গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়েই, বাল্ক কার্গো খালাসে ৭২ বছরেও নতুন জেটি করেনি চট্টগ্রাম বন্দর
চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজের ৪৫ শতাংশই বাল্ক ক্যারিয়ার (খোলা পণ্যবাহী) জাহাজ। প্রতিবছর আমদানি-রপ্তানি ক্রমাগত বাড়ার কারণে খোলা পণ্যের হ্যান্ডলিয়ের প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশের বেশি হলেও জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে গত ৭২ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে গড়ে উঠেনি নতুন জেটি।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- লয়েডস লিস্টে বন্দরের অবস্থান এগিয়ে নিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ বারবার কন্টেইনার পণ্য খালাসকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক শিপিং পোর্ট র্যাঙ্কিংয়ে অগ্রগতির প্রধান মাপকাঠিগুলোর মধ্যে একটি এই পণ্য খালাস।
জেটি সংকটের কারণে খোলা পণ্য নিয়ে আসা বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজগুলোকে বহির্নোঙ্গরে (সমুদ্রে) পণ্য খালাস করতে হয়। পৃথিবীর অন্যান্য বন্দরে কন্টেইনার, এবং খোলা পণ্য খালাসে পৃথক জেটির ব্যবস্থা থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দরে তা নেই।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য মতে গত সাত অর্থ বছরে শুধু খোলা পণ্যের হ্যান্ডলিং বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে আমদানি-রপ্তানি বাল্ক কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ৭ কোটি ১১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮৭ মেট্রিক টন এবং ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ কোটি ৮১ লাখ ৭৪ হাজার ১৬০ মেট্রিক টনে।
এইভাবে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের হ্যান্ডলিং বাড়লেও বাড়েনি জেটি। এতে ঝুঁকি নিয়ে পণ্য খালাসের পাশাপাশি পণ্য নষ্ট হওয়ার ঘটনাও ঘটে। জেটিতে ভিড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় ১০ দিনেরও বেশি সময়। ফলে অপেক্ষমাণ সময় বাবদ প্রতিদিন জাহাগুলোকে গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার ডলার ক্ষতিপুরণ গুনতে হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসার খরচ কমাতে খোলা পণ্য খালাসের জন্য পৃথক জেটি নির্মাণ জরুরি। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে কর্ণফুলী টানেলের কারণে সেখানে জেটি নির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও খোলা পণ্য খালাসে জেটি নির্মাণের সুযোগ রয়েছে বলে জানান তারা।
যদিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী ড্রাইডক লিঃ নদীর দক্ষিণ পার্শ্বে ইতোমধ্যে দুটি জেটি নির্মাণ করেছে। যেখানে সর্বোচ্চ ১১ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি), চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) এবং নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) নামে তিনটি টার্মিনাল রয়েছে।
এরমধ্যে ১৯৫০ সালে নির্মিত জিসিবিতে ১৩টি, ১৯৯১ সালে নির্মিত সিসিটিতে ২টি এবং ২০০৭ সালে নির্মিত এনসিটিতে ৫টি সহ মোট ২০ টি জেটি রয়েছে।
গভীরতা কমে যাওয়ায় জিসিবির ১ নম্বর জেটিতে বাণিজ্যিক জাহাজ ভিড়ানো বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল কাজে নিয়োজিত জাহাজ নোঙ্গরের জন্য সর্ভিস জেটি তৈরি করা হয়েছে। ২০২১ সালে উদ্বোধন করা হয় এই সার্ভিস জেটি।
জিসিবির বাকি ১২টি জেটির মধ্যে ৬টিতে কন্টেইনার জাহাজ এবং ৬টিতে খোলা পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়ে। এনসিটি এবং সিসিটির ৭টি জেটিতে ভিড়ে শুধুমাত্র কন্টেইনার জাহাজ।
অর্থাৎ, বন্দরের অপারেশনে থাকা ১৯টি জেটির মধ্যে ৬টিতে বাল্ক ক্যারিয়ার এবং ১৩টিতে কন্টেইনার জাহাজ ভিড়ে।
সীকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীরুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত ৫০ বছরে বাল্ক কার্গো খালাসের জন্য বন্দরের কেউ চিন্তা করেছে কিনা আমার জানা নেই। একটি বন্দরে কন্টেইনার ও বাল্ক কার্গো খালাসের ব্যবস্থা থাকা উচিত। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে সেটি গড়ে উঠেনি।"
