কাতারে সেমি-ফাইনাল খেলতে পারবে কোনো আফ্রিকান দল?
বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত কোয়ার্টার-ফাইনালের গেরো পার হতে পারেনি কোনো আফ্রিকান দেশ। যেই মহাদেশ থেকে উঠে এসেছেন অসংখ্য তারকা খেলোয়াড়, সেই মহাদেশের কেউ কেন কখনো জিততে পারল না বিশ্বকাপ? একজন সাধারণ ফুটবল ভক্তের মনে এই প্রশ্ন জাগাটা খুব স্বাভাবিক।
বিশ্বকাপ জেতার প্রশ্নটা আপাতত তোলা থাক। ২০২২ বিশ্বকাপে কোনো আফ্রিকান দল প্রথমবারের মতো সেমি-ফাইনাল খেলতে পারবে কিনা সেটিই বরং আলোচনা করা যায়। সেনেগাল, ক্যামেরুন, ঘানা, তিউনিশিয়া এবং মরক্কোর যেকোনো একটি দলকে ইতিহাস বদলে তবেই পৌঁছাতে হবে সেমি-ফাইনালের চৌকাঠে। পারবে কী তারা?
১৯৯০ বিশ্বকাপে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে কোয়ার্টার-ফাইনালে উঠে ক্যামেরুন। যেটি টপকাতে পারেনি আর কোনো আফ্রিকান দলই। ২০০২ বিশ্বকাপে সেনেগাল আর ২০১০ বিশ্বকাপে ঘানাও কোয়ার্টার-ফাইনালেই বিদায় নেয়। এছাড়া আর বলার মতোন কোনো অর্জন বিশ্বকাপে নেই আফ্রিকানদের। প্রতিভার বিচারে যা খুবই নগণ্য।
১৯৯০ বিশ্বকাপে রজার মিলা দেখিয়েছিলেন তার জাদু। প্রথম কোনো আফ্রিকান দল হিসেবে ক্যামেরুন সেবারই ৩টি ম্যাচ জিতে। যার মধ্যে ছিলো আগের বারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে হারানোও! রোমানিয়া আর কলম্বিয়ার বিপক্ষে বাকি দুইটি ম্যাচ জেতে ক্যামেরুন। ওই টুর্নামেন্টে ক্যামেরুনের সাফল্যের পর গোটা আফ্রিকাজুড়েই ফুটবল ঝড় উঠে। এমনকি ২০০০ সালের মধ্যে কোনো আফ্রিকান দল বিশ্বকাপ জিতবে, পেলের করা এমন ভবিষ্যতবাণী সত্যি হওয়ার স্বপ্নও দেখতে শুরু করেন আফ্রিকান ফুটবলপ্রেমিরা। তবে সেটি ঘটার কাছাকাছিও যেতে পারেনি কেউ, জেতা তো দূরেই থাক।
২০০২ বিশ্বকাপে সেনেগালের শুরুটা হয়েছিল স্বপ্নের মতোন। সেনেগালের সোনালি প্রজন্মের হাত ধরে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার-ফাইনালে পৌঁছায় তারা। গ্রুপ পর্বে অপরাজিত থেকেই নক-আউট পর্বে উঠে সেনেগাল, বলা বাহুল্য যেটি কোনো আফ্রিকান দলের জন্য প্রথম নজির। গ্রুপে পর্বে সেনেগাল হারায় আগের বারের চ্যাম্পিয়ন এবং দুই বছর আগেই ইউরো চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে। কোয়ার্টার-ফাইনাল থেকে সেনেগাল বিদায় নেয় 'গোল্ডেন গোলে' হেরে। তবে এরপর আরো ভালো করার বদলে পরের তিন বিশ্বকাপে সুযোগই পায়নি তারা।
২০১০ বিশ্বকাপের ঘানা তো ফুটবল পুরাকীর্তিরই অংশ। আফ্রিকা মহাদেশেই হওয়া প্রথম বিশ্বকাপে আফ্রিকা থেকে দল ছিলো ৬টি। শুধুমাত্র ঘানাই গ্রুপ পর্বের বৈতরণী পার হতে পেরেছিল। ২০০৬ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েই নক-আউট পর্বে উঠা আর সদ্যই ফিফা অনূর্ধব-২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জেতা ঘানা কোয়ার্টার-ফাইনালে উরুগুয়েকেও নড়িয়ে দিয়ে সেমি-ফাইনালে যাওয়ার রাস্তা পরিস্কার করেই ফেলেছিল প্রায়, বাঁধ সাধে লুইস সুয়ারেজের 'হ্যান্ডবল'! যেই হ্যান্ডবলের জন্য আজও সুয়ারেজকে ক্ষমা করতে পারেনি ঘানা।
