক শেষ করেছেন উপমা। কাঙ্ক্ষিত চাকরির সন্ধান এখনও পাননি, তবে টুকটাক ফ্রিল্যান্সিংয়ে হাত পাকিয়েছেন বেশ আগেই। স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় অবসরে টুকটাক কাজ করে নিজের হাত খরচ চালিয়েছেন নিজেই। তবে বিপত্তি বাধলো হল ছাড়ার পরপরই। বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করে বাসা নিলেন রাজধানীর কলাবাগান এলাকায়।
খরচের রাশ টেনে ধরতে থাকা, খাওয়াসহ সবেতেই বন্ধুর সঙ্গে ভাগাভাগি। এসবের পাশাপাশি ইলেকট্রিসির বেহাল দশা, ইন্টারনেটের সংযোগ যারা দেন তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা কাটাকাটি হয়ে দাঁড়াল নিত্যদিনের সঙ্গী। ফলাফল, ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য যে সময়টুকু দেওয়া প্রয়োজন সেটাও দিতে পারছিলেন না ঠিকভাবে।
এরকম সময়ে উপমা হঠাৎ জানতে পারেন ব্রুটাউন নামক একটা ক্যাফের কথা, যেখানে চাইলেই ঘণ্টা হিসেবে অফিস ভাড়াও নেওয়া যায়। কালবিলম্ব না করে ফেসবুকে পাওয়া নম্বরে কল দিয়ে ফেললেন। এরপর দিনই প্রয়োজনীয় সবকিছ গুছিয়ে চলে গেলেন সিদ্ধেশ্বরী রোডে অবস্থিত ব্রুটাউন ক্যাফেতে।
ছোট্ট ছিমছাম ক্যাফেটির ৩ তলায় খুঁজে পেলেন বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই ব্রুটাউন কানেক্টস। এখানেই কথা হলো হলো উপমার সঙ্গে। জানালেন, প্রতিদিন সকালেই রওনা দেন, প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করে তবেই বাড়ি ফেরেন। গত ছয় মাস এভাবেই চলছে তার ফ্রিল্যান্সিং।
ব্রুটাউন ক্যাফে
সিদ্ধেশ্বরী রোডে ভিকারুননিসা স্কুলের পেছনের গেট থেকে কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে গেলে বেশ বড় করে ব্রুটাউন ক্যাফে লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়বে। ঘণ্টা হিসেবে, সারাদিনের জন্য অথবা মাসিকভিত্তিতে অফিসের সবধরনের সেবা এখানে পাওয়া যাবে নির্ঝঞ্ঝাটে। যদি ঘণ্টা হিসেবে এখানে কাজ করতে চান তবে সেক্ষেত্রে প্রতিঘণ্টায় খরচ পড়বে ১৩০ টাকা। আর সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে চাইলে খরচ পড়বে ৮০০ টাকা।
এছাড়া প্রয়োজন বিশেষে চাইলে মেম্বারশিপ পদ্ধতিতেও এখানে সহজেই কাজ করা সম্ভব। আর মেম্বারশিপ কার্ড করে নিলে মাসে ২,৫০০ টাকার মতো খরচ পড়বে বলে জানাচ্ছিলেন ব্রুটাউনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাবিল রহমান।
২০১৬ সাল থেকে ব্রুটাউন ক্যাফের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাবিল রহমান। তবে ২০২১ সালে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'-এর কারণে বাসা থেকে কাজ করতে অসুবিধার কথা ভেবেই, এ ধরনের আইডিয়া মাথায় আসে তার।
