লকডাউনে কঠোর অবস্থানে পুলিশ, বেপরোয়া নাগরিক
দেশের কয়েকটি জেলায় ঘোষণা দিয়ে লকডাউন পালন করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার পর চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নরসিংদীতে গত কয়েকদিন ধরে লকডাউন চললেও শুক্রবার থেকে কয়েকটি জেলা ও একটি উপজেলা লকডাউনের আওতায় এসেছে।
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রুখতে লকডাউন ঘোষণা হওয়া জেলাগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে টহল দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা জেলাগুলোর প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসিয়ে জেলার ভেতরে কাউকে ঢোকা বা বের হওয়ার ব্যপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তবে জরুরি সেবাগুলো এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট।
লকডাউনে ফাঁকা বন্দরনগরী
প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযানে ফাঁকা হয়ে গেছে চট্টগ্রাম নগর। মূল সড়ক থেকে অলিগলি পর্যন্ত প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ। পাঁচজন রোগী শনাক্তের পর ইতোমধ্যে বন্দরনগরীর বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে রোগী শনাক্ত হওয়ায় নগরের দামপাড়া, হালিশহর ও সাগরিকা এলাকার বাসিন্দারা ভয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে না।
গত সোমবার লকডাউন ঘোষণার পর চট্টগ্রাম নগরজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে পুলিশ। লকডাউন নিশ্চিতের নগরের প্রবেশমুখ সিটি গেট, অক্সিজেন, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, কালুরঘাট সেতু ও শাহ আমানত সেতুর মুখে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার গাড়ি আটক করা হয়েছে।
নগরের হালিশহর শাপলা আবাসিকের বাসিন্দা শাকিল ভূঁইয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আমাদের বাসার পাশে একটি ভবনের একজন নারী বাসিন্দার করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে ভবনটি লকডাউন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের পুরো আবাসিকের লোকজন ঘর থেকে বের হচ্ছে না। এখানকার দোকানগুলো বন্ধ রয়েছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মাহাবুবর রহমান বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত লকডাউন চলবে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের লকডাউন নিশ্চিতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেকোনো জরুরি সেবার জন্য হটলাইন নম্বরে ফোন করলে পুলিশ সেবা দিয়ে আসছে।
গাইবান্ধা লকডাউন
করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে লকডাউন করে দেওয়া হচ্ছে উত্তরের জেলা গাইবান্ধা। শুক্রবার বিকেল থেকে ওই জেলায় লকডাউন শুরু হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন জানান, এখনো গাইবান্ধা ঝুঁকিপূর্ণ নয়; তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, করোনো ভাইরাস যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য পাহারা চৌকি বসিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
অন্যদিকে, গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু রায়হান দোলন জানান, মুন্সিগঞ্জ এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে যে ৯৫ জন শ্রমিক এসেছেন, তাদের সবাইকেই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে।
কুমিল্লা লকডাউন
ইতোমধ্যেই কুমিল্লা জেলাকে লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করা হয়েছে। শুক্রবার বিকেল ৩টায় জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে এ ঘোষণা দেন।
জেলা প্রশাসক গণবিজ্ঞপ্তিতে জানান, করোনাভাইরাস প্রতিরোধের লক্ষ্যে গঠিত জেলা কমিটির শুক্রবার অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্তের আলোকে প্রাণঘাতি ভাইরাসটির সংক্রমণ ঝুঁকি মোকাবেলায় জেলাকে অবরুদ্ধ ঘোষণা করা হলো। এ জেলায় জনসাধারণের প্রবেশ ও প্রস্থান নিষেধ। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক, মহাসড়ক ও নৌপথে অন্য কোনো জেলা থেকে কেউ এ জেলায় প্রবেশ করতে কিংবা জেলা থেকে বের হতে পারবে না।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কযোগে কুমিল্লা জেলার ওপর দিয়ে অন্যান্য জেলার আন্তঃসংযোগ এর আওতা বর্হিভূত থাকবে। জেলা ও উপজেলার যেকোনো সীমানা দিয়ে যানবাহনের প্রবেশ ও প্রস্থান বন্ধ থাকবে।
জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ শুক্রবার থেকে কার্যকর হয়ে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আদেশ অমান্যকারির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