তবে এত এত প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও আফ্রিকান দলগুলোর বিশ্বকাপ জিততে না পারার পেছনের সবথেকে বড় কারণ ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকার সাথে তাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য। বিশ্বের সবথেকে গরীব ১০ দেশগুলোর তালিকায় ৯টিই যে আফ্রিকান! এই গরীবি হালের কারণেই ফুটবলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন তো করা সম্ভবই না বরং দুর্নীতি বাড়ছে দিনদিন, প্রাপ্য সম্মানী না পেয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যেও পেশাদারিত্বের কোনো মানসিকতা গড়ে উঠছে না।
বিশ্বকাপেই এমন নজির আছে যে দলের খেলোয়াড়দের পাওনা বেতন দেয়নি কোনো না কোনো দল, যার কারণে খেলোয়াড়দেরও দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার আকাঙ্খায় ভাটা পড়ে যায়।
বিশ্বকাপে আফ্রিকানদের ভালো না করতে পারার আরেকটি বড় কারণ তাদের উপস্থিতির সংখ্যা। ৫৪টি ফেডারেশন সংবলিত আফ্রিকান অঞ্চলের বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব থেকে বিশ্বকাপে জায়গা পায় মাত্র ৫টি দেশ। যেখানে ৫৫ দেশ থেকে ইউরোপের জন্য বরাদ্দ ১৩টি জায়গা, মাত্র ১০ টি দেশ থেকেও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বরাদ্দ থাকে ৪টি জায়গা। আফ্রিকার এই কম জায়গা বরাদ্দের কারণে তাদের বাছাইপর্ব পার হওয়া সবথেকে কঠিন। কম জায়গার কারণেই কিনা নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট, আলজেরিয়া, মিশরের মতো শক্তিশালী দলের জায়গা হয়নি কাতার বিশ্বকাপে।
এবারের বিশ্বকাপে আফ্রিকার প্রতিনিধিত্ব করা দলগুলোর মধ্যে কেউ সেমি-ফাইনালে পৌঁছাতে পারবে কিনা সেটি সময়ই বলে দিবে। তবে সেনেগাল ছাড়া বাকি দলগুলোর গ্রুপ পর্বের ড্র খুব একটা অনুকূল নয় বলা চলে। গ্রুপ 'এ' তে সেনেগালের প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডস, স্বাগতিক কাতার এবং ইকুয়েডর। নেদারল্যান্ডস ছাড়া বাকি দুই দলকে হারানোর সামর্থ্য আছে সেনেগালের।
গ্রুপ 'ডি' তে তিউনিশিয়ার প্রতিপক্ষ বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স, ইউরোপিয়ান পরাশক্তি ডেনমার্ক এবং অস্ট্রেলিয়া। ফ্রান্স এবং ডেনমার্কে টপকে পরের রাউন্ডে যাওয়া তিউনিশিয়ার জন্য অনেক বেশি কঠিনই বটে।
গ্রুপ 'এফ' এ মরক্কোকে লড়তে হবে বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া এবং কানাডার বিপক্ষে। এই গ্রুপ থেকে বেলজিয়াম এবং ক্রোয়েশিয়াকেই ফেভারিট দেখছে সবাই।
গ্রুপ 'জি'তে ঘানার কাজটাই সবথেকে কঠিন। নক-আউট পর্বে যেতে ঘানাকে টপকাতে হবে কাতার বিশ্বকাপেরই অন্যতম দুই ফেভারিট পর্তুগাল এবং উরুগুয়েকে। সঙ্গে হুটহাট বড় দলকে হারিয়ে চমক দেখানো দক্ষিণ কোরিয়া তো আছেই।
সর্বশেষ গ্রুপ 'এইচ' এ থাকা ক্যামেরুনের প্রতিপক্ষ ব্রাজিল, সুইজারল্যান্ড এবং সার্বিয়া। ব্রাজিলকে হারানোটা দিবাস্বপ্নের মতো হলেও পরের রাউন্ডে যেতে সুইজারল্যান্ড বা সার্বিয়ার যেকোনোটিকে হারাতেই হবে ক্যামেরুনকে। যেটিরও সম্ভাবনা কম।
গ্রুপগুলোর ড্র অনুযায়ী এবং দলগুলোর শক্তিমত্তা বিচারে সেনেগালেরই সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে এবারের বিশ্বকাপে আফ্রিকান নিশান উড়িয়ে নেয়ার। সেনেগালের বাইরে যদি অন্য কোনো দলও নিজেদের মেলে ধরে, সেটি আফ্রিকার ফুটবলের জন্যই লাভ। তবে প্রথমবারের মতো কোনো আফ্রিকান দলের সেমি-ফাইনাল খেলার স্বপ্নটা বোধোহয় কাতার বিশ্বকাপেও পূরণ হচ্ছে না।