কাজ করতে করতে একঘেয়ে লাগার কোনো সুযোগ নেই এখানে। কেননা কাজের ফাঁকে ফাঁকে চাইলেই মিলবে ব্রুটাউন ক্যাফের বিভিন্ন খাবার খাওয়ার সুযোগ। যদিও কোভিডের পর ব্রুটাউন ক্যাফে ব্যবহারকারীর কিছুটা কমে এসেছে বলে কথায় কথায় জানালেন দোকানটির এক কর্মচারী।
সম্প্রতি ব্রুটাউন কানেক্টের মতো আরও বেশকিছু কো-ওয়ার্কিং অফিস গড়ে উঠেছে। এগুলোতেও ঘণ্টা ও মাসহিসেবে অফিস ভাড়া দেওয়া হয়। চলুন জেনে নেওয়া যাক, রাজধানীতে গড়ে ওঠা এরকম বেশকিছু কো-ওয়াকিং অফিস স্পেস সম্পর্কে।
দ্য ব্রিজ কো-ওয়ার্কার স্টেশন
ব্রিজ কো-ওয়ার্কার স্টেশনে প্রতি ঘণ্টায় ও মাসের চুক্তিতে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। ঘণ্টা হিসেবে কাজের জন্য বরাদ্দ টেবিল বা ফ্লেক্স ডেস্কের ক্ষেত্রে ভাড়া ১৪০ টাকা। তবে চাইলে এক মাসের জন্য ঘণ্টা হিসেবেও কাজ করা যায় এখানে। আরও আছে কক্ষ ভাড়া নেওয়ার সুযোগও।
মাসে ৩৫ ঘণ্টা হলে এতে খরচ পড়বে আড়াই হাজার টাকা। এছাড়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ মাসে সাড়ে নয় হাজার টাকায় মিলবে আনলিমিটেড সময় অফিস ব্যবহারের সুযোগ। ১৮ ও ৩৫ হাজার টাকায় রুম ভাড়াও নেওয়া যাবে। রয়েছে ক্যান্টিনের ব্যবস্থাও। ফলে কাজের ফাঁকে খাওয়াদাওয়া নিয়ে ভাবনার তেমন কোনো অবকাশ নেই বললেই চলে। কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ের সেল রোজ এন ডেল-এ ভবনের লেভেল ১০-এ মিলবে এ স্টেশনটি।
মোড়
রাজধানীর গুলশান, ধানমন্ডি, বনানীতে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা ৪/৫ জন মিলে যেকোনো মিটিংয়ে অংশ নিলে বেছে নিতে পারেন মোড়।
সকাল ৮টা থেকে শুরু করে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ ওয়ার্কস্টেশনটি। যেকোনো সময় গিয়ে চাইলেই কাজ করতে ঘণ্টা হিসেবে ১৫০ টাকা দিতে হবে। সারাদিন কাজ করলে ৬০০ টাকা আর সপ্তাহ হিসেবে ২০০০ টাকা। ৩০ দিনের জন্য হলে প্রতিমাসে ৮০০০ টাকা খরচ হবে।
তবে মেম্বারশিপ পেয়ে গেলে হিসাব আলাদা। এক্ষেত্রে ৩০ দিনের জন্য 'স্টার্টার মেম্বারশিপে' গুনতে হবে তিন হাজার টাকা। প্রতিমাসে আনলিমিটেড সময় ব্যবহারের জন্য খরচ ১০ হাজার টাকা। মাসে ৪০ ঘণ্টা হিসেবে সকল সুবিধাসহ খরচ পড়বে ২০ হাজার টাকা।
এছাড়া মোড়-এর বনানীর ওয়ার্কস্টেশনটিতে ৩০ জন উপস্থিত থাকতে পারবে, এমন মিটিংয়ের আয়োজনের ব্যবস্থাও রয়েছে। এতে খরচ পড়বে ২৫ হাজার টাকা।
লুকাস
রাজধানীর বনানীর ১১-এর ব্লক সি-তে অবস্থিত লুকাস নামক আরও একটি কোওয়ার্কিং স্টেশন রয়েছে। এতে ঘণ্টা হিসেবে প্রতিদিন ৭৯৯ টাকা খরচ পড়বে। অন্যদিকে, প্রতি সপ্তাহে ১০০০ টাকা ও প্রতিমাসে ৩,৫০০ টাকা করে খরচ লাগবে। শুক্রবার বাদে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে স্টেশনটি।
ঘণ্টা বাদে কেবল মাস হিসেবেও ভাড়া নিতে পারেন অনেক অফিস।
শেয়ার অন
বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের আবেদীন টাওয়ারে এর অফিস রয়েছে। প্রতিঘণ্টায় ৬ জনের জন্য এতে খরচ পড়বে ১০০০ টাকা। ৮ জন হলে এতে তা দাঁড়াবে ১২০০ টাকায়। তবে ব্যক্তিগতভাবে ভাড়া নিলে অবশ্য মাসভিত্তিতে টাকা দিতে হবে, এক্ষেত্রে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ পড়বে। প্রেজেন্টেশন, ভার্চুয়াল ডেমনস্ট্রেশনের জন্য প্রজেক্টরসহ হোয়াইট বোর্ডেরও ব্যবস্থা করা হবে শেয়ার অনের পক্ষ থেকেই।
কোস্পেস ঢাকা
সপ্তাহে ৬ দিন কোস্পেস ঢাকা কাজের জন্য পাওয়া যাবে। লকার, সিসি ক্যামেরাসহ যাবতীয় সুবিধা পাওয়া যাবে কোস্পেস ঢাকায়। এরমধ্যে একজনের জন্য প্রাইভেট অফিস কেবিনের সুবিধাও রয়েছে। আবার এক থেকে পাঁচ জনের জন্য প্রাইভেট অফিস স্পেস, ২০০ ও ৫০০ স্কয়ার ফিটের অফিস স্পেস রয়েছে।
বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের আওয়াল সেন্টার ও এআর টাওয়ারে ১৫ হাজার টাকায় অফিস শেয়ারের এ সুবিধা পাওয়া যাবে।
বিজনেস সেন্টার
কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস বা এক মাসের জন্য অফিস খুঁজলে সেক্ষেত্রে সমাধান হতে পারে গুলশানের ১১৩/এ-তে অবস্থিত বিজনেস সেন্টার। শুক্রবার বাদে শনি থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ সেন্টার।
ট্রেনিং হলসহ কনফারেন্স রুম, প্রাইভেট ওয়ার্কস্টেশন, ম্যানেজার'স স্যুট, এক্সিকিউটিভ স্যুটসহ সবই ভাড়া নেওয়ার সুযোগ রয়েছে এই সেন্টারে। এদের প্রত্যেকটিতেই ওয়াইফাই, লকার সুবিধা রয়েছে। তবে মেম্বারশিপ থাকলে সুবিধা মিলবে প্রতিটি স্থানেই। প্রাইভেট অফিস, ডেডিকেটেড ডেস্ক, হট ডেস্কসহ মোট তিন ধরনের ডেস্কের মেম্বার হওয়ার সুবিধা রয়েছে এতে।
কোরেইসারস
রাজধানীর হাতিরঝিলে রয়েছে কোরেইসারস। এতে প্রাইভেট ওয়ার্কস্টেশন, ম্যানেজার'স স্যুট, এক্সিকিউটিভ স্যুট'স, ডেকোরেটেড বিজনেস স্যুট রয়েছে। এ গ্রুপের মিটিং রুম ভাড়ার বিষয়টি অন্যান্য সব অফিস রেন্টের তুলনায় কিছুটা ব্যতিক্রম। ফুল ডে, হাফ ডে বা ঘণ্টা ধরে মিটিং রুম ভাড়া নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ৪০০০-৮০০০ টাকায় রয়েছে মিটিংয়ের সুযোগ।
স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাওয়া মানুষদের কথা মাথায় রেখে বর্তমানে অফিস স্পেস রেন্ট বা কো-ওয়ার্কিং ধারণাটি গড়ে উঠেছে বিশ্বজুড়ে। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও, ইতোমধ্যেই কাজের এই মাধ্যমটি বেশ ভালো একটি অবস্থানে চলে গেছে। ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৮ সালেই বিশ্বব্যাপী এই মাধ্যমটি প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। ২০২৫ সাল নাগাদ এ মাধ্যমে কাজের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন ওয়ার্কস্পেস বিশেষজ্ঞ ও কো-বেল্ট নামে একটি ওয়ার্কস্পেসের প্রতিষ্ঠাতা জশ মেন্ট।