কক্সবাজারে 'নৈরাজ্যকর' লকডাউন
৮ এপ্রিল বিকেল থেকে লকডাউন করা হয়েছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। ওমরাহ ফেরত বৃদ্ধা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্যের শরীরে করোনাভাইরাসের প্রাথমিক লক্ষণ পাওয়ার পর আতঙ্ক থাকলেও এখন পর্যন্ত নতুন কোনো উপসর্গ এখানে দেখা দেয়নি।
২ এপ্রিল কক্সবাজার সরকারি মেডিকেল কলেজে স্থাপিত ল্যাবে শুক্রবার পর্যন্ত ১৩৭ জনের করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এসেছে। কক্সবাজার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ঘোষণাকৃত লকডাউন বাস্তবায়নে মাঠে কঠোরভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেনাবাহিনী, পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহরের টেকপাড়া, বায়তুশ শরফ রোডসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, উপ-সড়কে স্থানীয়রা অতিউৎসাহি হয়ে বাঁশকল বা গাছের গুড়ি দিয়ে এলাকা লকডাউন ঘোষণা করেছে। সদরের খুরুশকুল-চৌফলদন্ডী সড়কে অন্তত ১৫টি এবং চৌফলদন্ডী জীপ স্টেশনে একটি ব্যারিকেড রয়েছে।
ঈদগাঁওয়ের মাইজপাড়া, আলমাছিয়া ফাজিল মাদ্রাসা এলাকাসহ চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, উখিয়া, টেকনাফের অনেক এলাকায় চলছে স্বঘোষিত লকডাউন। বেশ কয়েকটি ব্যারিকেডে জরুরি কাজে যাওয়া গাড়ি থেকে টাকাও নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সচেতন মহলের মতে, সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা না করেই, যে যার ইচ্ছামতো লকডাউন দিচ্ছে। ফলে প্রায় প্রতিটি পাড়া ও মহল্লা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। অনেকে প্রবেশ পথে ব্যারিকেড দিয়ে জুয়া খেলছে, বাড়ির বাইরে ঘোরাফেরা করছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশ এলাকায় প্রবেশ করতে গেলে ব্যারিকেডের কারণে আটকে যাচ্ছে। তখন ঘোরাফেরাকারিরা সাধু সাজছে। এমন নৈরাজ্য কোনোভাবেই কাম্য নয় বলে অভিমত স্থানীয়দের।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, লকডাউনের নামে রাস্তায় বাঁশ, কাঠ বা গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি না করতে নির্দেশনা রয়েছে। জেলা লকডাউন মানে এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে জটলা পাকিয়ে আড্ডা দেওয়া নয়। বরং নিজ নিজ অবস্থান থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বাড়িতে অবস্থান করা।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রমতে, কক্সবাজারে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫০০ জনকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। ছাড়পত্র পেয়েছেন সাড়ে ৪ শতাধিক জন।
পটুয়াখালীর দুমকি লকডাউন
পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলা শুক্রবার থেকে লকডাউন ঘোষণা করেছে প্রশাসন। দুমকিতে নারায়ণগঞ্জ ফেরত এক গার্মেন্টস কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে ২টায় নিজ বাড়িতে মারা যাওয়ার কারণে উপজেলাটি লকডাউন করা হলো।
৪ এপ্রিল দুলাল হাওলাদার নারায়নগঞ্জ থেকে অসুস্থ হয়ে দুমকিতে আসেন। তার শ্বাসকষ্ট, ডায়েবেটিস, কাশি, সর্দি ও গলাব্যথা ছিল। খবর পেয়ে জেলা স্বাস্থ্য প্রশাসন ৭ এপ্রিল তার নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠিয়ে তাকে হোম কোয়ারেন্টিন করে রাখে।
বৃহস্পতিবার তার নমুনার রিপোর্ট পটুয়াখালী সিভিল সার্জন অফিসে আসে। এতে তার শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি মেলে। করোনাভাইরাস প্রটোকল অনুযায়ী তাকে দাফন করা হয়। তার পিতার নাম আব্দুস সোবাহান হাওলাদার।
টাঙ্গাইলে লকডাউন থাকলেও মানছে না অনেকেই
করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে টাঙ্গাইল জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হলেও স্থানীয় অনেকেই তা মানছেন না। ফলে জেলায় করোনাভাইরাসের ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে শহরের সবচেয়ে বড় কাঁচাবাজার পার্ক বাজারটি ঈদগাহ ময়দানে স্থানান্তর করা হয়েছে।
টাঙ্গাইলে পরিবহনে অবাধেই যাতায়াত করছেন সাধারণ মানুষ। মহাসড়কেও দেখা গেছে পণ্যবাহী ট্রাকে ঢাকা ফেরত মানুষের ভিড়। তাদের অনেকেই জানান, নারায়ণগঞ্জ লকডডাউন ঘোষণার পর বিভিন্নভাবে পালিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন তারা।
এছাড়া শহরের বিভিন্ন রাস্তায় সাধারণ মানুষ নির্ভিঘ্নে চলাচল করছে। তবে প্রশাসনও রয়েছে কঠোর অবস্থানে। রাস্তায় অকারণে কাউকে দেখলেই জরিমানা বা কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। তবু থেমে নেই সাধারণ মানুষের আনাগোনা।