তিনি আরো বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দর চাইলেই কুমিরা, সীতাকুণ্ড এলাকায় বাল্ক কার্গো জেটি নির্মাণ করতে পারতো। পৃথিবীর উন্নত অনেক বন্দরে বাল্ক কার্গোর জন্য পৃথক টার্মিনাল রয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু এই বন্দরে।"
লয়েডস লিস্ট অনুযায়ী, বিশ্বের ১০০টি ব্যস্ততম বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৬৪তম। এই অবস্থান নির্ণয় করা হয় শুধুমাত্র কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের উপর ভিত্তি করে।
২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসে ৪ হাজার ২৩১ টি। কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয় ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮ টিইইউস (টুয়েন্টি ফুট ইকুয়েভিলেন্ট ইউনিট।)
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থেকে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজের মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ কন্টেইনার জাহাজ, ৪৫ শতাংশ বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ এবং ১০ শতাংশ লিকুইড কার্গোবাহী জাহাজ আসে।
বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ যোগে মুলত গম, চাল, ডাল, চিনি, ভুট্রা, ছোলা, খাদ্য পণ্য, সিমেন্ট ক্লিংকার, স্ক্র্যাপ সহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়। এছাড়া কন্টেইনারে শিল্পের কাঁচামাল, নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য, তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল, রাসায়নিক, ফলমূল, ফ্রোজেন মিট, স্টিল সহ বিভিন্ন পণ্য আসে। তৈরি পোশাক সহ রপ্তানির প্রায় সকল পণ্য কন্টেইনারযোগে পরিবহন হয়।
এদিকে বন্দর জেটিতেও কন্টেইনার জাহাজের চেয়ে খোলা পণ্যবাহী জাহাজের বার্থিংয়েও কম গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন শিপিং খাতের ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, বন্দরের অন্যান্য জেটিতে ৯.৫ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়ে। কিন্তু জিসিবির যেসব জেটির গভীরতা ৮.৫ মিটার সেখানেই বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজের জন্য বরাদ্দ রেখেছে বন্দর।
জিসিবির ১ থেকে ৮ নম্বর জেটিতে ৮.৫ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়ে। খোলা পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়ানোর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দুই, তিন, চার, পাঁচ, সাত ও আট নম্বর জেটি। এছাড়া ছয়, নয়, দশ, ১১, ১২ এবং ১৩ নম্বর জেটিতে ভিড়ে কন্টেইনার জাহাজ। এসব জেটির গভীরতা ৯.৫ থেকে নয় মিটার।
কম গভীরতার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে খোলা পণ্য নিয়ে আসা জাহাজগুলোকে প্রথম বহির্নোঙ্গরে লাইটার জাহাজে পণ্য খালাস করে ড্রাফট কমাতে হয়। এরপর বন্দর জেটিতে ভিড়ানো হয় জাহাজ। এতে প্রচুর সময়ক্ষেপণ হয়।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, "জিসিবি পুরোনো হওয়ায় এই জেটির সক্ষমতাও কম। এই জেটিতে ৪০ টন পর্যন্ত কার্গো হ্যান্ডেল করতে পারে। ইন্ডাষ্ট্রির ক্যাপিটাল মেশিনারি জিসিবিতে নামানো সম্ভব হয়না।"
তাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বাল্ক কার্গো খালাসের জন্য ডেটিকেটেড জেটি নির্মাণে উদ্যোগী হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, "দেশে আমদানি রপ্তানি যে হারে বাড়ছে তা হ্যান্ডেল করার সক্ষমতা বন্দরের নেই। ফলে বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে বন্দরকে। এতে বন্দরের যন্ত্রপাতির উপর চাপ পড়ছে। তাই জেটির সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।"
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফরুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দরে আসা খোলা পণ্যের ৭৫ শতাংশ বর্হিনোঙ্গরে লাইটার জাহাজে খালাস হয়। বে টার্মিনাল, পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল চালু হলে সেখানে বাল্ক জাহাজ একোমোডেট করতে পারবো।"